চামড়ার ফ্লিপার্স। আশমানি রঙের সামার কোট আর সাদা শার্ট। মাথায় ছোট একটা ঝুঁটি। কালো চশমা। মুখের ওপর ঘন ঘন ক্যামেরা ফ্ল্যাশ। বদলে গেছেন ‘পিকু’র রানা। হাসি-ঠাট্টা আর রোম্যান্সের বাইরে গম্ভীর এক ইরফান খান। ফোটোগ্রাফারের শত অনুরোধেও চশমা খুললেন না। ভিড়ের মধ্যে কেউ বলে উঠলেন আপনাকে স্ট্রেসড লাগছে। আর তাতেই বেশ রেগে গেলেন ‘নেমসেক’য়ের অশোক গঙ্গোপাধ্যায়।
ডার্ক গ্লাসটা খুলতে চাইলেন না কেন?
হয়তো বিশ্বাস করবেন না, আমি ছবি তুলতে ভালবাসি না। চাই না কেউ আমার ছবি তুলুক। এই যে আপনি আমার সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন এটাও চাই না। কেন বলুন তো লোকে এসে আমার ব্যক্তিগত কথা জানতে চাইবে? আর আমাকে সেটা বলতে হবে।
আপনি এত রেগে আছেন কেন?
রাগ নয়। আমি আজ অবধি যা করেছি সবই ছবির প্রোমোশনের জন্য। যেমন এই যে লুকটা এটা ‘মাদারি’র জন্য করা। আচ্ছা, আপনি ‘মাদারি’ নিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করছেন না তো।
আচ্ছা, হঠাৎ কেন প্রযোজনায় এলেন?
মুম্বই ইন্ডাস্ট্রিতে ছবির প্যাটার্ন চেঞ্জ হচ্ছে। কিন্তু ‘মাদারি’র মতো একটা ছোট ইন্টারেস্টিং গল্প নিয়ে আমি যদি ফান্ডিং-য়ের জন্য কর্পোরেট দুনিয়ায় ট্রাই করতাম তা হলে কেউ আমায় পাত্তা দিত না। তাই ভাবলাম নিজেই ছবিটা প্রোডিউস করি। পরে কর্পোরেট দুনিয়াকে দেখাব। আমার বিশ্বাস ছবিটা দেখার পর তারা ইন্টারেস্টেড হবে। দেখুন হিন্দি ছবি যে শুধু কমার্শিয়াল দিক ভেবে তৈরি হবে তা তো নয়।
কমার্শিয়াল হিন্দি সিনেমা বলতে?
(একটু ভেবে) হুমমম…এগজাম্পল দিই একটা। কমার্শিয়াল সিনেমায় সিচ্যুয়েশন তৈরি হল কি হল না হিরো বলে দিল ‘আই লাভ ইউ’।
তা হলে আপনার মতে ‘আই লাভ ইউ’ কখন বলা উচিত?
(বেশ গম্ভীর! একটুও হাসলেন না) কমার্শিয়াল ছবিতে যে ভাবে রোম্যান্স দেখানো হয় তার বাইরেও কিন্তু রোম্যান্সের অনেক কিছু থেকে যায়। যেমন ‘লাঞ্চ বক্স’য়ের কথা ভাবুন। দু’জন মানুষের মধ্যে আস্তে আস্তে একটা সম্পর্ক, আবেগ, নেশা তৈরি হল। কিন্তু কেউ কাউকে দেখেননি! ছবিতে আমি আমার সোলমেটকে খুঁজে পেলাম। অথচ তাকে সে ভাবে না চিনে, না দেখে। ‘পিকু’তে যেমন রানা আর ‘পিকু’র প্রেম হচ্ছে বৃদ্ধ বাবার মাঝে। আগে হিন্দি সিনেমায় হয় পেরেন্টরা বাদ থাকত, নয়তো পেরেন্টরা যত সমস্যার মূলে, এটাই দেখানো হত। অথচ ‘পিকু’ একটা বিরাট চেঞ্জ আনল। আর মানুষও
সেটা নিল।
‘পিকু’তে অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে ফ্লোর শেয়ার করেছিলেন। কখনও ইনসিকিওরিটি আসেনি?
ইনসিকিওরিটি! আমার! কেন বলুন তো? আমি খারাপ অভিনেতা নাকি?
অমিতাভ বচ্চনকে এক জন অভিনেতা হিসেবে কত নম্বর দেবেন?
আমি ওঁকে নম্বর দেওয়ার কে বলুন তো! তবে একটা কথা বলি, আমি ইন্ডাস্ট্রিতে দু’ধরনের অ্যাক্টিং খেয়াল করেছি। একটা হল চরিত্রের মধ্যে মিশে গিয়ে নিজেই চরিত্র হয়ে ওঠা। যেমন দিলীপ কুমার। এক সময় এমন হয়েছিল ক্রমাগত ট্র্যাজিক রোলে অভিনয় করতে করতে দিলীপ কুমার সাইকিয়াট্রিস্ট দেখিয়েছিলেন। তাঁকে বলা হয়েছিল এ বার মজার ছবি করতে। সেখানে অমিতাভ বচ্চনের অন্য প্যাটার্ন।
উনি চরিত্র হয়ে ওঠেন না, কিন্তু এমন অ্যাক্টিং করেন ওই চরিত্র ছা়ড়া তাঁকে আর অন্য কিছু মনে হয় না। যখন অভিনয় করেন তখন চারপাশ সুইচড অফ করে দেন। আর কাজ শেষ হওয়ার পর সেই চরিত্র থেকে বেরিয়ে আসেন।
এগুলো ইনবর্ন অ্যাক্টরদের ক্ষমতা। আমি সে গোত্রে পড়ি না।
সে কী! আপনি তো বলিউড থেকে হলিউড সব জায়গায় সমান ভাবে সফল। তবে শোনা যায়, হলিউডে আপনি নাকি কম পারিশ্রমিকেও কাজ করতে রাজি?
মার্কেটটাই আসল। হলিউড ইজ আমেরিকা। আর ভাবুন তো আমেরিকা কী ভাবে ইউরোপিয়ান ছবির বাজারটা নিয়ে নিচ্ছে। আমাদের এখানে অভিনেতারা কিন্তু আর সুপারস্টার হিসেবে অ্যাকসেপ্টে়ড হয় না। হলিউডের সব অ্যাক্টরই সুপারস্টার। সেটা ক্লিন্ট ইস্টউড হোক বা রবার্ট ডি নিরো। ওখানে কাজ করে একটা আলাদা স্যাটিসফ্যাকশন পাওয়া যায়।
অনিল কপূর, প্রিয়ঙ্কা চোপড়া, দীপিকা পাড়ুকোন…একের পর এক বলি স্টাররা হলিউড যাচ্ছেন, তা হলে কি বলিউডের চেয়ে হলিউডে কাজ পাওয়া এখন সহজ হয়ে গেছে?
একেবারেই নয়। প্রিয়ঙ্কা আর দীপিকা দু’জনেই খাটছে। আর ওখানে ভাল কাজ করছে। তার মানে এই নয় যে হলিউড, ইন্ডিয়ার দিকে তাকিয়ে বলছে ‘আও জি, আও জি’।
‘জাঙ্গল বুক’ ভারতে ১৮০ কোটি টাকার ব্যবসা দিয়েছে যা সম্ভবত এসআরকে-র ‘ফ্যান’-য়ের চেয়ে বেশি।
হ্যাঁ, এটা ঠিক। এই প্রথম কমার্শিয়াল ছবির চেয়ে ভাল ব্যবসা দিল ‘জাঙ্গল বুক’। তবে আরও মজার বিষয় হল ব্যবসা এসেছে ‘জাঙ্গল বুক’য়ের হিন্দি ভার্সন থেকে। আরে এটাই তো সময়! যখন বাজার থেকে ট্যালেন্ট আর একটু রিস্ক নিয়ে নতুন ধাঁচের ছবি করা যায়। সে কারণে আমার ‘মাদারি’ করা। আমরা সমাজে কী ভাবে এস্টাব্লিশমেন্টের জালে আটকে আছি। বিকিয়ে যাচ্ছি। তাঁর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ থাকছে এই ছবিতে।
‘মাদারি’তে একটা সোশ্যাল মেসেজ আছে। সেখান থেকে জানতে চাইছি এই যে, অভিনেতা নানা পাটেকর তাঁর রোজগারের ৯০ শতাংশ কৃষকদের হাতে তুলে দিলেন…
দাঁড়ান, দাঁড়়ান, আপনি কি দেখেছেন নানা পাটেকরকে এটা করতে? আমি তো দেখিনি। তাই এ বিষয়ে কী করে মন্তব্য করব বলুন তো!
আপনি ভীষণ ডিপ্লোম্যাটিক উত্তর দিচ্ছেন। অভিনেতাদের কি সবসময় পলিটিক্যালি কারেক্ট থাকতে হবে?
আচ্ছা বলুন তো পলিটিক্যালি ইনকারেক্ট থাকব কেন? গসিপ তৈরির জন্য! পারব না। পছন্দ না হলে আমার ইন্টারভিউ নেবেন না।
কিন্তু ট্যুইটারে ঢাকায় জঙ্গি হানা নিয়ে আপনার বক্তব্য তো বিতর্ক তৈরি করছে?
(পাশ থেকে সেক্রেটারি বলে উঠলেন ‘‘ইসলাম নিয়ে কোনও প্রশ্ন নয় প্লিজ, ‘মাদারি’ নিয়ে প্রশ্ন করুন) ।
আচ্ছা প্রসঙ্গ পাল্টাচ্ছি। ইন্ডাস্ট্রিতে তিন ‘খান’য়ের রমরমা। চার নম্বর খান কি আপনি?
আমি তিন খান নিয়ে কেন মন্তব্য করব? যে যার কাজ নিয়ে ব্যস্ত। দেখুন আমি একটু অন্য রকম ভাবে বাঁচতে চাই।
কী রকম?
আমি ইন্ডাস্ট্রিতে গল্প বলতে এসেছি। আমি কোনও দিন চাইনি যে আমার এমন একটা ইমেজ তৈরি হোক যেখানে মানুষ আমার মুখ, আমার স্টাইলটাকে ভালবেসে ফ্যান হয়ে যাবে। আমি নিজের জন্য জায়গা তৈরি করছি।
আপনি তো ক্রিকেটার হতে চেয়েছিলেন? আজও ইন্ডিয়া খেললে বিরাটকে নিয়ে দারুণ সব ট্যুইট করেন। বিরাট আপনার খুব প্রিয়…
হ্যাঁ, ক্রিকেটার হতে গিয়ে দেখলাম এগারোজনের সঙ্গে লড়াই করতে হবে। খুব চাপ! আমার মধ্যে অনায়াসে যা আসে না আমি তা পারি না। যেমন জিমে গিয়ে কোনও আনন্দ পাই না। শরীর তৈরি করি না। বরং অডিয়েন্সকে যদি জীবনের গল্প বলে ধাক্কা দিতে পারি, সেটাই পাওয়া।
কিন্তু ইন্ডাস্ট্রিতে তো অনেক অভিনেতা, তখন কী করেন?
লড়াইটা অন্য অভিনেতাদের সঙ্গে নয়। নিজের সঙ্গে। একটা ঘটনা বলি?
বলুন না
‘লাইফ অব পাই’ শ্যুট করছি। বাঘের জন্য আমার কান্নার একটা সিন ছিল। নয় নয় করে একশো বার ক্যামেরার সামনে একই সিনের শট দিয়েছি। খুব ইমোশনাল হয়ে গিয়েছিলাম। ছ মাস পর আবার অ্যাং লি-র ফোন। ওই দৃশ্য রিটেক হবে। আবার শট দিলাম। চ্যালেঞ্জটা মিট করার জন্য নিজেকে উজাড় করে দিতে হয়।
আপনি খুব আবেগপ্রবণ। কলকাতার উড়ালপুলের মর্মান্তিক ঘটনায় ট্যুইট করেন…
হ্যাঁ, খুব আঘাত পেয়েছিলাম। ভাবুন তো সিস্টেম মানুষের জীবনকে শেষ করে দিচ্ছে। একটা ভুলের জন্য এতগুলো মানুষ প্রাণ হারাল।
কলকাতার সঙ্গেও তো আপনার অনেক দিনের যোগ। বাঙালি মেয়ে বিয়ে করেছেন।
হ্যাঁ, সুতপার সঙ্গে এনএসডি-তে আলাপ। আমরা সমবয়সি। ওই আমার সবচেয়ে বড় ক্রিটিক। আসলে কলকাতার মধ্যে আজও একটা মাটির গন্ধ আছে। শহরটাকে সে কারণে ভাল লাগে।
ফাদার্স ডে –তে সবাই যেখানে শপিং মলে গিয়ে ছেলেমেয়েকে প্যাম্পার করে সেখানে আপনি ছেলেকে গাঁধী আশ্রমে নিয়ে যান। হঠাৎ গাঁধী আশ্রম?
আমি চেয়েছিলাম আমার ছেলে গাঁধী দর্শনের সঙ্গে পরিচিত হোক। তাই ওকে নিয়ে গিয়েছিলাম।
পলিটিক্সে আসবেন কখনও?
কেন? অ্যাক্টিংটা কি ভাল লাগছে না আপনাদের?
ইরফান খান মানেই একটু রাগী, ইনটেলিজেন্ট পুরুষ...
ক্ষতি কী! অভিনয় আমার জীবন। অভিনয়ের মধ্যে দিয়েই নিজের জার্নিটা দেখতে পাই। স্টারডম ভাল লাগে না আমার। ওখান থেকে কিছু পেতে চাই না…বিশ্বাস করুন। আই উড লাইক টু এনজয় মাই লাইফ উইদাউট ফেম...