দূরত্ব ভুলে। জোট-প্রার্থী মানিক ভৌমিকের প্রচারে পাশাপাশি বিমান বসু এবং অধীর চৌধুরী। পূর্ব মেদিনীপুরের ময়নায়। —নিজস্ব চিত্র।
আশায় ছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু জল ঢালার জন্য বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, গৌতম দেব, ওমপ্রকাশ মিশ্রেরা আছেন!
দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সবুজ সঙ্কেত আদায় করে সিপিএম শেষ পর্যন্ত এ রাজ্যে কংগ্রেসের সঙ্গে সমঝোতা চূড়ান্ত করার পরে তৃণমূল নেতৃত্ব প্রশ্ন তুলেছিলেন, নেতারা জোট করলেই হবে? আদর্শগত দূরত্ব মিটিয়ে দু’দলের ভোট পরস্পরের বাক্সে জমা হবে কী করে? মমতা দাবি করছিলেন, জোট-বিক্ষুব্ধ বাম ও কংগ্রেস সমর্থকদের ভোট তাঁর দিকেই আসবে। এমনকী, রাহুল গাঁধীর সভায় সিপিএম বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরেও বিশ্বাস করতে চাননি শাসক দলের নেতাদের একাংশ! প্রশ্ন তুলেছিলেন, এত সাহস হবে?
পার্ক সার্কাস ময়দানে রাহুলের হাত ধরে দাঁড়িয়ে একটা জবাব ইতিমধ্যেই দিয়ে দিয়েছেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী। আর একটা জবাবও কলকাতায় দ্বিতীয় দফার ভোটের দিন দিয়ে দেবেন! রাহুলের সভামঞ্চেই বুদ্ধবাবুকে প্রণাম করে আশীর্বাদ চেয়েছিলেন বালিগঞ্জের কংগ্রেস প্রার্থী কৃষ্ণা দেবনাথ। বুদ্ধবাবু তাঁদের বলেছেন, ‘‘জীবনে প্রথম কংগ্রেসকে ভোট দেব! যাব ভোট দিতে।’’
হয়তো এই প্রথম! প্রথম বলেই হয়তো মৃদু একটা অস্বস্তি ভিতরে কোথাও থাকছে। তবু তৃণমূলকে হারাতে নিজেদের দীর্ঘলালিত প্রতীক-প্রেম সাময়িক ভুলে কংগ্রেস প্রার্থীদের ভোট দিচ্ছেন বুদ্ধবাবু, গৌতমবাবু, মহম্মদ সেলিম, বিমান বসু, রবীন দেবেরা। একই ভাবে আবার জাতীয়তাবাদী আদর্শের পিছু টান নামিয়ে রেখে কমিউনিস্ট পার্টির প্রতীকের পাশে বোতাম টিপছেন শহরে কংগ্রেসের ওমপ্রকাশ বা জেলায় জগন্নাথ গোস্বামী, স্বপন দুবেরা। বিজেপি নেতা সিদ্ধার্থনাথ সিংহ প্রশ্ন তুলতে পারেন, রাহুলের হাত ধরার সময়ে বুদ্ধবাবুর কি কিছু মনে পড়েনি? কিন্তু বুদ্ধবাবু এ সব নিয়ে ভাবিতই নন! প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর সাফ যুক্তি, ‘দুর্বৃত্তদের সরকারে’র হাত থেকে রাজ্যটাকে মুক্ত করতে হবে। তাই এক জায়গায় আসা।
সিপিএমের এক শীর্ষ নেতার মতে, ‘‘দলের বৈঠকে কিছু কিছু জিনিস আলোচনা হয় বটে। কিন্তু এখন যারা পার্টি করতে আসে, ঔপনিবেশিকতা বা সাম্রাজ্যবাদের তত্ত্ব দিয়ে তাদের আকর্ষণ করা যায় না। আর মার খাওয়ার সময়ে সে সব কথা নিয়ে ভাবার সময় আরও নেই!’’ একই রকম দ্বিধাহীন প্রদেশ কংগ্রেস নেতা ওমপ্রকাশ। ভবানীপুরের প্রার্থী হিসাবে এক বার নাম ঘোষণা হয়েও টিকিট পাননি। কিন্তু তাতে মনোবলে ভাঁটা পড়েনি। যাদবপুরের ভোটার ওমপ্রকাশের বুথে জোট-প্রার্থী হিসাবে নাম থাকবে সিপিএমের সুজন চক্রবর্তীর। ওমপ্রকাশ বলছেন, ‘‘আমার দ্বিধা, ধর্মসঙ্কট কিচ্ছু নেই! জানি, কেন এই জোট করতে হয়েছে। সারা রাজ্য ঘুরে সেই কথা প্রচার করেছি। ভোটটাও আমার কেন্দ্রে সিপিএমকে দেব।’’
এ বারের জোট হয়েছে নিচু তলার বাধ্যবাধকতায়। লোকসভা এবং তার পরের কিছু নির্বাচনের অভিজ্ঞতা থেকে বিরোধীরা বুঝে নিয়েছে, ‘হ্যাঁ মমতা’র ভোটকে যদি ‘না মমতা’য় নিয়ে যেতে হয়, তা হলে একজোট হতে হবে। বিরোধী ভোটের বিভাজনের সুযোগ তৃণমূলকে দেওয়া যাবে না। এই ভাবনার সুতোয় এলাকার স্থানীয় বাম ও কংগ্রেস কর্মীর সঙ্গে একই ভাবে বাঁধা পড়েছে আলিমুদ্দিন স্ট্রিট এবং বিধান ভবন। যেখানে সিপিএম প্রার্থী নেই, প্রতীকের মায়া ছেড়ে সেখানে কংগ্রেসকে ভোট দিচ্ছেন বাম সমর্থকেরা। আবার উল্টো হলে একই কাজ করছেন কংগ্রেস সমর্থকেরাও। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্য বলছেন, কর্মীদের কাছে তো দলের সিদ্ধান্তই পার্টি লাইন। সমর্থক কিছু মানুষ হয়তো শেষমেশ কংগ্রেসকে ভোট দেবেন না বা ‘নোটা’য় দেবেন। কিন্তু তাতে ফলাফলে তেমন কোনও প্রভাব পড়বে না।
কিন্তু পুরনো সংস্কারের পিছু টান? ছোট বেলা থেকে জেনে আসা ‘জমিদারের পার্টি’র হাত চিহ্নের পাশে জেনেশুনে বোতাম টিপতে গিয়ে একটু দ্বিধা-জড়তা তো আসবেই! আবার বাম জমানায় সিপিএমের হাতে লাঞ্ছনা-আক্রমণের তিক্ততা ভুলে কাস্তে-হাতুড়ির পাশে আঙুল রাখতেও ঈষৎ কাঁপুনি হওয়া স্বাভাবিক! চৌরঙ্গিতে বিমানবাবু কংগ্রেসের সোমেন মিত্রকে বা বিধাননগরে রবীনবাবু অরুণাভ ঘোষকে ভোট দিতে কি একটুও দ্বিধাগ্রস্ত হননি? তাঁরা বলছেন, জেনেবুঝে জোটের সিদ্ধান্তের পরেও কাজটা করার মুহূর্তে একটু অন্য রকম ভাবনা এসেছিল ঠিকই। কিন্তু যখনই মনে হয়েছে, পুরনো ধ্যানধারণার চেয়েও তৃণমূলের তোলাবাজি বা গণতন্ত্রের উপরে হামলা থেকে মুক্তি এই মুহূর্তে বেশি জরুরি, তখন আর কোথাও কিছু আটকায়নি!
বারাসতের জেলা কার্যালয়ে প্রাক্তন মন্ত্রী কান্তি বিশ্বাসের মরদেহের জন্য অপেক্ষা করতে করতে গৌতমবাবু যেমন বোঝাচ্ছিলেন, সারা দেশের জনসংখ্যার অনুপাতের মতো এ রাজ্যেও ভোটারদের বড় অংশের বয়স চল্লিশের মধ্যে। তাঁদের কাছে সাতের দশকে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের অভিযোগ বা জরুরি অবস্থার বাঁধা বুলির তেমন প্রভাব নেই। বরং, তৃণমূলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এই তরুণ প্রজন্মের কাছে অনেক বেশি সহজাত। তাই জোটের মধ্যে ভোটের বাক্স-বদলও সহজ। গৌতমবাবুর কথায়, ‘‘কারও শরীরে ইঞ্জেকশন দিয়ে তো ঘৃণা ঢুকিয়ে দেওয়া যায় না! যারা গত চল্লিশ বছর ধরে কংগ্রেসকে এ রাজ্যে বিরোধী দলেই দেখছে, তাদের প্রথমে একটু খচখচ করলেও ভোটটা কংগ্রেস প্রার্থীকে দিতে অসুবিধা নেই। কারণ তারা জানে, ভোটটা হচ্ছে তৃণমূলের বিরুদ্ধে।’’ আবার প্রদেশ কংগ্রেস নেতা মানস ভুঁইয়ার মতে, ‘‘অন্য প্রতীকে ভোট দিতে কংগ্রেস সমর্থকেরা তো অভ্যস্ত! তৃণমূলের সঙ্গে জোট হওয়ায় তাদের ভোট দিতে হয়েছে। এখন সিপিএমকে দিচ্ছি। এটা সমস্যা নয়।’’
হাত আর কাস্তে-হাতুড়ির মধ্যে সমর্থন আদানপ্রদান যত নিষ্কণ্টক হচ্ছে, কাঁটা ততই বাড়ছে জোড়াফুলে!