তাঁর সঙ্গে দার্জিলিঙের পাহাড়ি পথে হাঁটার বেলা বারবার দেখেছি, লক্ষ্যে অবিচল থেকে চড়াই ভাঙতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সদাই সাবলীল। অন্যদের কাছে যত কঠিনই হোক, তিনি ক্লান্তিহীন পায়ে হাওয়াই চটি ফটফটিয়ে অনায়াসে উঠে যান মহাকাল মন্দিরে। রিচমন্ড হিল থেকে পা চালিয়ে চলে যান টাইগার হিল। এক বারও না থেমে রুক্ষ পাথুরে পাহাড়ি রাস্তা পেরিয়ে সুনতালেখোলা থেকে পৌঁছে যেতে পারেন মৌচুকি। এমন আরও কত!
এটাই মমতা। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে বন্ধুর পথ পেরোনোর অভ্যাস যাঁর আয়ত্তে। তাই অন্যেরা পিছিয়ে পড়লেও তিনি ছুঁতে পেরেছেন শিখর। বৃহস্পতিবারের নির্বাচনী ফল আরও এক বার তা প্রমাণ করল।
২০০৬ –এর বিধানসভা ভোট ‘ব্র্যান্ড বুদ্ধ’ গরিমায় চিহ্নিত হয়েছিল। এ বার ‘ব্র্যান্ড মমতা’র জয়জয়কার। তৃণমূলের এই জয়ের মাহাত্ম্য আপাতদৃষ্টিতে কিঞ্চিৎ বেশি। কারণ বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ছিলেন বামফ্রন্টের মিলিত শক্তির মুখ। বিরোধী শিবিরও ঐক্যবদ্ধ ভাবে লড়েনি। কিন্তু মমতা লড়েছেন একক শক্তিতে। তাঁর বিরুদ্ধে সিপিএম (বামফ্রন্ট) ও কংগ্রেস দুই প্রধান বিরোধী দলের জোট ছিল, ছিল তৃতীয় পক্ষ বিজেপি। ছিল ভোট কাটা-ভোট জোড়ার নানা জটিল অঙ্ক,
নারদ-ভিডিও, উড়ালপুল ভেঙে পড়ার মতো একাধিক প্রতিকূলতা। অনেকের অনেক হিসেব নস্যাৎ করে তিনি যে শুধু দলকে বিপুল ভোটে জেতালেন তা নয়, পিছনে ফেললেন ২০১১-য় কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বেঁধে জেতা তৃণমূলের প্রাপ্ত আসন-সংখ্যাকেও। কার্যত নির্বাসনের পথ দেখিয়ে দিলেন সিপিএমকেও।
প্রচারের শুরুতেই মমতা বলেছিলেন, ‘‘২৯৪ আসনেই আমি প্রার্থী। এটা ভেবে ভোট দিন।’’ নিজের মর্যাদাকে বাজি রেখে এমন চ্যালে়ঞ্জ নেওয়া কম কথা নয়। বিশেষত যেখানে জোটের অঙ্কে ভোট ভাগাভাগির পাটিগণিত তাঁর পক্ষে একশো ভাগ আশা জাগানোর মতো ছিল না। কিন্তু চ্যালেঞ্জ নিতে বরাবরই ভালবাসেন। সঙ্গী প্রবল আত্মবিশ্বাস। যা তাঁকে আরও এক বার সাহায্য করল।
তৃণমূলের এই বিশাল জয়ের পিছনে কন্যাশ্রী, ১০০ দিনের কাজ, গ্রামের রাস্তাঘাট কিম্বা শহরের ঝাঁ চকচকে চেহারা— কোনটা কত দূর কাজ করেছে, তা নিয়ে তর্ক চলতেই পারে। তবে এই জয়ে লুকিয়ে রয়েছে অন্য একটি বার্তাও— মমতার হাতে সিপিএম ও কংগ্রেসের যুগপৎ ‘নিধন’।
রাজনৈতিক উত্থানের সূচনা থেকেই তিনি সিপিএম বিরোধিতার অন্যতম বিশ্বাসযোগ্য মুখ। ১৯৮৪-র লোকসভা ভোটে সিপিএমের সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়কে হারিয়ে ‘জায়েন্ট কিলার’ মমতার আপসহীন সিপিএম-বিরোধিতাই তাঁকে রাজীব গাঁধীর প্রিয়পাত্র করে তুলেছিল। তখন থেকেই রাজ্য কংগ্রেসে তাঁর শত্রুও বাড়ছিল। রাজীবের মৃত্যুর পরেও যত দিন কংগ্রেসে ছিলেন, দলের অন্দরে ক্রমাগত লড়েছেন তাঁদের বিরুদ্ধে, যাঁদের মমতা বলতেন ‘সিপিএমের বি-টিম।’
মাঝের এতগুলো বছরে অনেক পট পরিবর্তন হয়েছে। বহু চড়াই ভেঙে পথ তৈরি করে উঠতে হয়েছে মমতাকে। কংগ্রেসকে টুকরো করে তৃণমূল কংগ্রেস তৈরির পরে তাঁর বিরোধিতা করা বহু কংগ্রেস নেতা মমতার কাছেই রাজনৈতিক আশ্রয় ও সম্মান পেয়েছেন। সিপিএম-কে হারাতে তিনি নিজেও কংগ্রেসের সঙ্গে বারবার জোট গড়েছেন। যার সব চেয়ে উল্লেখযোগ্য ‘সাফল্য’ ২০১১-র বাম বিদায়। সেই কংগ্রেস যখন এ বার সিপিএমের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধল, মমতার কাছে চ্যালেঞ্জটা ফের অন্য মাত্রা পেল। ঘনিষ্ঠ মহলে তিনি বুঝিয়েছিলেন, এ-টিম, বি-টিমকে একসঙ্গে ‘শিক্ষা’ দেওয়ার এমন সুযোগ তিনি ছাড়বেন না।
জেদ ও আবেগের এক অদ্ভুত মিশেল বরাবর মমতাকে এগিয়ে দিয়েছে। মাথা থেকে পা পর্যন্ত ক্ষতবিক্ষত হয়েও কখনও মাঠ ছাড়েন নি। মনে পড়ে, ১৯৮৯-তে যাদবপুর লোকসভা কেন্দ্রে দ্বিতীয় বার হারার পরে তৎকালীন কংগ্রেসে তাঁর অনেক দাদা-ই আড়ালে হেসেছিলেন। তা মমতা নিজেও জানতেন। তাঁর হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটের বাড়ির সামনে তখন অনেকটা ফাঁকা জায়গা। ভোটের সময়ে সেখানে ছাউনি বেঁধে ক্যাম্প অফিসের মতো তৈরি হতো। লোকজনের ভিড়, সাংবাদিকেরাও সেখানেই জড়ো হতেন। মমতা সবার সঙ্গে দেখা করতেন। ’৮৯-র ভোটের ফল যে দিন বেরোল, সে দিন সন্ধ্যায় সামিয়ানা প্রায় সুনসান। সেখানে দাঁড়িয়ে মমতা বলেছিলেন, ‘‘আজকের এই পরাজয়টা আমার জেদ আরও বাড়িয়ে দিল। আমিও দেখব, সিপিএম কত দূর যেতে পারে।’’ ২০১১ তখনও বহু দূরে !
এ বারেও তেমনই তীব্র জেদে মাঠে নামা। যাবতীয় রাজনৈতিক প্রতিকূলতাকে ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে মোকাবিলা করে এগিয়েছেন নিজস্ব স্টাইলে। কখনও নরমে, কখনও গরমে। রাজ্য চষে ফেলে প্রায় দুশোটি সভা। অভিজ্ঞতার আলোয় দাবি করেছেন, ‘‘মানুষের চোখে-মুখে যে ভাষা
দেখেছি, তাতে আমার চিন্তা নেই।’’
কিন্তু এত বড় জয়! জোট ও বিজেপি সকলকে পথে বসিয়ে একেবারে ২১১! মমতা নিজেও কি এতখানি ভেবেছিলেন? প্রশ্নটা পাক খাচ্ছে অনেকের মনে। ঘটনা হল, ২০০ আসনের লক্ষ্য নিয়েই এ বারের ভোট শুরু করেছিলেন মমতা। জানতেন, পাঁচ বছর সরকার চালানোর পরে তাঁর লড়াই যতটা অন্যদের সঙ্গে, তার চেয়ে অনেক বেশি নিজের সঙ্গে। তাই গত বারের ১৮৪ আসন পেরোতে না পারলে জয় ‘পূর্ণতা’ পাবে না। মাঝখানে বিভিন্ন প্রতিকূল পরিস্থিতি সেই হিসেবকে একটু টালমাটাল করে দেয়নি তা নয়। তবে দিনের শেষে মমতা প্রত্যাশিত ২০০-র গণ্ডি পেরিয়েছেন, এটাই সত্য। বিরোধীদের মিলিত ক্ষমতার চেয়ে একা মমতা আজ বেশি বলীয়ান।
তৃণমূলের জন্মের পরে ১৯৯৮-র লোকসভা ভোটে প্রথম রাজ্যে সাতটি আসন জিতেছিল দল। কংগ্রেসে জয়ী শুধু বরকত গনি খান। মনে পড়ে, ফল প্রকাশের দিন অনেক রাতে তাঁর বাড়িতে একা পাওয়া গেল মমতাকে। সাফল্যের ধকল সামলে সবে ঘরে ঢুকেছেন। এমন সময়ে বাইরে কোলাহল। কোনও এক জেলা থেকে ম্যাটাডরে ছেলের দল এসেছে প্রণাম করতে। ক্লান্ত মমতা জানিয়ে দিয়েছিলেন, আজ আর নয়। ছেলের দল বাইরে দাঁড়িয়ে প্রায় বিলাপের মতো বলতে লাগল, ‘আমাদের ভগবানকে এক বার না দেখেই চলে যাব?’ মনে আছে, বারান্দার গ্রিল থেকে মুখ বাড়িয়ে এক ঝলক দেখা করেছিলেন মমতা। উল্লাসে আকাশ ফাটিয়েছিল ছেলেরা। আর ঘরে ফিরে মমতা প্রায় স্বগতোক্তির মতো বলে উঠেছিলেন, ‘‘ওরা বুঝতে পারছে না, আজকের এই জয় কিছুই নয়। লড়াই মোটে শুরু হল। অনেক দূর যেতে হবে আমাদের।’’
লড়াই সাফল্যের শীর্ষ ছোঁয় ২০১১-য়। এ বার আরও খানিকটা উপরে ওঠা। তাঁর অবিসংবাদী নেতৃত্ব নিয়ে আজ পর্যন্ত প্রশ্ন ওঠেনি। মমতার চলার পথে, বাড়ির সামনে, গাড়ির চাকার সঙ্গে জনতার ভিড়ও ক্রমবর্ধমান। তাঁর গায়ে ছুড়ে দেওয়া ফুলের পাপড়ি পরম ভক্তিতে পথ থেকে কুড়িয়ে আঁচলে বাঁধেন গাঁয়ের বৌ-মেয়েরা। কোলের সন্তানের মাথায় তাঁর আশীর্বাদের হাত ছোঁয়াতে হুড়োহুড়ি পড়ে। এ সব উন্মাদনা রাজনীতির চশমায় ধরা পড়ে না। নেত্রী ও ব্যক্তি দুই মমতা সেখানে একাকার।
তিনি আজ ‘একেশ্বরী’।