অরণ্যের অন্দরমহলে
Mamata Banerjee

‘দিদি ভাল, উয়ার এই বেটারা খারাপ’

কেমন আছেন বাসিন্দারা। কোন বাঁকে রাজনীতি। আখ্যান জঙ্গলমহলের

Advertisement

তাপস সিংহ

বান্দোয়ান (পুরুলিয়া) শেষ আপডেট: ০৪ মার্চ ২০২১ ০৬:১৭
Share:

—ফাইল চিত্র।

কেমন আছেন বাসিন্দারা। কোন বাঁকে রাজনীতি। আখ্যান জঙ্গলমহলের

Advertisement

সাতগুরুমের জলে আজ একটুও মাতলামি নেই!

Advertisement

এর আগে শেষ বার যে সময়ে এসেছিলাম, তখন সে অভ্যর্থনা জানিয়েছিল কিশোরীর উচ্ছ্বাসে। আর আজ, ফাগুন মাসের মাঝামাঝি সে জলে যেন মাতলামির থিতিয়ে যাওয়া গভীরতা। ডাকছে ও পারের লুকাপানি গ্রাম। এখন আর হড়পা বানের পরে সাতগুরুমের পাগলপারা জল পায়ে হেঁটে পার হতে হয় না। ২০১২-’১৩-য় সেতু হয়েছে সাতগুরুমের উপর।

পুরুলিয়ার জঙ্গলমহলের একপ্রান্তে বান্দোয়ানের এই দুয়ারসিনি। পাশে বাড়ন্ত বয়সের উদ্ধত তরুণের মতো মাথা তুলে দাঁড়িয়ে দলমা রেঞ্জ। পলাশের ডাক শোনার মরসুম এখন। দলমার কোলে তাই রক্ত-পলাশের সদ্য আগমন!

এ হেন ক্যানভাসে গণতন্ত্রের পরীক্ষার সময়সারণি প্রকাশিত। লুকাপানির পাহাড়গোড়া পাড়ায় দেখা হয় ঠাকুরদাস সিংয়ের সঙ্গে। বলেন, ‘‘পৌষমাসে গ্রামে হাতিঠাকুর বেশি আসে গো। ওদের সামলাতে হয়। তবে গ্রামে এখন বিজলি এসেছে বলে ভয় কম লাগে।’’ গ্রামের বেশির ভাগ মানুষই ‘স্বাস্থ্যসাথী’ কার্ড পেয়েছেন। গ্রামের প্রবীণা রমণী সিংয়ের স্বামী মঙ্গল বার্ধক্য ভাতাও পাচ্ছেন। তবে, ‘বাংলা আবাস যোজনা’য় ঘর তোলার ক্ষেত্রে সমস্যায় পড়েছেন গ্রামের জ্যোৎস্না সিং। প্রথম দফার টাকায় কাজ কিছুটা হলেও পরের দফার টাকা আর আসেনি। স্থানীয় তৃণমূল নেতাদের একাংশের বিরুদ্ধে গ্রামের মানুষজনের অভিযোগ, তাঁদের ‘খুশি’ করতে না পারলে কোনও কাজ হওয়া মুশকিল। গ্রামের এক প্রবীণ বললেন, ‘‘ওদের তেলের পয়সা তো দিই আমাদের কাজ করে দেয় বলে। আর কোথা থেকে পাব?’’ আর এক জনের মন্তব্য: ‘‘দিদি খুব ভাল বটে, কিন্তু উয়ার এই বেটারা খারাপ!’’

বস্তুত, এই চোরাগোপ্তা অভিযোগ শোনা যায় জঙ্গলমহলের নানা প্রান্তে। যেমন, একেবারে ওড়িশা সীমানা লাগোয়া নয়াগ্রামের চুনখুলিয়া অঞ্চল। দু’হাত দূরেই ওড়িশার সর্দারবাঁধ পঞ্চায়েতের জলেশ্বর বাঁধ অঞ্চল। চুনখুলিয়ার কয়েক জন বললেন, বাংলা আবাস যোজনা-য় বাড়ি করার জন্য শাসক দলের এক শ্রেণির নেতাকে টাকা দিতে হয়েছে।

এ রকম হলে তাঁরা অভিযোগ জানাননি কেন? তাঁদেরই এক জনের কথায়: ‘‘থাকতে হবে তো এখানে! অভিযোগ করব এক দিন, কিন্তু বাকি দিনগুলোয়? তবে দিদি যখন বলেছিলেন, কাটমানি নেওয়া বন্ধ করতে হবে, তার পর থেকে একটু কম হচ্ছে। কিন্তু একেবারে থামেনি।’’

আবার বাঁশপাহাড়ি থেকে প্রায় ৬ কিলোমিটার দূরের ঢেকিয়া গ্রামের সুভাষ মুড়া, সনাতন মুড়ারা শোনাচ্ছিলেন অকথিত অনুন্নয়নের কাহিনি। প্রায় দেড়শো ঘরের এই গ্রামের উপর পাড়া, নীচ পাড়া, জোড় পাড়া, মাঝ পাড়া, শবর পাড়ার মানুষজন শোনাচ্ছিলেন পানীয় জলের অভাবের কথা। গ্রামের পাতকুয়ো তিন প্রজন্ম আগের। জুনিয়র হাইস্কুলে যে চারটি নলকূপ আছে তার মধ্যে দু’টিই খারাপ। স্থানীয় যমুনা নদীর ভাদুঘাটের নিচু কালভার্ট বর্ষায় ডুবে যায়। যাতায়াত দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। ওখানে সেতু চান গ্রামবাসীরা। বাংলা আবাস যোজনায় বাড়ি করার সময় টাকা চাওয়ার অভিযোগ এখানেও শোনা যায়।

ঝাড়গ্রাম, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া জুড়ে ছড়িয়ে থাকা জঙ্গলমহল ঘুরলে শোনা যায় বেকারত্বের কথাও। বস্তুত, কাজের দাবিতে গলা মেলানোর সংখ্যা এখন বেড়ে চলেছে জঙ্গলমহলে। ১৮ থেকে ৩০ বছর বয়সিরা এখন তাঁদের ক্ষোভের কথা উগরে দেন বহিরাগতের কাছেও।

ভোটের বাক্সে কি এই ক্ষোভ প্রতিফলিত হবে?

পুরুলিয়া তৃণমূলের চেয়ারম্যান, রাজ্যের মন্ত্রী শান্তিরাম মাহাতো অবশ্য তা মনে করেন না। পুরুলিয়া শহরের রাঁচী রোডে দলীয় কার্যালয়ে বসে শান্তিবাবু বলেন, ‘‘কর্মসংস্থান নিয়ে আমাদের প্রশ্নের মুখে পড়তে হচ্ছে, এটা ঠিক। কিন্তু এই সমস্যা কোথায় নেই? মানুষ তা বোঝেন।’’ বিভিন্ন গ্রামে সরকারি প্রকল্প রূপায়ণে ‘কাটমানি’র যে অভিযোগ উঠছে সে প্রসঙ্গে পশ্চিমাঞ্চল উন্নয়ন পর্ষদের মন্ত্রী শান্তিরামবাবু বলেন, ‘‘এটা এখন অনেক কম। ছোটখাটো এ রকম অভিযোগ এলে সে ক্ষেত্রে ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে।’’

২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের নিরিখে বিজেপির কাছে এ ভাবে পিছিয়ে পড়ার পরে এখন কিছুটা কি সামলানো গিয়েছে? শান্তিরামবাবুর কথায়: ‘‘অনেকটাই। এখন মানুষ প্রকৃত সত্য বুঝেছেন। সামাজিক নানা প্রকল্পের সুবিধা পাচ্ছেন। এ ব্যাপারে কিন্তু কোনও স্বজনপোষণ হয়নি।’’

জঙ্গলমহল ঘুরলে আরও একটি বিষয় খুব স্পষ্ট হয়ে যায়। তা হল, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। অতীতে যে জঙ্গলমহলে বারে বারে এসেছি, তার সঙ্গে এই জঙ্গলমহলের বিস্তর অমিল। রাতবিরেতে এখন অবাধে যে কোনও জায়গায় চলে যেতে পারেন মানুষ। আগে জঙ্গলমহলের যে যে জায়গায় চুরি-ছিনতাইয়ের অভিযোগ উঠত, সন্ধ্যার পরে যে সব জায়গার উপর দিয়ে কোনও গাড়িচালক যেতে চাইতেন না, এমনকি অ্যাম্বুল্যান্স পর্যন্ত পাওয়া যেত না, সেই সব জায়গায় এখন নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়াতে পারেন স্থানীয় মানুষ ও পর্যটকেরা। মাওবাদীদের নানা হিংসাত্মক কার্যকলাপও অনেক দিনই বন্ধ হয়ে গিয়েছে।

বস্তুত, শীত চলে গেলেও জঙ্গলমহলের নানা পর্যটন কেন্দ্রে এখনও ভ্রমণার্থীর ঢল। জায়গা পাওয়াই দুষ্কর।

অশান্তির আবহ থেকে মুক্ত হয়ে ওঠা জঙ্গলমহলে এটা অবশ্যই একটা প্রাপ্তি। তবে জঙ্গলের অন্তর-মহলে আর কোনও চাওয়া-পাওয়ার হিসেব চলছে কি না, সেটাই এখন কোটি টাকার প্রশ্ন!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন