এগারো দিন পার হয়ে গেল। নারদ-কাণ্ডের তদন্তে এক ইঞ্চিও এগোয়নি বিজেপি নেতা লালকৃষ্ণ আডবাণীর নেতৃত্বাধীন লোকসভার নীতি (এথিক্স) কমিটি! এ প্রসঙ্গে রবিবার কমিটির অন্যতম সদস্য বিজু জনতা দলের লোকসভার নেতা ভর্তৃহরি মহতাব বলেন, ‘‘কমিটিতে এ ব্যাপারে কোনও নাড়াচাড়া হয়নি। চেয়ারম্যান নিজে নিজে কী করছেন, জানি না। তবে নারদ-কাণ্ড নিয়ে তদন্তের জন্য কমিটির কোনও বৈঠক ডাকা হয়নি। কোনও নোটিস পাইনি। ফুটেজ চাওয়া হয়েছে বলেও শুনিনি।’’
উত্তরাখণ্ডে কংগ্রেস সরকারের বিধায়ক কেনাবেচা নিয়ে ঘুষ-কাণ্ডের একটি সিডি দু’দিন আগে ফাঁস হয়েছে। তার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সেই সিডি চণ্ডীগড়ে ফরেন্সিক পরীক্ষাগারে পাঠিয়ে তার সত্যতা পরখ করে নিয়েছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। কিন্তু নারদ-কাণ্ড নিয়ে মোদী সরকারের সেই বিদ্যুৎ গতি উধাও! নারদ-কাণ্ড এথিক্স কমিটির কাছে পাঠানোর পর সেই কমিটির তরফে এখনও নারদ নিউজের কর্ণধার ম্যাথু স্যামুয়েলের থেকে ফুটেজ চেয়ে পাঠানো হয়নি। সেটি ফরেন্সিক তদন্তের জন্য পাঠানো তো পরের কথা! কমিটির এমন ভাবগতিক কেন, তা নিয়ে মহতাব অবশ্য কোনও ব্যাখ্যা দেননি। তিনি বিষয়টি আডবাণীর দিকেই ঠেলে দিতে চেয়েছেন। যার জেরে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে, এথিক্স কমিটি মানে কি তদন্তের ঠান্ডা ঘর? আর সেই কারণেই কি নারদ-তদন্ত এথিক্স কমিটিতে যাওয়ায় খুশি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়? গোড়ায় নারদ-কাণ্ড এথিক্স কমিটিতে যাওয়ায় যে দিদি উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন, তিনি কি এ কারণেই রাতারাতি মত বদলে ফেললেন?
নারদ-কাণ্ডের তদন্তের ভার লোকসভার নীতি কমিটির (এথিক্স কমিটির) হাতে তুলে দেওয়ার কথা গত ১৬ মার্চ ঘোষণা করেন স্পিকার সুমিত্রা মহাজন। স্পিকারের সেই ঘোষণার মাঝেই উঠে দাঁড়িয়ে আপত্তি জানিয়েছিলেন তৃণমূল সাংসদ সৌগত রায়। সংসদের বাইরে টিভি ক্যামেরার সামনে তৃণমূল মুখপাত্র ডেরেক ও’ব্রায়েন বলেছিলেন, ‘‘এটা ঠিক হল না। এথিক্স কমিটির কাছে বিষয়টি পাঠানোর আগে তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে কোনও আলোচনা করাই হয়নি।’’ দশ দিন পর বদলে গেছে ছবিটা! শনিবার সাংবাদিক বৈঠক করে লোকসভায় তৃণমূল নেতা সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় দলের তরফে বলেন, ‘‘নারদ তদন্ত এথিক্স কমিটির কাছে পাঠানোর সিদ্ধান্ত আমরা মেনে নিচ্ছি। যা তদন্ত হওয়ার ওখানেই হবে। আমরা কমিটির সঙ্গে সব রকম সহযোগিতা করব।’’ তাঁকে প্রশ্ন করা হয়, ডেরেক যে আপত্তি করেছিলেন? সুদীপের জবাব, ‘‘কে কী বলেছিলেন, জানি না। লোকসভায় আমি তৃণমূলের নেতা। একবার যখন এথিক্স কমিটি গঠন হয়ে গিয়েছে, তখন সংসদীয় গণতন্ত্রে তা মেনে নেওয়াই ভাল।’’
সুদীপের এই মন্তব্যের পরে তাই প্রশ্ন উঠেছে, এথিক্স কমিটি নিয়ে দিদির মতবদল কেন? আর সেই রহস্য সন্ধানে নেমেই জানা গেল, নারদ নিয়ে লোকসভার নীতি কমিটি এখনও এক পা-ও নড়েনি!
তৃণমূলের অবস্থান বদলের কারণ জানতে চাইলে সুদীপবাবুরা সংসদীয় গণতন্ত্রের যুক্তি দিয়ে ভাঙা রেকর্ড বাজাচ্ছেন। কিন্তু সেই যুক্তি হজম হচ্ছে কি রাজনীতির বারান্দায়? বরং বিশ্লেষকদের মতে, আসলে নারদ-তদন্ত এথিক্স কমিটির কাছে যাওয়ায় তৃণমূলেরই সুবিধা হয়েছে। নারদ নিয়ে ফৌজদারি মামলা থেকে শুরু করে সিবিআই— যে কোনও তদন্তের দাবি উঠলে দিদি এখন ওই কমিটিকেই শিখণ্ডীর মতো দাঁড় করাবেন! তা ছাড়া তৃণমূল নেতারা জানেন, এথিক্স কমিটির তদন্ত শুরু হতে হতেই বিধানসভা ভোট পার হয়ে যাবে! তার পরে তদন্ত চালিয়ে কমিটি কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছতে আরও অন্তত বছর দেড়-দুই! তত দিনে লোকসভার ভোটও প্রায় এসে যাবে। বিধানসভা ভোটের মুখে নারদে জেরবার তৃণমূলের কাছে এর থেকে বড় ফায়দা আর কী হতে পারে?
কার্যত সেটাই বলেছেন বিরোধী নেতারা। দিল্লির কংগ্রেস নেতাদের মতে, নারদ-কাণ্ড নাম কে ওয়াস্তে লোকসভার এথিক্স কমিটির কাছে পাঠানো হলেও রাজ্যসভায় এ নিয়ে কোনও হেলদোল দেখা যায়নি সরকারের। রাজ্যসভার তৃণমূল সাংসদ মুকুল রায়ের বিরুদ্ধে নারদ-কাণ্ডে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। সে জন্য রাজ্যসভাতেও নারদ তদন্তের দাবি উঠেছিল। কিন্তু সভার নেতা অরুণ জেটলি মুখ বন্ধ করে তৃণমূলকেই সুবিধা করে দিচ্ছেন বলে অভিযোগ কংগ্রেসের। কংগ্রেস মুখপাত্র ও আইনজীবী অভিষেক মনু সিঙ্ঘভির মতে, ‘‘কেন্দ্র সরকারের উচিত ছিল এ ব্যাপারে সরকারি স্তরে তদন্তের নির্দেশ দেওয়া। কারণ শুধু সাংসদ নন, এক জন আইপিএস অফিসারের বিরুদ্ধেও অভিযোগ রয়েছে। তদন্তের মূল ও প্রধান দায়িত্ব তাই কেন্দ্রের। তা ছাড়া তদন্তের ভার এথিক্স কমিটির কাছে গেলেও সমান্তরাল ফৌজদারি তদন্তে আইনত কোনও বাধা নেই।’’
সিপিএম সাংসদ মহম্মদ সেলিমের কথায়, ‘‘এথিক্স কমিটি নিয়ে দিদির খুশি হওয়াই স্বাভাবিক। মমতা আডবাণীর মানসপুত্রী! আসলে এটাও একটা ম্যাচ ফিক্সিং!’’ তাঁর বক্তব্য, নারদ-কাণ্ডে দুর্নীতির যা বহর, তাতে কেন্দ্র সরকারের নিজে থেকেই তদন্তের নির্দেশ দেওয়া উচিত ছিল। দুর্নীতি দমনে এবং আর্থিক দুর্নীতি রুখতে সরকারের সবক’টি তদন্ত সংস্থার এত দিনে নেমে পড়া উচিত ছিল। তাঁর কটাক্ষ, ‘‘কিন্তু কেন যে এ সব হয়নি, তার জবাব নরেন্দ্র মোদী বুঝিয়ে দিয়েছেন! সবই হচ্ছে, পর্দে কে পিছে!’