অর্ধেকটা এঁকে দিয়ে গিয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদী। বৃত্তটা এ বার সম্পূর্ণ করে দিলেন রাহুল গাঁধী!
জাতীয় রাজনীতির দুই কেন্দ্রীয় চরিত্রই বুঝিয়ে দিলেন, বাংলায় এ বারের ভোট হচ্ছে দুর্নীতির প্রশ্নে। বিহার-উত্তরপ্রদেশে হলেও বাংলায় যা আগে কখনও হয়নি! প্রধানমন্ত্রী মোদীর মতো কংগ্রেসের সহ-সভাপতিও এ রাজ্যে তাঁর প্রথম দফার প্রচারে সরাসরি নিশানা করলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। এবং ঘোষণা করলেন, বামেদের সঙ্গে নিয়ে দুর্নীতিকে ঝাড়ু মেরে সাফ করা এবং জোট সরকার গড়াই এখন তাঁদের মন্ত্র।
প্রথম দফার প্রচারে এসে শনিবার রাহুল মন্তব্য করেছেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী নন, মমতাজি এ রাজ্যের রানি! তিনি যা চাইবেন, তা-ই করতে হবে! তাঁর প্রশংসা না করলে, তাঁর পছন্দের কাজ না-করলে মার জুটবে, ধোলাই হবে!’’
বামেদের সুরেই রাহুল এ বার মোদী ও দিদিকে এক বন্ধনীতেও এনে ফেলেছেন। বলেছেন, ‘‘দেশে মোদী যা করছেন, রাজ্যটাকে নিয়ে মমতাজি-ও তাই করছেন!’’ বিধানসভার ভোটদান পর্ব আনুষ্ঠানিক ভাবে শুরু হওয়ার ৪৮ ঘণ্টা আগে রাহুলের এ দিনের বক্তব্যে বাম নেতারা খুশি। বহু গুণ উৎসাহ পেয়ে গিয়েছে জোটের প্রচারও।
বস্তুত, দুর্নীতি-অপশাসনের অভিযোগ তুলে মমতার সরকারকে এত দিন তীব্র আক্রমণ করতে ছাড়ছিলেন না অধীর চৌধুরী, দীপা দাশমুন্সিরা। কিন্তু সরাসরি রাহুলের মুখ থেকে কড়া আক্রমণ অবশ্যই গোটা বিষয়টিতে নতুন মাত্রা দিল। কংগ্রেসের অন্দরে মমতা সম্পর্কে বরাবরই কড়া অবস্থান রাহুলের। যদিও সনিয়া গাঁধীর অবস্থান তুলনায় নরম। আর মমতা বরাবরই বোঝানোর চেষ্টা করে এসেছেন, প্রদেশ কংগ্রেস নেতারা যা-ই বলুন, তিনি গাঁধী পরিবারের কাছের লোক। কিন্তু রাহুল এ দিন যে ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন, সাম্প্রতিক কালের মধ্যে গাঁধী পরিবার থেকে এমন কড়া আক্রমণের মুখে মমতাকে পড়তে হয়নি! দুর্নীতির অস্ত্রে আরও শান দেওয়ার পাশাপাশি তৃণমূল নেতৃত্বের দাবি নস্যাৎ করে রাহুল এ দিন এই বার্তাও দিয়েছেন— মমতাকে হারাতে বামেদের সঙ্গে কংগ্রেসের বোঝাপড়া হয়েছে প্রত্যক্ষ ভাবে হাইকম্যান্ডের সম্মতিতেই।
এর আগে এই বিষয়টি নিয়েই কংগ্রেস কর্মীদের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরির চেষ্টা চালিয়েছিলেন তৃণমূল নেতৃত্বের একাংশ।
কলকাতায় ভেঙে পড়া উড়ালপুলের ঘটনাস্থল ঘুরে রাহুল এ দিন প্রথমে আসানসোলের কুলটি, তার পর বাঁকুড়া এবং শেষে দুর্গাপুর পশ্চিম বিধানসভা কেন্দ্রে সভা করেছেন। তৃণমূল ও তাদের নেত্রীকে সরাসরি আক্রমণে যেতে তিনটি সভার কোনওটিতেই একটুও বিলম্ব করেননি সনিয়া-তনয়। তাঁকে সব চেয়ে বেশি আক্রমণাত্মক শুনিয়েছে দুর্গাপুরে। সেখানে রাহুল বলেছেন, ‘‘গণতন্ত্র এবং উন্নয়নের জন্য আমরা পাঁচ বছর আগে মমতাকে সমর্থন করেছিলাম। কংগ্রেসের সমর্থন ছাড়া তিনি ক্ষমতায় আসতে পারতেন না। কিন্তু তার পরে কী পেলাম? কেলেঙ্কারির সরকার! সারদার সরকার! চুরির সরকার!’’
রাহুলের আরও বক্তব্য, ‘‘মমতাজি বলতেন, তিনি নাকি দুর্নীতির বিরুদ্ধে। বাংলায় দুর্নীতি ঢুকতে দেবেন না। এই কয়েক বছরে তা হলে সারদা-কাণ্ডে কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলেন না কেন? নারদার গোপন ক্যামেরায় দেখা গেল নেতা-মন্ত্রীরা ঘুষ নিচ্ছেন। তাদের কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলেন না কেন? উড়ালপুল ভেঙে পড়ল। শোনা যাচ্ছে, তৃণমূলের লোকজনই বানাচ্ছিল। ভুল মালমশলা ব্যবহার করা হচ্ছিল। তার পরেও কোনও ব্যবস্থা নিয়েছেন? এই উড়ালপুল আসলে এই সরকারের প্রতীক!’’ জোট সরকার গড়ে তুলে এই দুর্নীতির পাণ্ডাদের কড়া শাস্তি এবং প্রতারিতদের টাকা ফেরতের ব্যবস্থা করতে হবে বলে বাম নেতাদের কাছে আহ্বান জানিয়ে গিয়েছেন রাহুল।
কংগ্রেস সহ-সভাপতির এই বক্তব্যের সঙ্গে সিপিএম নেতৃত্ব প্রত্যাশিত ভাবেই একমত। দলের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র-সহ সিপিএমের শীর্ষ নেতারা এখন নিয়ম করেই বলছেন, বিকল্প সরকার ক্ষমতায় এলে সারদা, নারদা-সহ সব দুর্নীতির তদন্ত হবে। রাহুলের বক্তব্যের পরে তাই সূর্যবাবুর প্রতিক্রিয়া, ‘‘উনি কোনও ধোঁয়াশা রাখেননি। এই কথাগুলোই আমরা রোজ বলছি। শুধু দুর্নীতিই নয়, আমরা যা তিল তিল করে গড়ে তুলেছিলাম, এই সরকার তার সবকিছুই ধ্বংস করেছে। সেগুলো আবার পুনরুদ্ধার করার জন্য আমরা মানুষের কাছে অঙ্গীকারবদ্ধ।’’
সিপিএম যখন রাহুলকে স্বাগত জানাচ্ছে, তৃণমূল নেতৃত্ব অবশ্যই এমন আক্রমণে ক্ষুব্ধ। রাহুল এ দিন বলেছেন, মোদী ও মমতা দু’জনেই একনায়ক! কারও কথা তাঁরা শোনেন না, বিরুদ্ধ মত পছন্দও করেন না। তৃণমূল সাংসদদের কেউ কেউ একান্তে এই একনায়কতন্ত্র নিয়ে আক্ষেপ করেন বলেও মন্তব্য করেছেন রাহুল। যার জেরে রাহুলকে ‘খোকাবাবু’ বলে কটাক্ষ করেছে শাসক দল! তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘অর্বাচীন, খোকাবাবুর মতো কথা! ঠাকুমা, বাবা, মায়ের পরে রাজনীতিতে এসেছেন। শতাব্দীপ্রাচীন একটা দলে মা সভানেত্রী, ছেলে সহ-সভাপতি। তাঁর মুখে অন্য দলে একনায়কের কথা মানায়?’’ আর দুর্নীতির অভিযোগ? পার্থবাবুর জবাব, ‘‘সারদা নিয়ে অপপ্রচারের জবাব মানুষ আগেই ভোটে দিয়েছেন। নারদা নিয়েও দেবেন। আর উড়ালপুলটা তো দুর্ঘটনা। তার তদন্তও হচ্ছে।
কিন্তু মানুষের মৃত্যু নিয়ে নোংরা রাজনীতি হচ্ছে!’’
দুর্নীতি, কেলেঙ্কারি নিয়ে মুখ খোলার পাশাপাশিই রাহুল এ দিন বুঝিয়ে দিয়েছেন, মমতার জমানায় শিল্পায়নের বেহাল দশা তাঁদের নজর এড়ায়নি। কটাক্ষ করেছেন, ‘‘মোদী বলেন দু’কোটি চাকরি হয়েছে। আর মমতাজি বলেন, ৭০ লক্ষ চাকরি হয়েছে! কোথায় সে সব চাকরি, একটু দেখাবেন!’’ বামেদের সঙ্গে নিয়ে ‘মানুষের সরকার’ গড়ে উঠলে তারা রাজ্যে শিল্পায়ন, উন্নয়ন ও তরুণ প্রজন্মের কর্মসংস্থানকে অগ্রাধিকার দেবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন কংগ্রেস সহ-সভাপতি।