আলতা যখন নারীর সাজের প্রধান অঙ্গ। গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।
নারীর পা আলতারাঙা। আদি যুগ থেকে কাব্যিক বর্ণনায় সেই দৃশ্য যেন আরও রোমান্টিক! কবি ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যে যেমন রয়েছে, ছদ্মবেশী দেবী অন্নপূর্ণা তাঁর আলতারাঙা পা জলে রাখতেই ঈশ্বরী পাটনী তাঁকে পা তুলে নৌকোর ভিতরে রাখতে অনুরোধ জানিয়েছিল, যাতে আলতা না ধুয়ে যায়। এ দিকে, জলে আলতায় সাজানো পায়ের ছোঁয়ায় একের পর এক লাল পদ্ম ফুটেছে। আবার প্রেমে আকুল শ্রীকৃষ্ণ তাঁর রাধিকার রাঙা চরণ নিজ হাতে সযত্নে তুলে ধরে অনুরোধ জানিয়েছিলেন, “স্মরগরল খণ্ডনং, মম শিরসি মণ্ডনং, দেহি পদপল্লবমুদারম।” কবি জয়দেব তাঁর ‘গীতগোবিন্দ’ কাব্যে সে কথা প্রথম জানিয়েছিলেন।
অর্থাৎ, আদি থেকে আধুনিক— নারীর বিবর্তন ঘটেছে যুগে যুগে। আলতায় পা সাজানোর রীতি কিন্তু স্বমহিমায় বর্তমান।
ইদানীং, বাঙালি বিয়েতে ‘সঙ্গীত’, ‘মেহেন্দি’র মতো অবাঙালি রীতি জায়গা করে নিয়েছে। কিন্তু বাঙালি বধূ মানে এখনও আলতারাঙা পা— এ প্রথা ভাঙেনি এখনও! কখনও পায়ের পাতায় রং ছড়িয়ে হাতের তালুতেও গর্বিত উপস্থিতি তার! কখনও নাচের অনুষ্ঠানে। কখনও মেহেন্দির বিকল্প হিসাবে। তবে এ শুধুই হিন্দু রীতি নয়। বাঙালি মুসলমান সমাজেও বিয়ের কনেকে এক সময় দেওয়া হত আলতা-চিরুনি। আজও দুই বাংলার প্রত্যন্ত এলাকার মুসলমান সম্প্রদায়ের বিবাহ অনুষ্ঠানে আলতা পরেন মহিলারা। আবার কোনও কোনও ধর্মীয় উৎসবেও সাজের অঙ্গে হিসাবে আলতা পরতেন তাঁরা পায়ে।
সাবেক আলতার সাজ কি এই যুগেরও পছন্দ? কৌতূহল নিয়ে আনন্দবাজার ডট কম যোগাযোগ করেছিল অপরাজিতা আঢ্য, ডোনা গঙ্গোপাধ্যায়, পরমা বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্রুতি দাস, পোশাক পরিকল্পক অভিষেক রায়, বাংলাদেশের অভিনেতা গাজী আব্দুন নূরের সঙ্গে। এঁরা কেউই কিন্তু আলতা সাজকে ‘সনাতনী’ বলে দূরে সরাতে রাজি নন।
যেমন অভিষেকের মত, “নারী মানেই শক্তি, সাহস, সৌন্দর্যের প্রতীক। এই তিন উপাদান লাল রঙের মধ্যে রয়েছে। তাই যুগ যুগ ধরে নারীকে সাজাতে আলতার ব্যবহার।” পোশাক পরিকল্পক কিন্তু এ টুকুতেই থামেননি। তিনি যোগ করেছেন, বিবাহিতা নারীর সঙ্গে আলতার যেমন গাঢ় যোগ, একই ভাবে অবিবাহিতাদের মধ্যেও আলতা পরার ঝোঁক সুদূর অতীত থেকেই। ফলে, আলতা সাজও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক হচ্ছে। অভিষেকের এই মত সমর্থন করেছেন শ্রুতি। তাঁর সাফ জবাব, “বাঙালির যে কোনও ঐতিহ্যপূর্ণ সাজ আমার পছন্দের। আমি কিন্তু উৎসব ছাড়াও আলতা পরতে ভালবাসি। অনেক ফটোশুটে দেখবেন, পায়ের পাশাপাশি আমার হাতও আলতায় রঙিন।” জানিয়েছেন, কাকতালীয় ভাবে ‘রাঙা বৌ’ ধারাবাহিকে তিনি সিঁদুর-আলতা প্রস্ততকারী সংস্থার বাড়ির বৌয়ের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। সেই সময় যে যে উপকরণ দিয়ে তিনি ক্রেতাদের সাজাতেন, সেই সব উপকরণ তিনি যত্ন করে সংগ্রহে রেখে দিয়েছেন।
হিন্দু শাস্ত্র মতে, বিবাহিত নারী স্বামীর মঙ্গল চেয়ে পায়ের পাতার ধার ঘেঁষে আলতা পরবেন। অবিবাহিত নারী ভাইয়ের বা নৃত্যশিল্পী সর্বজনের মঙ্গল চেয়ে সেই আলতা ছড়িয়ে দেবেন পায়ের আঙুলের উপরেও। এই মতামত কতটা সত্য?
প্রশ্ন তুলতেই সায় দিলেন অপরাজিতা, পরমা এবং ডোনা। তাঁরা সকলেই অভিনয় এবং নৃত্যশিল্পে জনপ্রিয়। পরমার মতে, “পায়ের সঙ্গে হাতের আঙুলও আলতা দিয়ে রাঙিয়ে তুলি আমরা। হাতের পাতায় গোল করে টিপ এঁকে চারপাশে সূক্ষ্ম কারুকাজ করি। আমার কিন্তু হাতের এই সাজ বেশ লাগে।” অপরাজিতার অবশ্য ভিন্ন মত। তিনি বলেছেন, “অবশ্যই সুন্দর দেখায়। কিন্তু তার ঝক্কিও অনেক। আলতায় সর্বস্ব লাল হয়ে ওঠে!” অভিনেত্রীর মনে আছে, ছোটবেলায় যে দিন তিনি নাচের অনুষ্ঠানে যোগ দিতেন সে দিন তাঁর সঙ্গে তাঁর মা-জেঠিমারাও আলতার রঙে রঙিন হতেন! তাঁর আলতারাঙা হাতের স্পর্শে। সে কথা মনে করে তিনি বলেন, “শুধু পোশাক বা মুখচোখ নয়, আলতার কল্যাণে সে দিন খাবারের বাক্সের লুচি-আলুর দমও রঙিন হয়ে যেত!”
ডোনা পেশায় ওড়িশি নৃত্যশিল্পী। তিনি নাচের সময় তাই হাত এবং পায়ের আলতার কারুকাজের উপরে জোর দিয়েছেন। জানিয়েছেন, হাত এবং পায়ের প্রতিটি মুদ্রা দর্শকদের সামনে আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে আলতার রঙের কারণে। দৃষ্টি আকর্ষণ করে তাঁদের। বাড়তি সৌন্দর্যও যোগ করে। তাই অতীত থেকে এখনও যে কোনও ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্যে আলতার ব্যবহার গুরুত্বপূর্ণ।
আলতারাঙা পায়ে ডোনা গঙ্গোপাধ্যায়। ছবি: সংগৃহীত।
আর সাজে? শুধুই কি বিবাহিত নারীর অঙ্গসজ্জা হিসাবেই আলতার বেশি কদর?
“একেবারেই না”, বলেছেন পরমা। নিজের কথাপ্রসঙ্গে উদাহরণ দিয়েছেন হিন্দি ছবির। বলেছেন, “বলিউডে বাঙালি নারী মানেই মোটা কাজল, সাদা-লাল শাড়ি, শাঁখা-পলা-সিঁদুর-আলতা। আগে খুব রাগ হত। বাঙালি নারীর কি এটাই পরিচয়?” পরে তিনি বুঝেছেন, বাঙালি নারীর চিরন্তনী রূপকল্পনায় এই সাজ সর্বজনীন। এখন তিনি গর্ব অনুভব করেন। তাই বিয়ে বাড়িতে বা ফ্যাশন শো-তে পরমার আলতা সাজ চাই-ই। তিনি বলেন, “একটি ফ্যাশন শোয়ে আমাদের শাড়ি পরানো হয়েছিল উঁচু করে। যাতে আলতার সাজ সকলের চোখে পড়ে।” একই ভাবে বিয়েবাড়ির সাজ মানেই তাঁর তালিকায় মোটা শাঁখা-পলা, বড় লাল টিপ আর আলতা থাকবেই।
একই কথা অপরাজিতারও। তাঁর ছোট বেলায় বাড়িতে নাপিত দিদি আসতেন প্রতি বৃহস্পতিবার। যিনি তাঁর জেঠিকে আলতা পরিয়ে দিতেন, তাঁকেও। “আলতা পরার ঝোঁক আমার তখন থেকেই। আলতার বোতল হাতে নিয়ে বসে থাকতাম”, দাবি তাঁর। পরমা নারীদের সৌন্দর্যচর্চায় আলতার গুরুত্ব বুঝিয়েছেন। তাঁর কথায়, “এখন পেডিকিওরের সময় পলিশ করানোর কথা ওঠে। অতীতে সেটাই করতেন নাপিত দিদি, মেয়েদের পায়ে আলতা পরিয়ে।” কী ভাবে আলতা পায়ের পরিচর্যার উপকরণ হয়ে উঠেছিল? পরমার কথায়, “আগেকার দিনে মেয়েরা খালি পায়ে হাঁটতেন। জুতো পরার অনুমতি তাঁদের ছিল না। ফলে, তাঁদের পা ফেটে যেত। নাপিত দিদি ঝামা দিয়ে ঘষে পা পরিষ্কার করে আলতা পরিয়ে দিতেন। ওটাই পেডিকিওরের ভাষায় ‘পলিশিং’। আলতা প্রাকৃতিক উপায়ে পা ফাটা কমিয়ে দিত। ঢেকে দিত ফাটা গোড়ালির খুঁত!”
সাবেকি সাজে পরমা বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবি: সংগৃহীত।
পরমাও ছোটবেলা থেকেই আলতাবিলাসী। মাকে লুকিয়ে বাড়ির পরিচারিকার কাছে আবদার করে পা রাঙাতেন। তবে গোলাপি বা লাল ঘেঁষা কোনও শাড়ি বাছলে তার সঙ্গে পায়ে আলতা না দেওয়ারই পক্ষপাতী তিনি। তিনি বলেন, “লাল নিজেই খুব গাঢ়। একই শেডের অন্য রঙের সঙ্গে তাই মানায় না। সাদা রঙ এর যোগ্য জুড়িদার।” একই ভাবে আলতা পরলে হিল নয়, জুতি বা হাল্কা স্যান্ডাল বাছেন তিনি।
হাল আমলে পুরুষও নারীর সাজে নিজেকে সাজাচ্ছেন। পরনে শাড়ি, চোখে কাজল টেনে, খোঁপায় ফুল জড়িয়ে প্রকাশ্যে আসছেন। পরছেন দুল, নাকছাবি। আলতাও কি পরবেন কোনও দিন?
পরেন তো! জানিয়েছেন অভিষেক। অতীতে বিয়ের দিন গ্রামাঞ্চলে পুরুষও আলতা পরত। আবার পোশাকশিল্পীর ফ্যাশন শুটেও পুরুষের আলতারাঙা পা দেখা গিয়েছে। পরমাও এই ফ্যাশনে আগ্রহী। জানিয়েছেন, পুরুষেরাও যদি নারীর মতো হাতে বা পায়ে সূক্ষ্ম কারুকাজের আলতা পরেন তা হলে দেখতে খুব খারাপ লাগবে না।
পড়শি বাংলাদেশের অভিনেতা গাজী আবদুন নূর, এ বাংলায় পরিচিত ‘বাবু রাজচন্দ্র দাস’ হিসাবে। ‘করণাময়ী রাণী রাসমণি’ ধারাবাহিকে তিনি এই চরিত্রেই অভিনয় করে জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন। তিনি জানান, আজও ও পার বাংলার গ্রামীণ এলাকার মেয়েরা ধর্মনির্বিশেষে আলতা পরেন। এক সময় সকলেই পরতেন। অভিনেতার কথায়, “আগে বিবাহ অনুষ্ঠানে কনের জন্য পাঠানো তত্ত্বে আলতা-চিরুনি দেওয়ার প্রথা ছিল। আমার মামার বিয়ের সময় দেখেছি, মামিকে ও ভাবে সাজাতে। তবে ধীরে ধীরে শহরের সংস্কৃতিতে বদল এসেছে। আমার দিদিই আর বিয়ের সময় আলতা পরেননি। কিন্তু গ্রামীণ এলাকায় আজও আলতা পরার প্রচলন রয়েছে।”