মন্ত্রী ও মন্ত্রকের নাম লেখা এমন হরেক তালিকাই ঘুরে বেড়াচ্ছে ফেসবুক-হোয়াটসঅ্যাপে।
গত সপ্তাহের কথা। তখনও ভোটের ফল বেরোয়নি। কারা জিতবে, তা নিয়ে রোজ রোজ নানা জল্পনার জন্ম ও প্রায় তৎক্ষণাৎ মৃত্যু ছিল অনিবার্য। ছড়িয়েছিল নানা এক্সিট পোলও। ধরা হচ্ছিল নানা বাজিও। নানা সূত্রকে উদ্ধৃত করে নানা জনে দাবি করছিলেন, দিদি এত পাবেন তো জোট তত পাবে। ১৯ মে সে বিতর্ক শেষ হয়েছে। কিন্তু তাতে জল্পনা-কল্পনায় উৎসাহের অভাব নেই। এখন লক্ষ্য ২৭ মে। নানা সোশ্যাল সাইটে নিত্যনতুন মন্ত্রিসভা তৈরি হচ্ছে। কোনও প্রামাণ্য তথ্য, নির্ভরযোগ্য সূত্রের উল্লেখ নেই কিন্তু তাতে কী! হাতে হাতে তালিকা ঘুরছে। তা নিয়ে তর্কাতর্কিও হচ্ছে। আবার সকালের তালিকায় যাঁদের নাম থাকছে, দুপুরের দিকে দেখা যাচ্ছে তাঁরা অনেকেই পদ পাচ্ছেন না। আবার সকাল-দুপুরের তালিকা মিলিয়ে আরেকটা নতুন ‘পোস্ট’ বিকেলে মোবাইল থেকে মোবাইলে ঘুরছে।
কিন্তু এ কথা সত্যি যে, মোবাইলের এই ‘পোস্ট’গুলো থেকে নানা এলাকার মানুষ কী চাইছেন, তা কিন্তু বেশ বোঝা যাচ্ছে। উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক দেবব্রত মিত্রর কথায়, ‘‘এই তালিকাগুলোতে মানুষের চাহিদার একটি স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিফলন ঘটছে। তাই এগুলি কিন্তু সমাজবিজ্ঞানের দিক থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রাজনীতিকদেরও উচিত এগুলোর দিকে নজর রাখা।’’
রাজনীতিকরা নজর রাখছেনও। তৃণমূলের উত্তরবঙ্গের অন্যতম শীর্ষ নেতা তথা উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন দফতরের প্রথম মন্ত্রী গৌতম দেবের কাছেও হোয়াটসঅ্যাপের তালিকা পৌঁছেছে। এ ধরনের কাজকর্ম আদতে জনমানসে নানা অহেতুক জল্পনা তৈরি করে দেবে বলে ঘনিষ্ঠ মহলে ক্ষোভ প্রকাশও করেছেন। কিন্তু প্রকাশ্যে এ নিয়ে কথা বলতে চাননি তিনি। কোচবিহারের দুই দাপুটে নেতা রবীন্দ্রনাথ ঘোষ ও উদয়ন গুহ বা আলিপুরদুয়ারের সৌরভ চক্রবর্তী কিংবা মাথাভাঙার বিনয় বর্মনের কাছেও এমন নানা তালিকা পৌঁছেছে। হোয়াটসঅ্যাপে ছড়িয়ে পড়া তালিকার একটিতে সম্ভাব্য তালিকায় গৌতমবাবুর দফতর বদলেছে দেখানো হচ্ছে। আরেকটিতে তাঁর নামই নেই। আবার একটিতে দেখানো হয়েছে উদয়নবাবু পূর্ণমন্ত্রী হচ্ছেন। আরেক সম্ভাব্য তালিকায় সৌরভবাবু, বিনয়বাবু মন্ত্রী হচ্ছেন বলে ধরা হয়েছে। কোথাও আবার জেমস কুজুর, বাচ্চু হাঁসদা, হিতেন বর্মনের নামও বিবেচনাধীন বলে দেখানো হয়েছে। নতুন দফতর সহ মন্ত্রীদের তালিকায় ‘নতুন মুখ’ও রয়েছে। সেই তালিকায় প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দেখা যায় রাজগঞ্জের বিধায়ক খগেশ্বর রায়, সিপিএম ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দেওয়া মালবাজারের বিধায়ক বুলুচিক বরাইক, উত্তর দিনাজপুরের গোলাম রবান্নির নামও। যা দেখেশুনে তৃণমূলের উত্তরবঙ্গের এক জেলা সভাপতির প্রতিক্রিয়া, ‘‘একটা পোস্ট দেখলে মনে হচ্ছে, মুখ্যমন্ত্রী ছাড়া বেশিরভাগ মন্ত্রী উত্তরবঙ্গ থেকেই হবেন। আরেকটা পোস্টে দেখছি উত্তরবঙ্গের কেউ না থাকলেই যেন ভাল হয়।’’
সমাজ বিজ্ঞানীদের বক্তব্য, এই মনগড়া তালিকাগুলো থেকে থেকে দু’টি দিক বোঝা যাচ্ছে। একটি হল, নিজেদের এলাকার জনপ্রতিনিধিদের মন্ত্রীর আসনে দেখার ঝোঁক। দুই, সাধারণ ভাবে রাজ্য রাজনীতি সম্পর্কে মানুষ কী ভাবেন, তা-ও।
সোমবার সাত সকালেই বিভিন্ন হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে মন্ত্রিসভার সম্ভাব্য তালিকা চালাচালি শুরু হয়। সেই তালিকার সাত নম্বরে দেখা যায় উত্তরবঙ্গের প্রথম প্রতিনিধির নাম—উদয়ন গুহ। তাঁকেই দেওয়া হয়েছে উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন দফতরের ভার। তবে গৌতমবাবুর হাতে কী থাকবে? ১১ নম্বরে থাকা গৌতমবাবুর দফতর পাহাড় বিষয়ক এবং তথ্য-সংস্কৃতি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে কি গৌতমবাবুর গুরুত্ব কমিয়ে দেওয়া হচ্ছে? নিজের জেলা দার্জিলিঙে দল একটিও আসন না পাওয়ার শাস্তি পাচ্ছেন গৌতমবাবু? নাকি প্রশাসনিক ভার কমিয়ে সংগঠনের কাজে মন নিতে নির্দেশ দিতে চলেছে দল? এমনই নানা জল্পনা ছড়াতে থাকে উত্তরবঙ্গের তৃণমূল নেতাদের মধ্যে। মোবাইলে মোবাইলে ঘোরা এমন বেশ কয়েকটি তালিকা অনুযায়ী বন দফতর নিজের কাছেই রাখতে সফল হয়েছেন বিনয় বর্মন। গ্রীষ্মের সকালে এই তালিকা ছড়িয়ে পড়তে থাকে দাবানলের মতো। তৃণমূলের কয়েকজন নেতা মোবাইল থেকে ডাউনলোড করে প্রিন্টও করিয়ে নেন। এই তালিকা আতঙ্কে ফেলে দেন উত্তরবঙ্গের অনেক নেতাদের। এক বিধায়ক তো কলকাতার এক নেতাকে ফোনে ধরে সরাসরি প্রশ্ন করেই ফেলেন, ‘‘তবে কী আমি এবারও তালিকায় নেই?’’
রাজনীতির অঙ্ক বলছে, উত্তরবঙ্গ থেকে আগের মন্ত্রিসভার ৪ সদস্য হেরেছেন। তা ছাড়াও আরও দু’জন মন্ত্রী ছিলেন। নতুন মন্ত্রিসভায় অন্তত ৬ জন উত্তরবঙ্গ থেকে থাকার কথা। সেখানে হোয়াটসঅ্যাপের একটি তালিকায় উত্তরবঙ্গ থেকে ৮ জন মন্ত্রী হতে পারেন বলে চালানোর চেষ্টা হয়েছে। তৃণমূলের একজন প্রবীণ নেতা জানান, এই সব তালিকায় নাম নেই এমন কয়েকজন বিধায়কের নাম ‘আসল লিস্ট’-এ থাকার সম্ভাবনা ক্রমশ জোরদার হচ্ছে।
এই পরিবেশে শুরু হয়ে গিয়েছে বাজির লড়াইও। তবে, সোশ্যাল সাইটে তৈরি নানা মন্ত্রিসভা যেমন ক্ষণে ক্ষণে বদলাচ্ছে, বাজির বাজার তেমন নয়। সেখানে ‘বাবনদা’ই মোটামুটি সব জায়গায় এগিয়ে, কখনও তাঁকে প্রায় ছুঁয়ে ফেলছেন ‘গৌতমদা’। কেউ কেউ আবার দর দিচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ ঘোষ, মিহির গোস্বামীর হয়ে। উদয়নবাবু মন্ত্রী হলে ১০০ টাকায় চল্লিশ টাকা জিতে নেওয়ার সুযোগ রয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে। আর না হলেও ১০০ টাকায় ৭০ টাকা। আবার রবীন্দ্রনাথ, মিহিরবাবু-র দর পঞ্চাশে পঞ্চাশ। উদয়নের পক্ষে বাজির দর দেওয়া একজনের বক্তব্য, “অনেকেই ধরে নিয়েছিলেন বাবনদা এ বারে হারছেন। তাঁর জয়ে খুশি রাজ্য নেতারাও। তাই বাবনদা মন্ত্রী হচ্ছেনই। দশ হাজার টাকা বাজি ধরেছি।” ঘড়ি, মিষ্টি, মাংসের বাজিও হচ্ছে। রবীন্দ্রনাথবাবুর এক অনুগামী বলেন, “দাদা মন্ত্রী হলে, আমি জোড়া পাঁঠা কেটে খাওয়াব।”
শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়িতে তৃণমূলের কয়েকজন নেতা জানান, রেস্তোরাঁর ভোজ থেকে টাকা—নানা বাজি চলছে। সন্ধ্যা হতেই লটারির ঢঙে বিধানরোড, সেবক রোড, স্টেশন ফিডার রোড বা হিলকার্ট রোডের আড্ডাগুলিতে শুরু হচ্ছে বাজির ফোয়ারা। ৫/১০ হাজার টাকা থেকে শুরু করে তারা খচিত রেস্তোরাঁর পার্টি নিয়েও বাজি হচ্ছে। তেমনই, অল্প বয়সীদের ২০০-৩০০ টাকার বাজি ছাড়াও মধ্যে ডিজে পার্টি বা গ্রীষ্মে ওয়াটার পার্কের টিকিট কেটে দেওয়ার বাজিও ধরা হচ্ছে বলে শোনা যাচ্ছে।
তবে দার্জিলিং জেলা জুড়ে পরপর ভোটের ফল খারাপ তো বটেই মালদহ, দক্ষিণ দিনাজপুরের রেজাল্ট খারাপ হওয়ায় গৌতমবাবুর শিঁকে ছিড়বে কি না সেই আশঙ্কা নিয়েই বাজির দর ওঠানামা করছে। তৃণমূলের কয়েকজনের অবশ্য দাবি, গৌতমবাবুর হাত ধরেই উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন দফতরে এগিয়েছে। তাই তিনিই দায়িত্বে আসবেন। ইতিমধ্যে সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে রাজ্যের সম্ভাব্য মন্ত্রীদের তালিকায় উদয়নবাবু উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন দফতর পেতে চলেছেন বলে উল্লেখ্য করা হয়েছে। তারপর থেকেই উদয়নবাবুর বাজির পাল্লায় ওজন বেড়েই চলেছে।
জলপাইগুড়িতে বাজির দরে এগিয়ে সৌরভবাবুও। গত সোমবার জলপাইগুড়ি শহরে পার্টি অফিস সহ জেলা ক্রীড়া সংস্থায় গিয়ে সৌরভবাবু নানা আলোচনা করেছেন। তারপর থেকেই সৌরভবাবুর কর্মীরা নিজেদের মধ্যে বাজি ধরতে শুরু করেছেন। জলপাইগুড়ির কিছু ‘কাউন্টার’ থেকেও সৌরভবাবুর মন্ত্রী হওয়া নিয়ে বাজির দর চলছে। বাজির দরে ঢুকে পড়েছেন ময়নাগুড়ি থেকে জেতা অনন্তদেব অধিকারীও। প্রাক্তন বাম বিধায়ক গত রাজ্যসভা ভোটে তৃণমূলে যোগ দেন, পুনর্নির্বাচনে জিতেও আসেন। এ বারেও বিপুল মার্জিনে জিতেছেন। সে কারণে এ বার তাঁর ‘পুরস্কার’ পাওয়ার সম্ভাবনা সবার থেকে বেশি বলে দাবি।
সে কারণেই ময়নাগুড়ির এক ঠিকাদার প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছেন, অনন্তবাবু মন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার পরেই খিচুড়ি এবং পাঁঠার মাংসের ভোজ দেওয়া হবে। পুরাতন বাজার, নতুন বাজার, টেকাডুলি, জোড়পাকড়ি এলাকায় কান পাতলে শোনা যাচ্ছে অন্য বাজির দরও। সেখানে অনন্তবাবুর হয়ে দশ টাকা বাজি ধরলে মিলতে পারে ১২টাকা। তবে একে জুয়া বলতে রাজি নন কেউই। গ্রামের হাটে-বাজারে এ ধরনের বাজি ধরা ঘটি খেলা নামে পরিচিত।