সংগঠন গৌণ। ভোট জেতাতে হাতিয়ার এখন আইটি শাখা। কোনটা সত্যি, কোনটা মিথ্যা— বিচার করবে কে?
Mental Condition

মন-মেজাজ কেমন? হিসেব ভোট কারবারে

বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের আইটি শাখার কর্মীরাই সংগঠিত ভাবে এই মন-পণ্যের কারবার করে চলেছেন বলে অভিযোগ।

Advertisement

নীলোৎপল বিশ্বাস

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৪ মার্চ ২০২১ ০৬:২৩
Share:

ফাইল চিত্র।

আপনার বিবেক কতটা জাগ্রত? কতটাই বা সহমর্মী? প্রায়ই কি উদ্বেগে ভোগেন? সহজেই বিচলিত হন? সমাজমাধ্যমে আপনার উপস্থিতির তুল্যমূল্য বিচার করে এই সব প্রশ্নেরই উত্তর খোঁজা হচ্ছে গত কয়েক দিন ধরে। যন্ত্র-মেধার হাত ধরে পাওয়া ফলের ভিত্তিতেই এর পরে তৈরি হচ্ছে, আপনার চারিত্রিক বৈশিষ্টের ছবি। এই মুহূর্তে ভোটবঙ্গে যে কোনও ব্যক্তির মন-মেজাজের এই ছবিই অন্যতম পণ্য!

Advertisement

বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের আইটি শাখার কর্মীরাই সংগঠিত ভাবে এই মন-পণ্যের কারবার করে চলেছেন বলে অভিযোগ। তাঁদের দাবি, কোনও ব্যক্তির সমাজমাধ্যম অ্যাকাউন্টের ১০টি ‘লাইক’ বিচার করে তাঁকে তাঁর প্রতিবেশীর মতো জানা যায়। দেড়শো থেকে দুশো লাইক ধরলে তাঁকে তাঁর পরিবারের সদস্যদের থেকেও বেশি চেনা হয়ে যায়। তিনশো থেকে চারশো লাইকের পর্যালোচনা করতে পারলে ওই ব্যক্তিকে নাকি এতটাই চেনা যায় যে, হার মানবেন তাঁর জীবনসঙ্গীও। এর পরেই শুরু হয় তাঁর বিচলিত হওয়ার বিষয় নিয়ে বা উদ্বেগ ধরে ঘা দেওয়ার কাজ। দোলাচলে রয়েছেন এমন ভোটারদেরও এ ভাবে সহজে দলে টানা যায় বলে জানাচ্ছেন তাঁরা। জানা যায় তাঁদের ভৌগোলিক অবস্থানও।

সমাজমাধ্যমে বলা ‘মনের কথা’ই পণ্য হিসেবে ‘বিক্রি’ হয়ে যাওয়ার অভিযোগ উঠেছিল একটি মার্কিন নির্বাচনের পরে। সেই প্রথম জানা যায়, সমাজমাধ্যমে নাগরিকদের বিচরণের চিহ্ন রাজনৈতিক ক্ষমতার স্বার্থেও ব্যবহার হতে পারে। প্রবল সমালোচনার মুখে ক্ষমা চাইতে হয় একটি সোশ্যাল মিডিয়া সাইটের স্রষ্টাকে। জানা যায়, একটি ভোটকুশলী সংস্থা সরাসরি গাঁটছড়া বেঁধেছিল তাঁদের সঙ্গে। সমাজমাধ্যমে যে কোনও ব্যক্তির উপস্থিতি পর্যালোচনা করতে তারা এক ধরনের অ্যালগোরিদমের ব্যবহার শুরু করে। যা আদতে একটি যান্ত্রিক গণনা পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে একাধিক বিষয় নিয়ে দ্রুত হিসে ব করে রিপোর্ট দেয় কম্পিউটার। তবে তাকে বলে দিতে হয় কোন বিষয়ে ফলাফল চাওয়া হচ্ছে। ধরা যাক, বিষয় হল মহিলাদের নিরাপত্তা। কম্পিউটারকে এ ক্ষেত্রে বলে দিতে হয় মহিলাদের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিতদের ক্ষেত্রে নম্বর ১০০। আর এ নিয়ে উদাসীনদের নম্বর শূন্য। সমাজমাধ্যমে যান্ত্রিক গণনা পদ্ধতি ব্যবহারকারীদের ভাব বিনিময় থেকে দ্রুত তৈরি করবে চারিত্রিক বৈশিষ্টের ‘প্রোফাইল’। জানিয়ে দেবে, মহিলাদের নিরাপত্তা সংক্রান্ত প্রচার কোন প্রোফাইলের কাছে বেশি সাফল্য পেতে পারে। এর পরে দিনভর নানা ভাবে মহিলাদের নিরাপত্তা সংক্রান্ত ‘সুস্পষ্ট দলীয় মন্তব্য’ই নিজস্ব সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্টে দেখতে পাবেন ওই প্রোফাইলের ব্যবহারকারীরা।

Advertisement

একটি রাজনৈতিক দলের আইটি শাখার কর্মী বলেন, ‘‘এখন এই কাজ আরও সহজ। সোশ্যাল মিডিয়া থেকে মোটা টাকায় কেনা প্রোফাইলের তথ্যের পাশাপাশি রয়েছে, একাধিক কম্পিউটার অ্যানালিটিক্স অ্যাপ্লিকেশন। ওই পদ্ধতিতে একাধিক প্রশ্ন রাখা হয় ব্যবহারকারীদের কাছে। প্রথমেই খুঁজে দেখতে বলা হয়েছিল, কোন এলাকার মানুষ হাসপাতাল তৈরির থেকেও মন্দির তৈরির প্রসঙ্গে দ্রুত উত্তর দিচ্ছেন। চাকরি পাওয়ার কথার চেয়েও কোথায় বেশি কাজ করছে জাতের বন্দনা!’’

অন্য একটি দলের আইটি শাখার কর্মী আবার বললেন, ‘‘সোশ্যাল সাইটের যন্ত্র-মেধার জোর কতটা, তা দেখিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। আর ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে ভারতে তা দেখিয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদীর ভোটকুশলীরা। দলীয় চিহ্নের চেয়েও তাই এখন সব ক’টি রাজনৈতিক দলের বড় পুঁজি সমাজমাধ্যম ব্যবহারকারীর মন-মানসিকতা বা প্রবৃত্তির চিহ্ন হাতে চলে আসা।’’ তাঁর ব্যাখ্যা, ‘‘সমাজমাধ্যমের কাজই হল ভাল লাগার বিষয় আরও বেশি তুলে ধরে ‘স্বপ্ন-রাজ্য’ তৈরি করে দেওয়া। এ কারণেই কেউ ঘর সাজানোর ভিডিয়ো দেখলে সোশ্যাল মিডিয়া তাঁর সামনে আরও বেশি সেই সংক্রান্ত ভিডিয়ো সাজিয়ে দেয়। স্বপ্ন-রাজ্যে থাকতে থাকতে ব্যবহারকারীর মনে হয়, তিনি সর্বক্ষণ যেটা দেখছেন সেটাই সত্যি। এর বাইরেও যে জগৎ থাকতে পারে, তা তাঁরা মানতেই চান না।’’ অন্য এক কর্মীর দাবি, ‘‘যে কোনও রাজনৈতিক দলের কাছে এই স্বপ্ন-রাজ্য তৈরির কাজ সহজ হয়ে যায় মোটা টাকায় ‘মনের খবর’ হাতে চলে আসায়। যেমন জেনে গিয়েছি, মানুষের মনে ধরেছে জননেত্রীর পায়ের আঘাত বা রাজনৈতিক সভায় ছড়া কেটে বলা তাঁর মজার বক্তব্য। তেমনই মনে ধরানো হচ্ছে, ‘ভাঙা পায়েই খেলা হবে’ গান এবং ‘জাত গোখরোর লক্ষ্য মানুষের রক্তপান’!

(শেষ)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন