অনীকদা বা কমলদা কি ডিরেক্টর হিসেবে এত ঠুনকো যে ফিনান্সার এনেছি বলে ওঁরা আমাকে নায়িকা করবেন। ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল
অ্যাপয়েন্টমেন্টের সময় থেকে দশ মিনিট দেরি হয়ে গেছে বলে সল্ট লেক সিটি সেন্টারের ক্যাফেতে হন্তদন্ত হয়ে ঢুকলেন তিনি। আরও রোগা হয়ে গেছেন। নতুন ছবির জন্য ডায়েটিং করছেন বলে দু’সপ্তাহ কোনও খাবারে নুন খাচ্ছেন না। ‘‘আমি জাস্ট গ্রিন টি,’’ বলে শুরু করলেন আড্ডা...
হোয়াটসঅ্যাপে ৫০০ আর ১০০০ টাকা নিয়ে জোকস, ক্রিকেটে বিরাট কোহালির ফর্ম আর লোকসভায় রোজ ঝামেলার পাশাপাশি আরও একটা জিনিস নিয়েও কিন্তু নাড়াচাড়া হচ্ছে কলকাতায়।
কী?
কলকাতা আন্তর্জাতিক ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল’য়ে রাণা-সুদেষ্ণা পরিচালিত এবং আপনার অভিনয় করা ওপেনিং ফিল্ম ‘বেঁচে থাকার গান’য়ের স্ক্রিনিং নিয়ে। নিশ্চয়ই কথাটা আপনার কানে পৌঁছেছে?
হ্যাঁ, শুনেছি। কিন্তু আমি খুব বেশি বুঝতে চাই না। ভাল জিনিস বেশি বুঝতে নেই। শুধু নিজের কাজটা করে যেতে হয়। ২ ডিসেম্বর ছবিটার কমার্শিয়াল রিলিজ। তার পরেই যা বোঝার বুঝব। বক্স অফিসে ভাল চললে আনন্দ করব গোটা টিম মিলে।
আশ্চর্য হয়েছিলেন, যখন ‘বেঁচে থাকার গান’কে ওপেনিং ফিল্ম হিসেবে বাছা হল?
অফকোর্স সারপ্রাইজড হয়েছিলাম। আমাদের ছোট ছবি, সবাই মিলে খুব পরিশ্রম করে তৈরি করেছি। কনসেপ্টটা যখন সুদেষ্ণাদি প্রথম আমাকে শোনায়, আমার দুর্দান্ত লেগেছিল। তারপর আমি আর সুদেষ্ণাদি ঠিক করি পাবলিসিটির সময় দরকার পড়লে বাইরে থেকে ফান্ডিং করে ছবিটার প্রচার ভাল করে করব।
সে কথায় পরে আসছি। শোনা যাচ্ছিল, ওপেনিং ফিল্মের স্ক্রিনিং নিয়ে নাকি পরিচালক সুদেষ্ণা রায়ও কিছু জানতেন না। অনেকে বলছেন, কলকাঠি যা নাড়ার, সেটা পিছন থেকে নাড়িয়েছেন গার্গী রায়চৌধুরী?
একেবারে ভুল ধারণা। ছবিটা একেবারেই মেরিট-য়ে সিলেক্ট হয়েছে। এই প্রথম কিন্তু কোনও বাংলা ছবি দেখানো হল ওপেনিং ফিল্ম হিসেবে। এটা আমার কাছে খুব গর্বের। তা ছাড়া, আমাদের ছবি না হয়ে যদি অন্য কোনও বাংলা ছবি হতো, আমি একই রকম খুশি হতাম।
আর প্রত্যেক বার ফেস্টিভ্যালের ওপেনিং সেরিমনির পর বিশিষ্ট অতিথিরা চলে যান। তার পর খুব কম সংখ্যক মানুষ ছবি দেখেন। তার কারণ হয়তো, এত দিন যে সব ছবি ওপেনিং ফিল্ম হিসেবে দেখানো হতো, সেটার সঙ্গে সাধারণ মানুষ রিলেট করতে পারতেন না। এ বারে কিন্তু শুনলাম প্রায় সাড়ে তিন হাজার লোক বসে দেখেছেন আমাদের ছবি।
এক়ট়ু খটকাই লাগল আপনার কথা শুনে। আপনার একটা সোশ্যাল পরিচয় আছে। ক্ষমতার কাছাকাছি আপনার যাতায়াত রয়েছে। তৃণমূলের আগের সরকারের শীর্ষ নেতারা আপনাদের পারিবারিক বন্ধু। তা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে কোনও দিন বাংলা ছবি দেখানোর প্রস্তাব দেননি?
ওই যে বললাম, আমি শোনার পক্ষপাতী, বলার নই। আর কিছু কিছু সময় শুধু শুনতে হয়, বলতে নেই। যাঁরা বোঝার তাঁরা বুঝে যাবেন আমি কী বলতে চাইছি (হাসি)।
এ তো গেল ‘বেঁচে থাকার গান’। আপনাকে নিয়ে কয়েকটা প্রশ্ন আছে।
বলুন বলুন...
একটা সময় ছিল, যখন গার্গী মানেই জামদানি শাড়ি, লাল টিপ.. সে সময় পার্টিতেও কারও সঙ্গে বিশেষ কথাটথাও বলতেন না।
কারেক্ট...
তার পর হঠাৎ ২০১২র মাঝামাঝি দেখা গেল আপনি শাড়ি ছেড়ে ওয়েস্টার্ন ড্রেসে পার্টিতে যাচ্ছেন। সবার সঙ্গে কথা বলছেন। এই ট্রান্সফর্মেশনটা কেন করলেন, এবং এটা করতে কতটা অসুবিধা হয়েছিল?
খুব প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন। দেখুন, আমি ছোট পর্দায় কাজ করতাম। ছোট পর্দা ছিল আমার কাছে নিশ্চিন্ত একটা আশ্রয়। ওখানে হয়তো কায়িক পরিশ্রম অনেক করতে হতো, কিন্তু অভিনয়ের দিক থেকে কোনও চ্যালেঞ্জ ছিল না।
ছোট পর্দায় তো আপনার বিরাট নামও ছিল...
থ্যাঙ্ক ইউ। সেটা আপনারা বলবেন। সে সময় সিরিয়াল ছাড়াও টেলিফিল্ম করেছি প্রচুর। সেই কাজগুলোর একটা নিজস্ব গ্রামার ছিল।
কী রকম গ্রামার? অভিনয়ের?
অভিনয়ের তো বটেই। সঙ্গে চেহারারও একটা গ্রামার ছিল। গার্গী মানেই একটা সাবেকিয়ানা, গোলপানা মুখ।
‘বেঁচে থাকার গান’ ছবিতে পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায় ও গার্গী
এটা করতে করতে ‘বোর’ হননি?
অবশ্যই বোর হয়ে গিয়েছিলাম। ২০০৯-য়ে বিয়ের পর আর তাই ছোট পর্দায় কাজ করিনি।
আপনার বিয়ে নিয়েও চর্চা হয়েছিল চারিদিকে। মিডিয়াতে, বিনোদন জগতে?
হ্যাঁ, হয়েছিল। আমি যাঁকে বিয়ে করেছিলাম তিনি আমার থেকে অনেক বেশি চর্চার মধ্যে ছিলেন। তবে দুনিয়া বড় অদ্ভুত। তখন অনেকেই নানা
কথা বলেছিল। তারাই দেখি আজকে আমার সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলে। বেশ মজাই লাগে। কী বলছিলাম যেন...
বোর হয়ে গিয়েছিলেন টিভি করতে করতে...
হ্যাঁ, ছেড়ে দিলাম ছোট পর্দা। তত দিনে নিউ এজ বাংলা ছবি শুরু হয়ে গেছে...
এটা ওই ‘অনুরণন’, ‘বং কানেকশন’য়ের পরের সময়টা?
কারেক্ট। ওই ছবিগুলো দেখে আমার মনে হতে থাকল, এই ছবিগুলোর মনন, অভিনয়ের প্যাটার্নের সঙ্গে আমি আইডেন্টিফাই করতে পারছি। তার পর নিজেকে বদলালাম।
‘বুনো হাঁস’ করলাম। ‘বুনো হাঁস’ কিন্তু আমি ‘রামধনু’র আগে করেছি। অনেকেই জিজ্ঞেস করেছিলেন, হোয়াই ‘বুনো হাঁস’? আমি বলেছিলাম, হোয়াই নট। গাড়ি চালানো শিখতে গেলে যেমন সেকেন্ড হ্যান্ড গাড়িতে হাত পাকা করতে হয়, এটা ছিল...
‘বুনো হাঁস’, সেকেন্ড হ্যান্ড গাড়ি...
(হাসি) এটা ভুলভাল খেললাম আর আপনিও সঙ্গে সঙ্গে ধরলেন। সেকেন্ড হ্যান্ড গাড়ি মানে বোঝাতে চেয়েছি, ওটা ছিল আমার শেখার জায়গা। ওই ছবিটা আমার এত দিনকার ইমেজের থেকে একেবারে আলাদা ছিল। সেটার জন্য আমি সব সময় টোনিদার কাছে কৃতজ্ঞ থাকব। ওই ছবিটার পর থেকেই আমার প্রতি ধারণাটা ইন্ডাস্ট্রির বদলাতে লাগল। ‘রামধনু’ করলাম। ‘খাদ’ করলাম। ‘হেমন্ত’ করলাম।
‘পারসেপশন’টা বদলালো…
ইয়েস। লাল টিপটা তো আমার ইউএসপি ছিলই, লোকে বুঝল অন্য পোশাকেও আমি সাবলীল (হাসি)।
একটা সময় শুনেছিলাম, শনিবারের ‘পত্রিকা’র ফোটোশ্যুটে কতটা হাত দেখাবেন সেটা নিয়েও আপনার ছুঁতমার্গ ছিল। সেখান থেকে এই চেঞ্জটা তো মানসিকতারও বদল।
হ্যাঁ, মানসিক চেঞ্জ তো ছিলই। এই যুদ্ধটা আমি অনেক দিন ভিতরে ভিতরে করছিলাম। এটাতে আমার হাজব্যান্ডের অনেকটাই অবদান আছে। উনি আমাকে বুঝিয়েছিলেন এই নিউ এজ সিনেমার জন্য আমাকে চেহারা বদলাতে হবে। কাউকে বলিনি কথাটা, আমাকে একটা স্মল ফিট জামা দিয়ে বলা হয়েছিল, এটায় যেন আমি নিজেকে ফিট করাই (হাসি)।
ফিট তো করেই ফেলেছেন নিজেকে। কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের পরের ছবিতে আপনি। অনীক দত্তর ছবিও করছেন।
হ্যাঁ, কমলদার ‘মুখোমুখি’ ছবিটা করছি। অনীক দত্তর ‘মেঘনাদ বধ রহস্য’টাও। দু’টোই খুব ভাল চরিত্র।
একটা জিনিস পরিষ্কার করুন, এই যে সেকেন্ড ইনিংসে এতটা তেড়েফুঁড়ে নেমেছেন, এখানে আপনার কম্পিটিটর কে? ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত নাকি শ্রাবন্তী, নুসরত?
আমার কম্পিটিটর আমি নিজে...
এ রকম ক্লিশে উত্তর আশির দশকের নায়িকারা দিতেন।
না, সত্যি। আমি বিশ্বাস করি ঋতুর একটা ঘরানা রয়েছে, যেটা কেউ নিতে পারবে না। তেমনই শ্রাবন্তীরও আলাদা স্টাইল রয়েছে। নুসরতের সাবেকিয়ানা আর গ্ল্যামার মিশিয়ে একটা ঘরানা রয়েছে। আমারও একটা ঘরানা আছে। তাই কেউ কারও ঘরানা বা ভাগ্য কেড়ে নিতে পারে না।
আচ্ছা, আপনার কখনও মনে হয়, জীবনের অনেকটা সময় আপনি খারাপ সম্পর্কের জন্য নষ্ট করেছেন? না করলে হয়তো অভিনেত্রী ও স্টার হিসেবে আরও ওপরে থাকতে পারতেন...
মনে হয় না। আমার কোনও রিগ্রেটস নেই। আমি জানি, যখন যেটা হওয়ার সেটাই হবে। আমি পিছনে ফিরে তাকাই না। এবং সত্যি তো, সম্পর্কের ক্ষেত্রে যা হয়েছে তা তো ভালর জন্যই হয়েছে। আমি নেগেটিভিটির থেকে অনেক দূরে চলে গিয়েছি। আমি সময়ে বিশ্বাস করি। আপনি জানেন, আমাকে প্রভাত রায় এক সময় ‘শ্বেতপাথরের থালা’ অফার করেছিলেন?
জানি না একদমই। কোন রোলটা? ঋতুপর্ণার?
হ্যাঁ, ঋতুপর্ণার রোলটা। কিন্তু আমি তখন ন্যাশনাল স্কলারশিপ দেব বলে ছবিটা করিনি।
এটা তো দারুণ ট্রিভিয়া।
(হাসি) হ্যাঁ, খুব কম লোকে জানে।
আচ্ছা, আজকাল আপনার এই অনীক কী কমলেশ্বরের ছবি করা নিয়ে একটা কথা চালু হয়েছে ইন্ডাস্ট্রিতে। লোকে বলছে, আপনি নিজে ফিনান্সার নিয়ে আসেন। তারা টাকা ঢালে। তাই এই ছবিগুলোতে আপনি নায়িকা।
আপনার কি মনে হয়, অনীকদা বা কমলদা ডিরেক্টর হিসেবে এত ঠুনকো যে ফিনান্সার এনেছি বলে ওঁরা আমাকে নায়িকা করবেন?
আমি প্রোডিউসর আনছি কী আনছি না, এই প্রশ্নের উত্তর ভবিষ্যৎ দেবে। আমি সেটা নিয়ে এখন আলোচনাও করতে রাজি নই। তবে যদি ফিনান্সার আনিও, আমি তো তার থেকে কমিশন খাওয়ার জন্য আনছি না। আনছি, যাতে ভাল বাংলা ছবি হয়। সেটার জন্য আমি প্রাউড। কোনও ন্যাকামো বা ভণিতা ছাড়াই কথাটা বললাম।
এ রকম কথাবার্তা কানে এলে খারাপ লাগে?
আমি তো বহু দিন ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করেছি। এ সব ‘লুজ টক’ আজ আর আমাকে একটুও অ্যাফেক্ট করে না। আগে করত। আমার হাজব্যান্ডের একটা কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করি, ‘‘কথা কম বলো, তা হলে বেটার কাজ করবে।’’ ব্যস (হাসি)।
এত প্রথম শ্রেণির পরিচালকের সঙ্গে কাজ করলেন। সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে কাজ করছেন না কেন?
সেটা প্লিজ আপনি সৃজিতকে জিজ্ঞেস করুন। (হাসি) কাউকে ভালবাসলে যেমন ‘আই লাভ ইউ’ বলতে হয়, তেমনই কারও সঙ্গে কাজ করতে গেলে তাকেও সেটা সেই ভাবে জানাতে হয়।
মানে, সৃজিতকে এখনও সে ভাবে ‘আই লাভ ইউ’ বলা হয়নি?
(হাসি) সৃজিতের পরিচালনার আমি বড় ফ্যান। নিশ্চয়ই ওর ছবিতে যদি কোনও রোল থাকে আমার জন্য, আমি শিওর ও আমাকে কাস্ট করবে।
শেষ দু’টো প্রশ্ন। একটা ভাল। একটা খারাপ।
ভালটাই প্রথমে করুন (হাসি)।
ভালটা হচ্ছে, আপনি কি জানেন মেনস্ট্রিম ছবির নায়ক থেকে অন্য ধারার ছবির নায়ক — গার্গী রায়চৌধুরী সম্পর্কে সবার প্রবল কৌতূহল…
(হাসি) বলছেন? মেয়ে হিসেবে তো শুনতে ভালই লাগছে। তবে এটা জানতাম না আমি।
একদম মিথ্যে বলছেন আপনি।
(হাসি) না, না, সত্যি। কথায় আছে, শাড়ি হল বারো হাতের রহস্য। আমাকে নিয়ে একটু রহস্য থাকাই ভাল তো, এতে অ্যাপিলটা বাড়ে …
এ তো গেল ভাল প্রশ্ন। খারাপ প্রশ্ন হল, আপনার ব্যাপারে বলা হয়, আপনি এখন পৌনে ছ’টার রোদ্দুর।
মানে?
মানে সূর্য ডোবার আগে যে রোদ্দুরটায় একটা বিশেষ ঝলকানি থাকে...
শুনুন শুনুন। ওটাকে কী বলে জানেন তো? কনে দেখা আলো। আমি এখন তাই। আর ওই কনে দেখার আলোতে শ্যুটিং করার জন্য ফোটোগ্রাফার থেকে ডিরেক্টররা পাগল হয়ে যায়। বুঝলেন... (হাসি)।