—ফাইল চিত্র।
ডান হাতের অনামিকায় হীরের আংটি। বিয়ের সময়ে স্ত্রী পরিয়ে দিয়েছিলেন। বাঁ হাতে একটা নীলার আংটি। এক জ্যোতিষীর পরামর্শে পরেছেন। আর এই নীলার আংটি পরেই নাকি তাঁর রাজনৈতিক ক্ষমতা বেড়েছে। পুরসভার কাউন্সিলর হয়েছেন, বিধায়ক হয়েছেন। এ সবের সঙ্গে সঙ্গে ব্যবসাটাও বেড়েছে। কথার ফাঁকে এ সব খবর নিজেই জানিয়ে দিলেন বীজপুরের তৃণমূল প্রার্থী শুভ্রাংশু রায়। যাঁকে গোটা বীজপুর এক ডাকে হাপুন নামেই চেনে।
চিনবে না-ই বা কেন? হাপুনের বাবার পরিচয়টাও তো ফ্যালনা নয়। তিনি মুকুল রায়। এখন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি। আগে ছিলেন দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক। এবং তখন তিনিই ছিলেন তৃণমূলের অঘোষিত নম্বর-টু। সারদা-কাণ্ডের জেরে মাঝে কিছুদিন বাবার সঙ্গে তাঁর দলের নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দূরত্ব তৈরি হয়েছিল। সে সময় হাপুন একবার প্রকাশ্যেই হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছিলেন, বাবার অপমান মেনে নেবেন না। তাতে কাজ হয়নি বুঝে এক সময় বরফ গলাতে আসরে নামেন ৩৩ বছরের হাপুন নিজেই। দমদমে প্রকাশ্য সভায় বলেন, ‘‘মুকুল রায় আছেন তৃণমূলেই। কারণ মুকুল রায়ের শরীরে যে রক্ত বইছে তা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়েরই রক্ত!’’ দলের অন্দরে যাঁরা ভাবতেন বাবার ছায়ায় বীজপুরের বিধায়ক হয়ে গিয়েছেন শুভ্রাংশু ওরফে হাপুন, তাঁরা বুঝতে পারলেন রাজনীতিতে পোক্ত হয়ে উঠছেন তিনি। এক সময় চুটিয়ে ক্রিকেট খেলা হাপুন রাজনীতির দীর্ঘ ইনিংস খেলতেই নেমেছেন।
রাজনীতি যেমন হাপুনের রক্তে, ব্যবসাও তেমনই। হাপুনই জানিয়েছেন, তাঁর বাবা এক সময় রেলের কামরায় স্যুইচ প্যানেল সরবরাহের ব্যবসা করতেন। বাবার পরে ছেলে সেই ব্যবসা চালিয়েছিলেন। কিন্তু বাবা রেলের প্রতিমন্ত্রী হওয়ার পরে ব্যবসা বন্ধ করে দেন হাপুন। তাঁর কথায়, ‘‘সেই সময়ে বাবাই ব্যবসা চালাতে বারণ করেছিলেন। কারণ নানা কথা উঠতে পারে!’’
ওটাই অবশ্য হাপুনের প্রথম ব্যবসা নয়। কল্যানীর জেআইএস কলেজে পড়ার সময়েই পকেট মানি জোগাড় করতে পাখি বেচার ব্যবসা শুরু করেছিলেন। সেটা ২০০১-২০০২ সালের কথা। তখনই পাখি বেচে মাসে ২০-৩০ হাজার টাকা পকেটে আসত। এখন অবশ্য পাখি বিক্রির ব্যবসা করেন না। পাখি পোষেন। ম্যাকাও, কাকাতুয়া, গ্রে প্যারট মিলিয়ে তাঁর অন্তত ৫০টির বেশি পাখি আছে। আছে রঙিন মাছ, কুকুরও। জীবজন্তুর প্রতি এই ভালবাসা থেকেই নিজের নির্বাচনী কেন্দ্রের হালিশহরে একটা ছোট চিড়িয়াখানা করতে চান তিনি। পাখির ব্যবসা বন্ধ করে বিটেক, এমবিএ পাশ করা হাপুন এখন কাঁচরাপাড়ায় বাচ্চাদের স্কুল খুলেছেন। চালু করেছেন কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। পাশাপাশি ডায়গোনেস্টিক সেন্টার খুলে ব্যবসা করছেন। তাঁর স্ত্রী শর্মিষ্ঠাও ব্যবসা দেখেন। স্বামী, স্ত্রী মিলিয়ে বছরে প্রায় ৪১ লক্ষ টাকা আয় করেন। অন্তত নির্বাচন কমিশনের কাছে তেমনই হিসেব দাখিল করেছেন হাপুন।
এলাকার বিরোধীদের একাংশ অবশ্য বলছেন, ‘‘কমিশনে যে হিসেবই দিন, হাপুনের রোজগার অনেক বেশি!’’ হালিশহর, কাঁচরাপাড়া পুরসভা নিয়ে বীজপুর বিধানসভা। ৩০ পাতার পুস্তিকা প্রকাশ করে বিধায়ক হিসেবে এলাকায় ৪৭টি উন্নয়নমুলক কাজের ফিরিস্তি দিয়েছেন শুভ্রাংশু। এই সব কাজকে কেন্দ্র করে বিরোধীরা তো বটেই দলেরও অনেকে অভিযোগ তুলেছেন। সে সব তুলতেই শুভ্রাংশু বলেন, ‘‘কেউ প্রমাণ দিতে পারবেন? আমার বিধায়ক তহবিলের নব্বই শতাংশ টাকার কাজ করিয়েছি। পুরোটা করিয়েছি পুরসভার মাধ্যমে।’’
এ বার তাঁর প্রধান প্রতিপক্ষ সিপিএমের রবীন মুখোপাধ্যায়। নৈহাটি ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র কলেজের প্রাক্তন শিক্ষক রবীনবাবুর অভিযোগ, ‘‘তৃণমূল প্রার্থীর ব্যাপারটা হচ্ছে, যেনতেন প্রকারে ক্ষমতা দখল করে রাখা। পুরভোটেও উনি বাহিনী নিয়ে সন্ত্রাস করে পুরসভা বিরোধী শূন্য করে দিয়েছেন।’’ সত্তরোর্ধ্ব রবীনবাবু প্রচারে নেমে দলের কর্মীদের নিয়ে যাচ্ছেন বাড়ি বাড়ি। আবেদন, সন্ত্রাস প্রতিরোধ করে নিজের ভোটটা নিজে দিন। যা শুনে কাঁচরাপাড়ায় ঘটক রোডের বাড়িতে এসি-র রিমোট দিয়ে ঘরের তাপমাত্রা কমাতে কমাতে হাপুনের জবাব, ‘‘লোকসভা ভোটে বিরোধীদের থেকে ৯২,৯০৮ ভোটে এগিয়ে ছিলাম। পুরভোটেও বিরোধীদের সঙ্গে আমাদের ব্যবধান ছিল প্রায় ৯১ হাজার। সন্ত্রাস করলে এই ব্যবধান তো আরও বেড়ে যেত!’’ অনেক নিশ্চিন্ত শোনায় হাপুনের গলা।
হাপুনের দাবি, সন্ত্রাস করলে মানুষ তাঁর সঙ্গে থাকত না। তিনি বাড়ির বাইরে বেরলে বহু মানুষ তাঁর সঙ্গে হাঁটেন। মুকুল বলছেন, ‘‘মানুষের পাশে দাঁড়ানোর একটা প্রবণতা ওর আছে। তাই মানুষের ভালবাসাও হাপুন পাচ্ছে।’’ যদিও মুকুল-ঘনিষ্ঠ কাঁচরাপাড়ায় তৃণমূলের যুব সংগঠনের প্রাক্তন নেতা প্রবীর সরকার বলছেন, ‘‘বীজপুর সব সময়ে ক্ষমতার সঙ্গে থাকে। মুকুলদাই বলেছেন, যে দিন ক্ষমতা চলে যাবে, সে দিন একটা চেয়ার পাতার লোকও মিলবে না! এটা উনি নাকি হাপুনকে বলেছেন। হাপুন হুঁশিয়ার ছেলে। ও বাবার কথা মাথায় রাখে বলেই মনে করি।’’
প্রচারে নেমে ঘটক রোড থেকে পিকে দত্ত রোডের দিকে হাঁটছেন হাপুন। ভিড়ের মধ্যে এক মহিলা ফুল ছুঁড়তে ছুঁড়তে হাপুনের দিকে এগিয়ে আসেন। তিনি সিপিএমের এক প্রাক্তন কাউন্সিলর! হঠাৎ হাপুনকে এত অপ্যায়ন কেন? মহিলার জবাব, ‘‘কেন করব না? বিপদে আপদে ওকে পাশে পাই। ও আমাদের ঘরের ছেলে! হাপুন দ্য গ্রেট!’’
এটাও কি নীলার প্রভাব? হাসছেন হাপুন দ্য গ্রেট!