মেদিনীপুরের পঞ্চুরচকে শ্রীমন্তর চা দোকানে চলছে ভোট-আড্ডা। ছবি: সৌমেশ্বর মণ্ডল।
বেলা গড়াতেই ভিড়ে গমগম করে শ্রীমন্তর চা দোকান। শুরু হয়ে যায় আড্ডা। সেই আড্ডায় এখন শুধুই ভোট রাজনীতি আর জেলার ইতিহাস- ভূগোল!
কাল, বৃহস্পতিবার বিধানসভা ভোটের ফল ঘোষণা। তার আগে মেদিনীপুর শহরের পঞ্চুরচকের এই চা দোকানের আড্ডায় শুধুই ভোটের কাটাছেঁড়া। সোমবার সন্ধ্যায় বেশ কয়েকটি সংস্থার ভোট পরবর্তী সমীক্ষা প্রকাশিত হয়েছে। সকলেই প্রায় ‘দিদি’কে এগিয়ে রেখেছে। ফলে, ভোটের আড্ডায় সেই প্রসঙ্গও উঠছে। চা বিক্রেতা শ্রীমন্ত চক্রবর্তী বলছেন, “নিত্যদিনই তো এই আড্ডা চলে। চা তৈরি করতে করতে সব শুনি। কতজনের কত কথা। তবে অনেক কিছু জানতেও পারি।”
আর চা বিক্রি? হাসছেন শ্রীমন্ত, “আড্ডা বেশি হলে বিক্রি একটু কমই হয়! সামনে ভোটের ফল তো। তাই এখন একটু বেশিই আড্ডা জমছে।”
শুধু শ্রীমন্তর চা দোকান নয়, মঙ্গলবার দিনভর শহরের অন্য চা দোকানগুলোও এই ভোট পরবর্তী কাটাছেঁড়া নিয়েই সরগরম ছিল। গাঁধীমূর্তি মোড়ের জিজার চা দোকান, স্কুলবাজারে বাদলদার চা দোকান, অশোকনগর মোড়ে শৈলেনদার চা দোকান, সরগম মোড়ে জামাইয়ের চা দোকান, এলআইসি মোড়ে পিলুদার পান দোকান, মিনি মার্কেট মোড়ে টিপুদার চা দোকান— সর্বত্র এক ছবি। গাঁধীমূর্তি মোড়ের জিজার আসল নাম পরমেশ্বর সিংহ। শ্বশুরবাড়ি শহরেই। তাই তাঁকে অনেকে ডাকতেন জামাই বলে। অবাঙালি বলে পরে সেই জামাই বদলে যায় জিজায়! সেটা কবেকার কথা। সেই থেকে ছেলেবুড়ো সকলেই তাঁকে ডাকে জিজা বলে। পরমেশ্বরও বললেন, “সামনে তো ভোটের ফল বলে এখন ওই নিয়েই বেশি কথা হচ্ছে।” এ দিন দুপুরেই যেমন চা খেতে এসেছিলেন দুই যুবক। এক যুবক বলছিলেন, ‘জিজা, দু’টো লাল চা দেবে তো। চিনি কম!’ পাশ থেকে সঙ্গী যুবক ফোড়ন কাটেন, ‘কেন রে, এখন থেকেই চিনি কম। পরে গুড়-বাতাসা খাবি বলে না কি!’
শ্রীমন্তর দোকানের ভিড়ে এ দিন মিশেছিলেন বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী, সৌমাশিস পাল, সৌমেন দত্তরা। বিশ্বজিৎ বলছিলেন, “জেলায় ১৮ প্লাস হবে। বলে দিলাম! মিলিয়ে নিবি!” পাশে বসা এক যুবকের মন্তব্য, “আগে তো ১৪ প্লাস হোক! ১৮ অনেক দূর!” বিশ্বজিৎ পেশায় প্রাথমিক স্কুল শিক্ষক। সৌমাশিস মেডিক্যাল রিপ্রেজেনটেটিভ। দুপুরের আড্ডায় এক যুবকের রসিক মন্তব্য, “কাঠফাটা রোদে জোড়াফুল শুকিয়ে গিয়েছিল প্রায়! বৃষ্টির জল পেয়ে ফের যেন জেগে উঠছে। দেখা যাক, ১৯ তারিখে ফুল কতটা ফোটে!” কথা শেষ হতে না হতেই সৌমেন বলে দেন, “ফুল তো ফুটবেই! সঙ্গে হাত-হাতুড়ি-কাস্তেও জব্দ হবে। এমন জব্দ হবে যে আর ওদের মাঠেঘাটে দেখা যাবে না!”
পশ্চিম মেদিনীপুরে বিধানসভার ১৯টি আসন রয়েছে। কে কত আসন পাবে, ভোট পরবর্তী সমীক্ষা সামনে আসার পরে সেই নিয়ে বিস্তর আলোচনা শুরু হয়েছে শহরে। কারও দাবি, তৃণমূল ১৭ কিংবা ১৮-র নীচে নামবে না। আবার কারও দাবি, জোট অন্তত ৫-৬টি আসন পাবে। কোন আসন কে পাবে, সেই নিয়েও চলছে জোর তর্ক-বিতর্ক। কেউ ডেবরায় জোটকে এগিয়ে রাখছে, কেউ খড়্গপুরে জোটকে পিছিয়ে রাখছে, কেউ আবার ঘাটালের মতো আসনে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে বলে দাবি করছে। শ্রীমন্তর চায়ের দোকানের পাশেই স্বপন বেরার পানের দোকান। চায়ের দোকানের পাকা বেঞ্চের আড্ডায় যত কথা হয়, সবই কানে যায় স্বপনের। স্বপন বলছিলেন, “কতজন আসেন। কত কথা বলেন। সব কথাই শুনতে হয়। মন্দ লাগে না কিন্তু। ঈর ভোটের মরসুমে এমন আড্ডা একটু বেশি হবে, এ আর নতুন কী!”
মঙ্গলবার দুপুরের আড্ডার তাল হঠাৎ কেটে যায় শ্রীমন্তর চিৎকারে! দোকানের সামনে থাকা ভিড়ের কাছে গিয়ে শ্রীমন্ত বলে দেন, “শুধু ভোট ভোট করলে হবে! দোকান চলবে কী করে! কে কে চা খাবে বলে দাও। এরপর কিন্তু আর চা হবে না! লাল চা নয়, দুধ চা-ও নয়!” ধীরে ধীরে পাতলা হয় ভিড়টা। ফের শুরু হয় আড্ডার অপেক্ষা।