ছবি: কৌশিক সরকার।
রবিবারের দুপুর। কালো পোশাকের এক দীর্ঘাঙ্গ পুরুষ হেঁটে বেড়াচ্ছেন কলকাতার রাস্তায়। খুঁজে বেড়াচ্ছেন বেগুন দিয়ে ইলিশ মাছের ঝোল আর সেই ভাতের হোটেল, যেখানে পেঁয়াজ বা কাঁচালঙ্কাও ১০ কী ১৫ পয়সা দিয়ে কিনতে হয়েছিল তাঁকে।
বসন্তের কলকাতা তাঁকে মনে করিয়ে দিচ্ছে শম্ভু মিত্র, উৎপল দত্ত, রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্তর নাটকের কথা। কলকাতায় এক সময় শুধু নাটক দেখার টানেই তাঁর বারবার ফিরে আসা। তিনি আদিল হুসেন। সিগারেটের ধোঁয়া রঙের চুল ঠিক করতে করতে বলে বসলেন তাঁর কলকাতার প্রেমিকার কথা। হঠাৎই যে কিছু না বলে অন্য এক পুরুষকে বিয়ে করে ফেলেছিল।
তাঁর হাঁটা বন্ধ হল না। চৌরঙ্গীর দিকে এগোতে এগোতে বললেন, ‘‘ওর সঙ্গে কত হেঁটে বেরিয়েছি কলকাতার অলিগলি। কলকাতার রোল খেতাম আমরা। কী সব দিন ছিল! কলকাতা আসলে ব্যথার, সব দস্যিপনার জায়গা।’’
এ বার ফরাসী ছবির শ্যুটিংয়ের জন্য কলকাতায় এসেছিলেন সেই আদিল।
আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের রেড কার্পেটে কেট ব্ল্যাঞ্চেট-এর সঙ্গে হাঁটার সময় গোয়ালপাড়ার সেই ছেলেটার কথা কি তাঁর কখনও মনে পড়েছিল? প্রশ্নটা করতেই দাঁড়িয়ে পরলেন।
‘‘অতীতের মধ্যে বর্তমানকে খুঁজি আমি। গোয়ালপাড়ায় ক্লাউনের অভিনয় করেই তো আমার অভিনয় জীবনের হাতেখড়ি। নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে, বাবা স্কুলমাস্টার। সকলে ভেবেছিল ইংরেজি পড়াব। তার পর বিয়ে, বাচ্চা। কিন্তু যখন শুনলাম এনএসডি-তে অভিনয় শেখাবে, আবার পয়সাও পাব, মনে হল স্বর্গ পেলাম। এটাই আমার জায়গা,’’ অকপট আদিল। কেউ তাঁকে চেনেন ‘লুটেরা’র ইন্সপেক্টর কে.এন.সিংহ নামে, কেউ ‘লাইফ অব পাই’-এর সন্তোষ পটেল নামে। কেউ বা ‘ইংলিশ ভিংলিশ’-এর শ্রীদেবীর বর সতীশ গডবোলে হিসেবে।
শ্রীদেবীর কথা উঠতেই কেমন একটা শ্রদ্ধায় ভরে গেল আদিলের মুখ। বললেন, ‘‘ও রকম একজন পেশাদার নায়িকা। অথচ আমরা একে অপরকে অভিনয়ের ক্ষেত্রে নানা রকম সাজেশন দিতাম। আমার সঙ্গে অভিনয়ের আগে উনি অন্তত সাড়ে তিনশো ছবি করে ফেলেছেন। অথচ কী পরিমিতি বোধ!’’ শ্রীদেবী আর তব্বুর সঙ্গে অভিনয় করার পরে সকলে নাকি বলত আদিল বলি ডিভা-দের হট হাজব্যান্ডের চরিত্রে দারুণ। তবে ‘কামিনে’র সেটে করিনার হাতে চড়ের প্রসঙ্গ উঠতেই প্রচণ্ড হেসে বললেন, ‘‘উফফ্ সে এক কাণ্ড! করিনার সামনেই বিশাল বলে বসল ও কিন্তু তোমার একটাও ছবি দেখেনি। শুনেই করিনা বলল, সেকী! ‘জব উই মেট’ও না? ‘ওম্কারা’?’’ আমি বলেছিলাম, ‘‘ওখানে তো সইফ আছে, তুমিও ছিলে নাকি?’’ শুনেই করিনা বড় বড় চোখ করে বলল, ‘‘ ও আচ্ছা! এ বার চড়টা মারাই যায়।’’ ১৯৮৩ থেকে ২০১6— মাত্র কুড়িটা হিন্দি ছবি দেখে উঠতে পেরেছেন আদিল। না, এটা তাঁর গর্ব নয়। হলে গিয়ে কোটি টাকা কামানো ছবি ১৫ মিনিটের বেশি দেখতে পারেননি তিনি। তবে মুম্বই ইন্ডাস্ট্রিতে তাঁর অভিনয়ের চাহিদাও আছে। আছে তব্বুর মতো বন্ধুও।.
ফিরলেন ললিতের কফি লাউঞ্জে।
‘‘তব্বু খুব ইন্টারেস্টিং, যেন পাশের বাড়ির মেয়ে। শ্যুট করতে গিয়ে ওর সঙ্গে দারুণ সময় কাটিয়েছি। তবে ওর আরও ভাল চরিত্র পাওয়া উচিত,’’ বলেন আদিল। শ্রীদেবীর মতোই বিদ্যার ন্যাচারাল অ্যাক্টিং, দেখা হলেই এগিয়ে কথা বলার অভ্যেসটা তাঁকে আজও মুগ্ধ করে।
বলিউডের মশালা মুভি না দেখলেও মুম্বইয়ে তাঁর কাজের অভাব কিন্তু হয়নি। মীরা নায়ার (‘দ্য রিলাকটান্ট ফান্ডামেন্টালিস্ট’), ড্যানিস ট্যানোভিক (‘টাইগার্স’), শ্রীরাম রাঘবনস (‘এজেন্ট বিনোদ’) থেকে বিক্রমাদিত্য মোতওয়ানের (‘লুটেরা’) মতো পরিচালকের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা তাঁর অভিনয় জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে। শিক্ষক নাসিরুদ্দিন শাহের কাছ থেকে শিখেছিলেন অভিনয় আর জীবনকে মিশিয়ে দিতে। বললেন, ‘‘আজও ছাত্রদের বলি আগে ভেবে নাও ভালবাসার জন্য অভিনয় করো? নাকি অভিনয়ের পরে যে খ্যাতি আসে, টাকা আসে, সেগুলোর টানে অভিনয় শিখছ? অর্থ আর নাম চাইলে অভিনয় নয়, অন্য পথে যাও।’’
বেশ দেরিতেই, চল্লিশের পরে তাঁর পরিচিতি এসেছে তবুও কোনও আফশোস নেই। আজও তিনি খুঁজে বেড়ান এমন চরিত্র যা শুনলে মনে হয় এই চরিত্রটা তিনি কখনও করতে পারবেন না। আর সেটা মাথায় এলেই চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড় করান নিজেকে। সেই জন্যই এক ট্রান্সজেন্ডার ডাক্তারের চরিত্রে অভিনয় করছেন ফরাসী ছবিতে। ‘‘আমার ভেতরের নারীসত্তাকে বের করে আনতে হবে এই চরিত্রে,’’ বললেন আদিল। ততক্ষণে ললিত-এর কফি লাউঞ্জে এসে গেছে কাপুচিনো আর পছন্দের কুকিজ।
একটা সিগারেট ধরিয়ে বললেন, " দিল্লিতে থাকলেও এইটুকু বুঝি মুম্বইয়ে আর্ট ফিল্ম, কমার্শিয়াল ফিল্ম ভেবে ছবি দেখা হয় না। আর্ট আর কমার্শিয়াল দুই ধারার দর্শকের জন্যই তো তৈরি হয়েছে ‘পান সিংহ তোমর’, ‘বজরঙ্গী ভাইজান’, ‘পিকে’-র মতো ছবি। আর এগুলো সব কটাই সফল।"
নিজে পরিচালনার কথাও এবার ভাবতে শুরু করেছেন। কথা চলছে তাঁর প্রিয় কলকাতায় বাংলা ছবিতে অভিনয় করার।
কফি লাউঞ্জ থেকে আবার নামলেন রাস্তায়। বললেন, ‘‘চলুন হাঁটি। দেখি সেই ভাতের হোটেলটার খোঁজ পাই কিনা। ওই তো আমার টিন এজের হলদে রঙের ট্যাক্সি’’