Buddhadeb Bhattacharjee death

বাবার সঙ্গে কোনও রাজনৈতিক মতানৈক্য হলেই বুদ্ধমামাকে ফোন করতাম

তিনি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কন্যাসম। দুই পরিবারের দীর্ঘ সখ্য। আনন্দবাজার অনলাইনের পাতায় প্রয়াত মুখ্যমন্ত্রীর স্মৃতিচারণায় উষসী চক্রবর্তী।

Advertisement

উষসী চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ০৯ অগস্ট ২০২৪ ১৭:৩০
Share:

বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। — ফাইল চিত্র।

বৃহস্পতিবার থেকেই মনটা খারাপ। গতকাল পাম অ্যাভিনিউতে বুদ্ধমামার বাড়িতে গেলাম। তাঁর পরিবারের সঙ্গে দেখা করলাম। তার পর থেকেই বুদ্ধমামাকে নিয়ে একের পর এক স্মৃতি ভিড় করে আসছে। কোনটা যে লিখব আর কোনটা যে বাঁচিয়ে রাখব, সেটাই বুঝতে পারছি না।

Advertisement

আমার বাবার বন্ধুবান্ধবদের ছোট থেকে আমি ‘পরিবার’ বলেই চিনেছি। আমার শৈশবের অনেকটা অংশ জুড়েই ছিলেন বুদ্ধমামা। অনিলকাকু, বিমানমামা— প্রত্যেকেই আমার পরিবারের অংশ ছিলেন। তাঁরা যে আমার আত্মীয় নন, সেটা কিন্তু আমি অনেক পরে বুঝতে পারি। আমার জন্মদিনে তাঁরা সকলে বাড়িতে আসতেন। বিশেষ করে, আমার পাঁচ বছরের জন্মদিনের অনুষ্ঠানের কথা খুব মনে পড়ছে।

বাবা (শ্যামল চক্রবর্তী) যখন জেলে ছিলেন, তখন খুব ভাল খাওয়াদাওয়ার সুযোগ ছিল না। ফলে পরে তাঁর ফুসফুসে যক্ষ্মা ধরা পড়ে, তখন চিকিৎসার জন্য বাবাকে রাশিয়ায় নিয়ে যেতে হত। আমি ছোট। তাই আমাকে ছেড়ে কিছুতেই বাবা যেতে রাজি হচ্ছিলেন না। কিন্তু বাবা না গেলে তাঁর প্রাণসংশয় দেখা দিত। আমরা তখন উল্টোডাঙায় থাকতাম। আমার এখনও স্পষ্ট মনে আছে, বাড়িতে বুদ্ধমামা, অনিলকাকু এবং বিমানমামা বারান্দায় বসে বাবাকে বোঝাচ্ছিলেন যে, চিকিৎসা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। বুদ্ধমামা বোঝানোর পরেই দেখলাম, বাবা রাশিয়া যেতে রাজি হলেন। তাঁদের বন্ধুত্বকে আমি ঠিক শব্দে ব্যাখ্যা করতে পারব না।

Advertisement

বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সঙ্গে ছোট্ট উষসী। ছবি: সংগৃহীত।

আমার মায়ের সঙ্গেও বুদ্ধমামার সুসম্পর্ক ছিল। তাই আমি ওঁকে ‘কাকা’ না বলে ‘মামা’ সম্বোধন করতাম। পরবর্তী সময়ে যখন বড় হলাম, তখন গুরুত্বপূর্ণ কোনও রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে বাবার সঙ্গে আমার মতবিরোধ হলেই আমি বুদ্ধমামাকে ফোন করেছি। তিনি হয়তো আমাকে অনেক কিছু বলেওছেন। তাঁর মতামতটা জানা আমার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তিনি খুবই সাপোর্টিভ ছিলেন। আমাদের দুই পরিবারের মধ্যেও যথেষ্ট নৈকট্য ছিল। সুচেতনের সঙ্গেও আমার এখনও যোগাযোগ রয়েছে। একসঙ্গে সকলে মিলে বেড়াতেও গিয়েছি। প্রচুর, প্রচুর স্মৃতি। আজ সেগুলোই আমাকে তাড়া করছে। এটাও আমাদের একটা বড় প্রাপ্তি যে, বাবাদের বন্ধুত্বের দৌলতে অনেক প্রতিকূলতার মধ্যেও আমরা, তাঁদের সন্তানরা সেই সখ্যের ধারা বহন করতে পেরেছি।

আজ চারপাশে রাজনীতি নিয়ে এত কথা চারিদিকে শুনি। কিন্তু, রাজনীতির ময়দানের বাইরেও আমার বাবার সঙ্গে বুদ্ধমামা বা বিমানমামাদের যে ব্যক্তিগত সম্পর্ক বা বন্ধুত্ব, তেমন আজ বিশেষ একটা দেখতে পাই না। বাবা ছিলেন পার্টির হোলটাইমার। মা একমাত্র আর্নিং মেম্বার। সেই সময় জানতাম, যদি কোনও বিপদে পড়ি, বা বাবা যখন কলকাতার বাইরে থাকবেন, তখন কোনও রকম সমস্যা হলে আমার কাছে বুদ্ধমামা এবং অনিলকাকুর নম্বর থাকত। আর আমার মা চলে যাওয়ার পর থেকে আমি বুদ্ধমামার তরফে অনেক ভালবাসা এবং প্রশ্রয় পেয়েছি।

এগুলো একান্তই আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এবং স্মৃতি। জানি না, আর কোনও দিন এগুলো বলার সুযোগ পাব কি না। তাই আজকে আপনাদের জানিয়েই রাখলাম। বুদ্ধমামার চলে যাওয়া আমার জীবনে যে শূন্যতা তৈরি করল, তা কোনও দিন ভরাট হবে না। ক্ষমতার শীর্ষে থেকে কী ভাবে দুর্নীতি থেকে দূরে থাকা যায়, কী ভাবে কোনও প্রলোভনে পা না দেওয়া যায়, তারই উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত বুদ্ধমামা। আরও একটা জিনিস না বললেই নয়। রাজনৈতিক নেতা মানেই যে চোর বা দালাল নন, সততার সঙ্গেও যে রাজনীতি করা সম্ভব, আমাদের দেশের রাজনৈতিক মানচিত্রে বুদ্ধমামা সেটা প্রমাণ করেছেন। ‘সৎ রাজনীতিক’ হওয়াও যে সম্ভব— দেশের রাজনীতিতে, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে এই বিশ্বাস যদি ফিরিয়ে আনা যায়, আমার মতে সেটাই হবে বুদ্ধমামার প্রতি যথার্থ শ্রদ্ধার্ঘ্য। লাল সেলাম।

(সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে অনুলিখিত।)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement