এ পারে ভূত, ও পারেও

বাসি রুটি খেয়েই বুথে যান তহিদুল

কেঁদে-কেঁদে আর কথা বেরোচ্ছিল না মুর্শিদা বিবির গলা দিয়ে। ফ্যাসফেসে গলায় শুধু বলছেন, ‘‘পারলে ওরা এসে এক বার দেখে যাক আমাকে। মুখে রং (রক্ত) মাখা স্বামীটাকেও একবার দেখে যাক।’’

Advertisement

সুজাউদ্দিন

ডোমকল শেষ আপডেট: ২২ এপ্রিল ২০১৬ ০৩:১৮
Share:

তহিদুলের দেহ ঘিরে কান্না পরিবারের। — সাফিউল্লা ইসলাম

কেঁদে-কেঁদে আর কথা বেরোচ্ছিল না মুর্শিদা বিবির গলা দিয়ে।

Advertisement

ফ্যাসফেসে গলায় শুধু বলছেন, ‘‘পারলে ওরা এসে এক বার দেখে যাক আমাকে। মুখে রং (রক্ত) মাখা স্বামীটাকেও একবার দেখে যাক।’’

দিনের শেষে ময়না তদন্তের পরে তহিদুল মণ্ডলের দেহ ফিরেছে গ্রামে, ভিড় উপচে পড়েছে বাড়ির সামনে।

Advertisement

তহিদুলের দাদা সাইফুল মণ্ডল ধরা গলায় বলছেন, ‘‘সত্যি কোনও গণ্ডগোল হলেও না হয় বুঝতাম যে, ঝামেলায় জড়িয়ে ওর মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু এ ভাবে একটা নিরীহ মানুষকে বেঘোরে প্রাণ দিতে হবে?’’

বাড়িতে বই, এক ছেলে আর দুই মেয়ে। নুন আনতে পান্তা ফুরোত দিনমজুর তহিদুলের। ‘‘কী ভাবে এখন ওই চার জনের মুখে ভাত উঠবে? কে জোটাবে?’’— ফাঁকা গলায় যেন নিজেকেই প্রশ্ন করেন সাইফুল।

এর আগে বছরের পর বছর, এমনকী ২০০৮ সালের পঞঅচায়েত নির্বাচনেও মৃত্যুমিছিল দেখেছিল ডোমকল। কিন্তু তার পরে কয়েকটা বছর ছবিটা বদলে গিয়েছিল। এ দিন ফের ডোমকল ফিরল চেনা চেহারায়।

সকাল ৬টা নাগাদ স্ত্রী মুর্শিদাকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন তহিদুল। মুর্শিদা খাবার তৈরির কথা বললেও তিনি বলেন, ‘‘না, খাবার নয়, ভোট আগে। তৃণমূল গণ্ডগোল পাকাতে পারে, তাই সকাল-সকাল ভোট দিতে হবে।’’

আগের দিনের রুটি রাখা ছিল। একটা বাসি রুটি খেয়ে স্ত্রীকে নিয়ে ভোর-ভোর বুথের দিকে রওনা দিয়েছিলেন তহিদুল। মুর্শিদার ভোট মিটেও গিয়েছিল বিনা বিপত্তিতে। হাঁফ ছেড়ে স্ত্রীকে এগিয়ে দিতে বাইরে এসেছিলেন তিনি।

বিলাপের মতো মুর্শিদা বলে চলেছেন, ‘‘এক সঙ্গে বেরিয়েই দেখি, ওরা পাশ থেকে বোমা ছুড়ছে। একটা বোমা কাছে এসে পড়তেই লুটিয়ে পড়ল ও। আমি হাতটা ধরতেই আরও একটা বোমা। ছিটকে যাই। খুনিরা ওকেো কুপিয়ে চলে যাওয়ার আগে চেনা লোকেরাও কেউ কাছে ঘেঁষতে পারছিল না। পরে ওরাই কাঁধে করে ওকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। কিছুটা যেতেই ও মারা যায়।’’

বুথের সামনে দাঁড়িয়ে প্রশাসনের দিকে বারবার আঙুল তোলে নিহতের মেয়ে তহমিনা খাতুন। বলতে থাকে, ‘‘আপনাদের সামনেই আমার বাবাকে খুন করল। দাঁড়িয়ে দেখে গেলেন। একটু এগিয়ে গেলেও ওরা এমনটা করতে পারত না।’’

এই অভিযোগ দিনভর তুলেছে হরিদোবা এলাকার মানুষ। আসলে তাঁরা ভরসা করেছিলেন নির্বাচন কমিশন আর আধা সেনার উপরে। সেই ভরসা মাটিতে মিশেছে।

রাজনীতি অবশ্য চলছেই।

ময়নাতদন্তের পরে তহিদুলের দেহ বাড়িতে ফিরতেই পৌঁছে গিয়েছেন সিপিএম প্রার্থী আনিসুর রহমান। সেখানে দাঁড়িয়েই প্রশ্ন তুলেছেন, ‘‘একটা মৃত্যু তো নাটক নয়! রক্তের দাগ তো নাটক নয়! মুখ্যমন্ত্রী আর তাঁর দলকে এর দায় নিতে হবে।’’

তৃণমূল প্রার্থী সৌমিক হোসেনের বাবা, জেলা তৃণমূল সভাপতি মান্নান হোসেন আবার বলছেন, ‘‘আমাদের নেতা কামরুজ্জামানের নামে মিথ্যা অভিযোগ তোলা হচ্ছে। নিজেদের গণ্ডগোলের জেরেই এই খুন।’’ যা শুনে কংগ্রেস প্রার্থী আব্দুর রহমানের কটাক্ষ, ‘‘একটা মানুষের মৃত্যু ঘিরে তৃণমূল এমন মিথ্যাচার করতে পারে, তা এই ঘটনা না ঘটলে বোঝাই যেত না। খুনের রাজনীতি করে তৃণমূল ক্ষমতায় আসতে চাইছে।’’

পুলিশ সুপার সি সুধাকর অবশ্য বোমা মারার কথাটাই মানতে চাইছেন না। তিনি বলছেন, ‘‘প্রাথমিক ভাবে মনে হচ্ছে, ধারালো কোনও অস্ত্র দিয়ে আঘাত করা হয়েছে। গোটা ঘটনার তদন্ত চলছে, অভিযুক্তরা পলাতক। গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।’’

ডোমকলের মানুষ অবাক হচ্ছেন না। তাঁদের অভ্যেস আছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন