লক্ষ্যে অবিচল ‘ফেলুদা’ টোটা রায়চৌধুরী। ছবি: সংগৃহীত।
সামনেই মাঘ মাস। বিয়ের লগনসা। ফেলুদার বিয়ের কথাবার্তা চলছে। পাত্রী কেমন হবে? জানিয়েছেন 'জটায়ু' অনির্বাণ চক্রবর্তী। ‘ফেলু মিত্তির’ টোটা রায়চৌধুরীর পছন্দ কাকে?
প্রশ্ন: ফেলুদা অ্যান্ড কোং কি এ বছর সুন্দরবনে বড়দিনের কেক কাটবেন?
টোটা: (হা হা হাসি), হলে মন্দ হত না।
অনির্বাণ: না, কলকাতাতেই হবে মনে হচ্ছে।
প্রশ্ন: জটায়ু সদ্য একটা বড়সড় দুর্ঘটনা কাটিয়ে উঠলেন। ফেলুদা খবর পেয়েছিলেন?
টোটা: হ্যাঁ, সকাল সকাল খবর পেয়েই ফোন করেছি। আমায় আশ্বাস দিয়ে বলল, চিন্তার কারণ নেই। ঠিক আছি। আমি এই এই পদক্ষেপ করেছি। দেখলাম, এক্কেবারে জটায়ু আর একেনবাবু একাকার হয়ে গিয়ে তীব্র গতিতে পুরোটা সামলে নিয়েছেন।
প্রশ্ন: দুর্ঘটনার পরে নিশ্চয়ই ফেলুদার কথা মনে হচ্ছিল? থাকলে ঠিক বার করে দিতেন, মগনলাল মেঘরাজের কারসাজি কি না...
অনির্বাণ: মগনলাল মেঘরাজ ওই ঘাতক বাস। ঠিক আমার পিছনেই ছিল (হাসি)। না, ঠান্ডা মাথায় সব বিপদ সামলানোর মতো মানুষ ‘জটায়ু’ ওরফে অনির্বাণ চক্রবর্তী। সে সময়ে যা যা পদক্ষেপ করা উচিত সে সবই করেছি। তার সঙ্গে এটাও বলি, ঝড়ের বেগে খবর ছড়াতেই প্রথম ফোন কিন্তু ফেলুবাবু ওরফে টোটাই করেছিল। প্রথম ওর সঙ্গেই কথা বলি।
প্রশ্ন: সব্যসাচী চক্রবর্তী অজস্র বার ‘ফেলুদা’ হয়েছেন। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় মাত্র দু’বার। আপনি ওঁকে ছাপিয়ে গেলেন?
টোটা: সৌমিত্রবাবুর সঙ্গে ‘ছাপিয়ে যাওয়া’ শব্দবন্ধকে দয়া করে এক পঙ্ক্তিতে বসাবেন না। আমি পাঁচ বার ফেলুদা হলেও সৌমিত্রবাবু যে দু’টি ছবিতে অভিনয় করেছিলেন সেগুলি কালজয়ী। প্রত্যেক বাঙালি অভিনেতা স্বপ্ন দেখেন, ফেলুদা হবেন। সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের সৌজন্যে আমার সেই স্বপ্নপূরণ হয়েছে, এই মাত্র।
প্রশ্ন: এখন তো আর সন্তোষ দত্তের সঙ্গে অনির্বাণ চক্রবর্তীর তুলনা হয় না?
অনির্বাণ: এটা কিছুটা হলেও ঠিক। এখন আমায় এই চরিত্রে সিংহভাগ দর্শক মেনে নিয়েছেন। তবে একেবারে যে তুলনা হয় না, তা-ও নয়। সমালোচনাতেও লেখা হয়। আমার মতে, সেটা আমাদের ছোট করে দেখানোর জন্য নয়। কারও মনে হতেই পারে, যিনি যতই ভাল করুন, ‘জটায়ু’ মানেই সন্তোষ দত্ত। আমারও এটাই মনে হয়। তাই রাগ-বিরক্তির কোনও কারণ নেই। তুলনা করতে গিয়েই সন্তোষবাবুর সঙ্গে এই যে এক পঙ্ক্তিতে জায়গা করে নিতে পারছি, এটাই বা কম কী?
সুন্দরবনে শুটিংয়ের মুহূর্তে টিম ফেলুদা। ছবি: সংগৃহীত।
প্রশ্ন: পাঁচ বার ‘ফেলুদা’ সিরিজ়ে অভিনয়ের পর আর কি নতুন করে প্রস্তুতি নিতে হয়?
টোটা: অনির্বাণের কোনও প্রস্তুতিরই প্রয়োজন নেই! ধরুন, আগের মুহূর্তে প্রচণ্ড হাসছিল। পরের মুহূর্তে গম্ভীর হয়ে গিয়ে সিরিয়াস দৃশ্যে অভিনয় করছে। আমিও এক এক সময় ভাবি, কী করে পারে? এটাই অভিনেতা অনির্বাণের ম্যাজিক। আমার ক্ষেত্রে বলব, খুঁটিয়ে চিত্রনাট্য পড়ি। দৃশ্যগুলো পরিচালকের সঙ্গে আলোচনা করে নিই। শট দেওয়ার আগে নিজেকে ঝালিয়ে নিই।
অনির্বাণ: বাজে কথা বলছে। টোটারও কোনও কিচ্ছু প্রয়োজন পড়ে না। অভিনয়ের কথা ছেড়েই দিন। এই যে ফিটনেস দেখছেন, এখনই ওকে যোগাসন করতে বলুন। হাসতে হাসতে করে দেখিয়ে দেবে! ওজন বাড়ানোটাই ওর পক্ষে চাপের (হা হা হাসি।)
প্রশ্ন: এবার দর্শকের পাশাপাশি আপনাদেরও স্বাদবদল? জঙ্গলে যাবেন শুনে তো ট্রেলারে জটায়ুর মুখ চকচক করে উঠেছে...
টোটা: ওটা সাফল্যের জৌলুস। জটায়ুর মুখ এমনিতেই চকচকে। ট্রেলারে অনির্বাণ চক্রবর্তীর সাফল্যের ঝলক ধরা পড়েছে (কথা থামিয়ে দরাজ হাসি)। খেয়াল করে দেখবেন, আমাদের তিন জনের মধ্যে সবচেয়ে সফল লালমোহন গাঙ্গুলি। সব বই হিট। গাড়ি চড়ে ঘোরেন। আমন্ত্রণ ওঁকেই করা হয়। আমরা সঙ্গে যাই মাত্র।
অনির্বাণ: তোমার জৌলুস নেই বলছ?
প্রশ্ন: স্বাদবদলের কী হল?
টোটা: স্বাদ নয়, জায়গাবদল হয়েছে। আর পরিচালক বদলেছেন। সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের জায়গায় কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়। বাকি সব এক।
প্রশ্ন: ‘রয়্যাল বেঙ্গল রহস্য’য় প্রযুক্তির ব্যবহারও কি বেশি? বাঘ, সাপ....
টোটা: সে তো অবশ্যই। বাঘের মুখোমুখি হলে তো...
অনির্বাণ: এই বিষয়ে একটা কথা বলি। আমাদের ইচ্ছে থাকলেও আইনে আটকাবে। এখন বন্যপ্রাণী নিয়ে শুট করা দণ্ডনীয় অপরাধ। ফলে, প্রযুক্তির সাহায্য নিতেই হবে।
প্রশ্ন: যিনি ‘জটায়ু’, তিনিই ‘একেনবাবু’। আপনার চোখে সেরা কে?
টোটা: অনির্বাণের অভিনয়গুণে দুটো চরিত্রই জীবন্ত। দুটো চরিত্রের মধ্যে কিছু সূক্ষ্ম পার্থক্য সৃষ্টি করে। জটায়ু ভীষণ সরল, সাদাসিধে। ওই চরিত্র করার সময় অনির্বাণের মুখচোখ ওই রকমই সরল থাকে। একেনবাবু অসম্ভব বুদ্ধিমান। দেখায় কিছু বোঝে না। ওই মুখ নিয়েই হাসতে হাসতে রহস্যের সমাধান করে। ওই সময় একেনবাবুর মুখচোখ ধারালো হয়ে ওঠে। সেটাই ফুটিয়ে তোলে অনির্বাণ। বড়পর্দায় যত বার ‘একেন’ দেখেছি, তত বার মুগ্ধ। বাহ্যিক দিক থেকে দুটো চরিত্রের অদ্ভুত মিল। কিন্তু ওটুকুই। জাত অভিনেতা অভিনয়গুণে একই চেহারা নিয়ে দুটো চরিত্রের পার্থক্য গড়ে দিয়েছেন।
‘রয়্যাল বেঙ্গল রহস্য’ সিরিজ়ে চিরঞ্জিৎ চক্রবর্তী। ছবি: সংগৃহীত।
প্রশ্ন: অনির্বাণ আর কোন গোয়েন্দা চরিত্রে টোটাকে দেখতে চান?
অনির্বাণ: সত্যি বলব? ওকে ‘ফেলুদা’ ছাড়া আর কোনও গোয়েন্দা চরিত্রে দেখতে চাই না। তাও যদি বলেন, তা হলে বলব ‘ব্যোমকেশ’। টোটাকে এই চরিত্রেও বেশ মানাবে।
প্রশ্ন: ধরুন, ব্যোমকেশের মতো ফেলুদাও প্রেমে। তাঁর বিয়ে। কেমন পাত্রী পছন্দ?
টোটা: আমার?
অনির্বাণ: (থামিয়ে দিয়ে), না, আমি আগে বলব। যার বিয়ে সে পরে বলে। পাশের লোকেরাই ঠিক করে দেয়, সে কাকে বিয়ে করবে। এক যদি না তুমি নিজে নিয়ে আসতে পারো।
টোটা: হা হা হাসি।
অনির্বাণ: ফেলুদার সঙ্গে তোপসে আর জটায়ুর বন্ধুত্ব ভাঙবে না। চাইলে তিনি দলের চতুর্থ সদস্য হতেই পারেন। বিয়ের পর যেন না বলেন, ‘‘ওগো, তুমি শুধুই আমার।’’ আমরা প্রায়ই বেড়াতে যাই। আপনারা দেখেছেন। সেটা যেতে দিতে হবে।
প্রশ্ন: এ বার বলুন, ‘ফেলুদি’ কেমন হবেন?
টোটা: (হেসে ফেলে) দেখুন, ফেলুদা চিরকুমার। তোপসে আর জটায়ুর সঙ্গেই খুশি। তা ছাড়া, ফেলুদা কাজে ব্যস্ত থাকলেও স্বভাব ভবঘুরে। স্বাধীন জীবনযাপনে বিশ্বাসী। তাই সে বাঁধা পড়েনি। তার পরেও যদি বিয়ের মুহূর্ত তৈরিই হয়, তা হলে সে বেছে নেবে শার্লক হোমসের বোন ইনোলা হোমসকে (মৃদু হাসি)।
প্রশ্ন: পুজোর দু’মাস পরেই আবার ‘ফেলুদা’। এত ঘন ঘন আগমনে দর্শক প্রতিক্রিয়া কী হবে?
টোটা: যাঁরা দেখার, তাঁরা দেখবেন। যাঁরা নিন্দে করার, তাঁরা করবেন। তবে এর আগে কিন্তু একসঙ্গে দুটো ‘ব্যোমকেশ’ মুক্তি পেয়েছিল। দুটোই হিট।
অনির্বাণ: হাসি।
প্রশ্ন: ফেলুদার পুরোনো কোন ছবির নতুন সংস্করণে অভিনয় করতে চান?
টোটা: ‘টিনটোরেটোর যিশু’। ২০২৭-এ ছবির ২০ বছর। সবাই ‘ফেলুদা’ বানিয়ে সত্যজিৎ রায়কে শ্রদ্ধা জানান। আমি এই ছবির মাধ্যমে সন্দীপ রায়কে শ্রদ্ধা জানাব। কারণ, এই ছবিই আমার মধ্যে গোয়েন্দা চরিত্রে অভিনয়ের দাবানল জ্বালিয়েছিল। এই ছবি দেখে সৃজিত কথা দিয়েছিল, আমায় ‘ফেলুদা’ বানাবে। সৃজিত কথা রেখেছে।
অনির্বাণ: আমার এরকম কোনও ইচ্ছা নেই।
প্রশ্ন: জটায়ুর কখনও ‘ফেলুদা’ হতে সাধ হয়? কিংবা ‘ফেলুদা’র ‘একেনবাবু’র সহকারী?
টোটা: হ্যাঁ, ইচ্ছা হয়। একটা সময়ের পর আমায় ‘ফেলুদা’ চরিত্রের থেকে সরতেই হবে। সে দিন আমি ‘একেনবাবু’র সহকারী হব। আমার প্রিয় অভিনেতা আর প্রিয় চরিত্র— দু’জনকেই কাছে পাব।
অনির্বাণ: অসম্ভব ব্যাপার। কেউ মানবে না। আমি নিজেই মানতে পারব না। জানেন, ‘একেন’ চরিত্র বোঝানোর সময় আমায় বলা হয়েছিল, জটায়ু ফেলুদা হলে যা হবে সেটাই হতে হবে। কী জটিল ব্যাপার ভাবুন তো!