লহ মিষ্টান্নের নাম রে!

মিষ্টি কথাটার মধ্যেই কেমন যেন মন ভাল করে দেওয়া একটা ব্যাপার আছে। কথায় কথায় আমরা বলি না, খুব মিষ্টি লাগছে দেখতে, বা হাসলে ওকে খুব মিষ্টি দেখায়, অথবা গানের সুরটা কী মিষ্টি!—এ রকম সহজ উপমা সত্যিই বাংলাভাষায় আর দুটি নেই।

Advertisement

লিখছেন অঞ্জন চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১১ অক্টোবর ২০১৬ ০০:০০
Share:

মিষ্টি কথাটার মধ্যেই কেমন যেন মন ভাল করে দেওয়া একটা ব্যাপার আছে। কথায় কথায় আমরা বলি না, খুব মিষ্টি লাগছে দেখতে, বা হাসলে ওকে খুব মিষ্টি দেখায়, অথবা গানের সুরটা কী মিষ্টি!—এ রকম সহজ উপমা সত্যিই বাংলাভাষায় আর দুটি নেই।

Advertisement

ঠিক যেমন বর্ধমানের মিহিদানা। স্রেফ স্থানমাহাত্ম্যেই এক এবং অদ্বিতীয়। কখনও শুনেছেন রামনগরের সরপুরিয়া-সরভাজার কথা? শুনবেন না। কারণ ওটা কেষ্টনগরের ট্রেডমার্ক। অনেক ঘষেও অন্যত্র অ্যাচিভ করা অসম্ভব। আসলে যেখানকার যা। আমাদের মিষ্টান্ন মানচিত্রের জিওগ্রাফি তাই রীতিমতো ঐতিহাসিক। পান্তুয়া কি কলকাতা বা দুর্গাপুরে তৈরি হয় না? তবু রানাঘাটের সিট পাকা পান্তুয়ার ব্যাপারে। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের আমল থেকেই তা প্রবাদ-প্রসিদ্ধ। ওপিনিয়ন বা একজিট পোল নিয়ে দেখুন, গুলাবজামুন গো-হারা হারবে পান্তুয়ার কাছে। সব কিছুতে কি আর পরিবর্তন চলে?

এই অপরিবর্তিত স্বাদই জন্ম দেয় কিংবদন্তি রেসিপি-র। যে-রেসিপির হাতে লেগে আছে বাংলার অগণিত নাম-না-জানা হালুইকরদের ব্র্যান্ড ইকুয়িটি। সবাই কি আর ‘কে সি দাস’ হতে পারেন? যে কারণে শিলিগুড়ির অদূরে ফুলবাড়ির লালমোহনের পেটেন্ট নেওয়া হয়নি আজও। ঠিক যে রকম, মসলন্দপুরের দই বা শান্তিপুরের নিখুঁতি কার আবিষ্কার, জানা যাবে না কোনও দিনও। ছানার পায়েস বা কাঁচাগোল্লা বাঙালি তেড়েফুঁড়ে খেয়ে যাবে, কিন্তু জানবে না কোন বাঙালি জাদুকরের ইন্দ্রজাল জড়িয়ে আছে এর সৃষ্টিরহস্যে। কে যেন বলেছিলেন, বাঙালি এক আত্মবিস্মৃত জাতি। কে বলেছিলেন মনে করতে পারছি না।

Advertisement

বাংলার কে সি দাস, ভীম নাগ, নকুড়, অধর বা বলরামের পৃথিবীতে এখন অবশ্য উদারীকরণের ছোঁয়া। বাজারের তাগিদে অবাঙালি-রসনা তৃপ্ত করতেও তাঁরা পিছপা নন। ভাপা সন্দেশ বা বেকড রসগোল্লা তাই তাঁদের কাছে এখন রীতিমত ‘ইন থিং’। সেটা দোষের কিছু নয়। বরং প্রগতির লক্ষণ। তবু বলব, এথনিক রেসিপিগুলিকে বাঁচিয়ে রাখা বড় দরকার। এক্সোটিক ডেলিকেসিকে অসম্মান না করেও। কারণ ওই রেসিপিগুলির সঙ্গে আমাদের নাড়ির যোগ, বাঙালি সংস্কৃতির শিকড় গাঁথা রয়েছে এর রসের শিরায় শিরায়।

তবে শুধু স্বীকৃতিই যথেষ্ট নয়, বিস্তৃতিও সমান জরুরি। বাংলার বাইরে বাঙালিকে ‘রসগুল্লা’ বলে আইডেন্টিফাই করা হয়। এই সাধারণীকরণ থেকে বেরোনো খুব দরকার। তামাম বিশ্বকে জানানো উচিৎ বাঙালিমাত্রেই নরমপাক নয়, প্রয়োজনে কড়াপাকের খেল দেখাতেও সে সিদ্ধহস্ত। ‘হোয়াট বেঙ্গল বেকস টুডে, ইন্ডিয়া উইল বেক টুমরো।’ আমি আশাবাদী।

আর আশাবাদী বলেই হাল ছাড়িনি। বাংলার বাইরে শুরু করেছি ‘সুইট বেঙ্গল’। শুধু শুকনো ব্যবসায়িক কারণে নয়, মনের মধ্যে কোথাও একটা মিষ্টি প্রেমও উসকে দিয়েছিল আমার সেই ইচ্ছেকে।

আসলে মিষ্টির ব্যাপারে পিঁপড়ের মতো হতে হয়, তক্কে তক্কে থাকি কোথায় নতুন কোন স্বাদের জন্ম হল। আমি হলফ করে বলতে পারি, এখনও বহু মিষ্টির রেসিপি অনাবিষ্কৃত থেকে গেছে। কমিউনাল নই, তবু বলছি, যে-হারে ভুজিয়াওয়ালাদের সাম্রাজ্য বাড়ছে, মুখোমুখি লড়তে হলে, নতুন স্বাদ মুখে না আনলেই নয়। আর তা হতে পারে কারিগরদের মধ্যে ট্যালেন্ট হান্ট করেই। রসগোল্লার লিডারশিপকে বাঁচিয়ে রাখতে গেলে রিয়্যালিটি এটাই। আর সেটা মোটেও মিষ্টি নয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন