বর্তমানে দু’টি ধারাবাহিকে অভিনয় করছেন আভেরী। ছবি: সংগৃহীত।
মঞ্চ থেকে অভিনয়ের সফর শুরু। ছোট পর্দার চেনা মুখ তিনি। বর্তমানে ‘ফুলকি’ ও ‘তেঁতুলপাতা’ দু’টি ধারাবাহিকে একসঙ্গে অভিনয় করছেন। তার সঙ্গে বড় প্রাপ্তি নন্দিতা রায়-শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের ‘আমার বস্’-এ কাজ। কেমন কাটছে ব্যস্ততার দিন, আনন্দবাজার ডট কমের সঙ্গে ভাগ করে নিলেন আভেরী সিংহ রায়।
প্রশ্ন: নন্দিতা রায়-শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের ছবিতে অভিনয়। তার সঙ্গে দু’টি ধারাবাহিকে একসঙ্গে কাজ। এখন নিশ্চয়ই সপ্তম স্বর্গে অবস্থান করছেন?
আভেরী: কাজের প্রবল চাপ চলছে। তাই আলাদা করে নিজের অনুভূতিগুলোই বুঝে উঠতে পারছি না। নন্দিতা রায়-শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের ছবিতে কাজ করা তো বিরাট প্রাপ্তি বটেই। আমার চেয়েও আমার মা এই স্বপ্ন বেশি দেখেছেন। ওঁদের পরিচালনায় মা প্রথম ‘ইচ্ছে’ ছবি দেখেছিলেন। সেই ছবি দেখেই মায়ের স্বপ্ন ছিল, ওঁদের ছবিতে এক দিন মেয়েও কাজ করবে। পাশাপাশি দুটো ধারাবাহিকে দু’রকমের চরিত্রে অভিনয় করছি। সব মিলিয়ে ভালই লাগছে।
প্রশ্ন: ‘আমার বস্’ ছবিতে কাজের সুযোগটা এল কী ভাবে?
আভেরী: প্রযোজনা সংস্থার তরফ থেকে একদিন আমাকে ফোন করা হয়। ওঁরা আমার নাটক দেখেছেন। জানানো হয়, একটি চরিত্রের জন্য আমাকে ভাবা হয়েছে। কিন্তু শুটিং-এর জন্য আমাকে ১২ দিন দিতে হবে। ১২ দিনের কথা শুনেই মাথায় হাত পড়েছিল। ধারাবাহিক থেকে টানা ১২ দিন বিরতি নিয়ে আসা বেশ কঠিন বিষয়।
প্রশ্ন: কী ভাবে সামলালেন?
আভেরী: সেই সময়ে আমি শুধু ‘ফুলকি’তেই অভিনয় করছিলাম। ‘তেঁতুলপাতা’র কাজ শুরু হয়নি। ‘ফুলকি’র কলাকুশলীরা সহযোগিতা করেছিলেন বলে আমি এই কাজটা করতে পেরেছি। ছবির শুটিং পুরোটাই কলকাতায় হয়েছে। তাই আরও একটু সুবিধা হয়েছে।
প্রশ্ন: ‘আমার বস্’ ছবিতে রাখি গুলজ়ারের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা কেমন?
আভেরী: রাখিদি ভীষণ মিষ্টি মানুষ। কিন্তু খুবই ‘আনপ্রেডিক্টেবল’ মানুষ। আমাদের পাঁচটা মেয়ে মানে, আমি, উমা, শ্রুতি, ঐশ্বর্যা, সৌরসেনীকে খুব পছন্দ করতেন। এমনও হয়েছে, ওঁর একার দৃশ্য রয়েছে। কিন্তু আমাদের তিনি খুঁজতেন। আমরা প্রচুর গল্প করতাম। দাদু-ঠাকুরমারা যেমন গল্প বলেন, তিনিও ঠিক তেমনই। নিজের বাড়ির কথা বলতেন। কিছু জিনিস আবার বাচ্চাদের মতো। আর খাব না বলেই, একটা ফুচকা মুখে পুরে দিলেন হয়তো। আবার কখনও খুবই আবেগপ্রবণ। ছোটবেলার কথা বলতে গিয়ে চোখে জল আসতেও দেখেছি।
প্রশ্ন: আপনি তো মঞ্চেও অভিনয় করেন। জীবনে অভিনয়টাই করতে চান। এই সিদ্ধান্তটা নিলেন কী ভাবে?
আভেরী: আসলে একেবারে ছোটবেলায় অনেক কিছু হতে চাইতাম। কখনও শিক্ষিকা, কখনও আবার চিকিৎসক হতে চাইতাম। আর একটু বড় হওয়ার পরে ভেবেছিলাম নৃত্যশিল্পী হব। দশ বছর ভরতনাট্যম শিখেছি। কিন্তু মায়ের ইচ্ছে ছিল, আমি যেন অভিনেত্রী হই।
প্রশ্ন: মা কি নিজেও অভিনেত্রী হতে চাইতেন?
আভেরী: আসলে দাদু প্রবাসী বাঙালি ছিলেন। নাটক করতেন। মায়েরও ইচ্ছে ছিল অভিনয় করার। সেই ইচ্ছে পূরণ হয়নি। তাই মা প্রথম থেকেই চাইত, মেয়ে যেন অভিনয়টা করে। মায়ের বড় মেয়ে, মানে আমার দিদি অনেক বেশি গুণী। কিন্তু ও খুব লাজুক। ও পড়াশোনা নিয়েই থাকতে বেশি ভালবাসে। কিন্তু আমাকে কোথাও নাচতে বললেই আমি নেচে দিতাম। আমার কোনও জড়তা ছিল না। মঞ্চে উঠলে আমি ঠিক কিছু করে তার পরেই নামতাম। তনুশ্রীশঙ্করের কাছেও দীর্ঘ দিন নাচ শিখেছি। রমাপ্রসাদ বণিকের সংস্থায় অভিনয়ের প্রশিক্ষণও নিয়েছি। স্কুলে পড়ার সময়ে গোটা রবিবার নাচের ক্লাস, অভিনয়ের ক্লাস করেই কেটে যেত।
প্রশ্ন: অভিনয়ের ক্ষেত্রে চেহারাকে এখনও অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে মনে করা হত। তথাকথিত ‘পারফেক্ট ফিগার’-এর ছক ভেঙে এই ইন্ডাস্ট্রিতে নিজের জায়গা তৈরি করতে অসুবিধা হয়নি?
আভেরী: আমি কোনও বিষয়কে অসুবিধা বা বাধা হিসেবে দেখি না। আমার মনে আছে, ২০১৪ সালে একটি ধারাবাহিকে আমাকে মায়ের চরিত্রে নেওয়া হয়েছিল। অথচ আমার পুত্রের ভূমিকায় যিনি অভিনয় করেছিলেন, তিনি আমার চেয়ে বয়সে বড় ছিলেন। কোনও অসুবিধা হয়নি এটা নিয়ে। আমাকে অনেকেই বলত, “এমন চেহারা তোর! তুই তো ক’দিন পরে মায়ের চরিত্রে অভিনয় করবি।” তখনও আমি বলতাম, ‘আমার অসুবিধা নেই। বরং ওই চরিত্রটা হয়ে ওঠাই আমার কাছে চ্যালেঞ্জিং’। ‘তবে তাই’ নামে একটি নাটকে ৭৫ বয়সি একজন বৃদ্ধার চরিত্রে অভিনয় করেছিলাম।
প্রশ্ন: এতে অসুবিধা হয় না কেন?
আভেরী: অভিনয় জগতে চেহারা সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ। রোগা হতে চাওয়া বা নিজেকে রোগা দেখতে চাওয়ার মধ্যেও কোনও ভুল নেই। এটা আমার গাফিলতি। সত্যিই আমি খেতে খুব ভালবাসি। সত্যিই তো খাওয়ায় সামান্য নিয়ন্ত্রণ করলে বা শরীরচর্চা কেন্দ্রে নিয়মিত গেলে রোগা হতে পারব। কিন্তু সেটা আমি করি না নিজের গাফিলতির জন্য। ‘আমার ওজন বাড়ছে তো কী হয়েছে?’ এমন ভাবনা আমার নেই। বরং আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মাঝেমাঝে মনে হয়, একটু রোগা হলে হয়তো দেখতে বেশি ভাল লাগতে পারে। আবার একই সঙ্গে মনে হয়, নিজেকে সেই জায়গায় নিয়ে যেতে যখন পারছিই না, তাই যেটা রয়েছে সেটা নিয়ে খুশি থাকি।
প্রশ্ন: ইন্ডাস্ট্রির কারও থেকে চেহারায় বদল আনার কোনও পরামর্শ আসেনি?
আভেরী: হ্যাঁ, প্রচুর পরামর্শ এসেছে। মজার ছলেই হয়তো কেউ একটা অপ্রীতিকর মন্তব্য করে দিল। তবে এখানে নিজেকে ভাবতে হবে, আমি এই কথা এড়িয়ে যাব, না কি মনমরা হয়ে থাকব, না কি পরের দিন থেকেই শরীরচর্চাকেন্দ্রে গিয়ে ওজন কমানোর চেষ্টা করব, সেটা সম্পূর্ণ আমার উপরে নির্ভর করছে।
প্রশ্ন: আপনি সুন্দরী। মঞ্চেও নায়িকা হয়েছেন। কিন্তু পর্দায় নায়িকা হওয়ার জন্য চেহারার গড়নই বাধা নয় কি?
আভেরী: পরিচালক যদি কোনও চরিত্রের জন্য আমাকে রোগা হতে বলেন, তার মধ্যে কোনও অসুবিধা দেখি না আমি। কোনও চরিত্রের জন্য যদি আমাকে চেহারায় বদল আনতে বলা হয়, সেখানে আমি কোনও দোষও দেখি না। হয়তো সেই চেহারাই প্রয়োজন ওই চরিত্রের জন্য। কাউকে কোনও যুক্তিযুক্ত কারণে রোগা বা মোটা হতে বলা আর ‘বডিশেমিং’ দুটো ভিন্ন বিষয়। আজকাল সামান্য বিষয়েই ‘বডিশেমিং’-এর প্রসঙ্গ এসে যায়।
প্রশ্ন: আপনি এত সুন্দর কথা বলেন। আচ্ছা ‘অলক্ষ্মীজ় ইন গোয়া’ সিরিজ়ে একেবারে বিপরীত ধরনের চরিত্রে অভিনয় করেছেন। লাগামছাড়া সংলাপ বলতে অসুবিধা হয়নি?
আভেরী: আমি চিত্রনাট্য পড়েই ভেবেছিলাম, এই কথাগুলো আমাকে বলতে হবে! চার দেওয়ালের মধ্যে বলার মতো কথা এইগুলো। তবে গোটা টিম এতই সহযোগী ছিল, কোনও অসুবিধা হয়নি। তা ছাড়া চরিত্রের জন্য প্রস্তুতিও নিয়েছিলাম। আমার মা-ও আমার মুখে সংলাপ শুনে অবাক হয়ে গিয়েছিল।
প্রশ্ন: মিতভাষী, ভাল মানুষ ভাবমূর্তি নিয়ে ইন্ডাস্ট্রিতে যুঝতে কি খানিক অসুবিধা হয়?
আভেরী: কিছু ক্ষেত্রে অসুবিধা হয় বটে। একটা বিষয় বুঝেছি, ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করতে গেলে খুবই নমনীয় হতে হবে। আমার আচরণ খুবই বন্ধুত্বপূর্ণ। কিন্তু সেটার সুযোগ কেউ নিতে চাইলে লাগাম টানতে হয়। এখন এই লাগামটা টানতে শিখে গিয়েছি। কয়েক বছর আগেও জানতাম না, কী ভাবে নিজের কথা বলতে হয়। কোন জায়গায় নিজের কথা বলতে হয়। আগে অন্যদের কথা বেশি ভাবতাম।
প্রশ্ন: গত কয়েক মাসে ইন্ডাস্ট্রির বেশ কিছু অন্ধকার দিক উঠে এসেছে। আপনাকে কখনও ইন্ডাস্ট্রির কোনও কুপ্রস্তাবের মুখোমুখি হতে হয়েছে?
আভেরী: এখনও পর্যন্ত এমন কোনও প্রস্তাব আসেনি। আসলে আমি এমন ভাবেই মিশি.....
প্রশ্ন: চারপাশে একটা অদৃশ্য বর্ম থাকে?
আভেরী: হ্যাঁ, তেমনই অনেকটা। ভদ্র ব্যবহার করি। বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করি। কিন্তু আমাকে খারাপ প্রস্তাব দেওয়ার আগে মানুষ দু’বার ভাববে। তাই এখনও তেমন প্রস্তাব আসেনি। আগামী দিনে আসবে কি না, তা অবশ্য জানি না।
প্রশ্ন: আভেরীর ব্যক্তিগত জীবনে এখন কী চলছে?
আভেরী: আপাতত এখন কাজ নিয়েই ব্যস্ত। আর আমার পোষ্য জানুয়ারিকে নিয়ে দিন কাটছে।
প্রশ্ন: এই উত্তরটা কূটনৈতিক হয়ে গেল না?
আভেরী: আসলে ২০২৩ সালটা সত্যিই আমার খুব খারাপ কেটেছে। প্রতারিত হয়েছি। দীর্ঘ দিনের সম্পর্কে বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়েছি। আত্মবিশ্বাস ভেঙে গিয়েছিল। ওই সময়ে আমার হাতে টানা তিন মাস কাজও ছিল না। সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়াতে সময় লেগেছিল। কাজই সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছে। তা ছাড়া বন্ধুবান্ধব ও আমার পরিবার সঙ্গে ছিল বলেই আমি আবার উঠে দাঁড়াতে পেরেছি। তার পর থেকে সবার আগে নিজেকে গুরুত্ব দিতে শিখেছি।
প্রশ্ন: আচ্ছা, কাজের প্রসঙ্গে ফেরা যাক। আপনি তো ‘তেঁতুলপাতা’ ধারাবাহিকে দেহাতি মহিলার চরিত্রে অভিনয় করেছেন। কী ভাবে এই ভাষায় সড়গড় হলেন?
আভেরী: আমার মায়ের জন্ম ও বড় হওয়া বিহারে। তাই মা ভোজপুরি ভাষা বলতে পারে। এখনও ঝরঝর করে বলতে পারে। আমি ‘তেঁতুলপাতা’য় কাজ পাওয়ার পরে এক দিন টানা অনেক ক্ষণ ভোজপুরিতে কথা বলল। তা ছাড়া আমি নিজেও অভ্যাস করেছি।