Arijita Mukherjee

‘যথেষ্ট সু্ন্দর’ না হওয়ায় বাদ, নিজেকে মাংসের তাল মনে হত! অভিনয় দিয়েই ওজন বাড়াচ্ছেন অরিজিতা

চেহারা নিয়ে খোঁটা দিয়েছে ইন্ডাস্ট্রি। কিন্তু অভিনয়ের জোরে অল্প দিনে জায়গা পাকা করেছেন অরিজিতা মুখোপাধ্যায়। কতটা কঠিন ছিল, জানালেন আনন্দবাজার অনলাইনকে।

Advertisement

তিয়াস বন্দ্যোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৩ অক্টোবর ২০২২ ১৫:১২
Share:

‘সম্পূর্ণা’, ‘ইন্দু’ কিংবা ‘কুলের আচার’— সব ধরনের চরিত্রেই অরিজিতার উপস্থিতি দর্শকের মনে দাগ কেটেছে।

সকাল থেকে রাত টলিপাড়াতেই কেটে যায় এক-এক দিন। বাড়ি ফিরতে মাঝরাত। ফের সকাল ৭টায় কল টাইম। দু’রাত শুটিংয়ের চাপে ভাল ঘুম হয়নি অভিনেত্রী অরিজিতা মুখোপাধ্যায়ের। তৃতীয় দিন, প্যাক আপের পর স্টুডিয়োতেই আড্ডা শুরু হল। কড়া কালো কফি, ঢুলুঢুলু আঁখি, গল্পের ঝুলি খুললেন অরিজিতা।

Advertisement

প্রশ্ন: জীবন তা হলে এখন নিম ফুলের মধু?

অরিজিতা: (হেসে) খানিকটা তো বটেই। নতুন সিরিয়ালে কাজ শুরু করছি। সেখানে দুই প্রজন্মের দুই শাশুড়ি। বাড়িতে বিয়ে হয়ে আসা বৌমাকেও এই একই কথা শুনতে হয়। দ্বিতীয় প্রজন্মের শাশুড়ি আমি। ফুলশয্যার রাতের পর চা-টা আগের মতো ছেলেকেই শুধু দিয়ে আসি উপরে গিয়ে, নতুন বউকে আর দিই না। ওকে আবার সামলে দেন আমার শাশুড়ি। লিলিদি (লিলি চক্রবর্তী) সেই চরিত্রে। টিজারেও আছে সেই সংলাপ— বিয়ের পর জীবনটা প্রথম প্রথম নিম ফুলের মধুর মতোই তেতো, তার পর দেখবে মিষ্টি।

Advertisement

প্রশ্ন: ইংল্যান্ডে থিয়েটার প্রশিক্ষক হয়ে এক বছর কাটানো, দেশে ফিরে গবেষণা চালিয়ে নিয়ে যাওয়া... এ সব ছেড়ে হঠাৎ সিরিয়াল কেন?

অরিজিতা: কেন নয়? টাকা রোজগার করতেই হত। বাবার অনেক বয়স হয়েছে। আমি বাড়ির একমাত্র উপার্জনকারী। কিন্তু প্রথম দিন থেকেই জানতাম, এই কাজটা সহজ হবে না। এটা চাকরির মতো নয়। তোমাকে প্রথম সুযোগটা কেউ দেবে, তার পর সুযোগগুলো নিজেকে করে নিতে হবে। ঝাঁপটা দিয়েই দিলাম। মনে হল,আরও আগেই শুরু করতে পারতাম অভিনয়টা। ব্যাকরণটা পোক্তই ছিল। শান্তিনিকেতনে বেড়ে ওঠা থেকে শুরু করে প্রেসিডেন্সি, যাদবপুরের পড়াশোনা অনেক সাহায্য করেছে।

‘সম্পূর্ণা’-র একটি দৃশ্যে অরিজিতা।

প্রশ্ন: সিরিজে জনপ্রিয় হয়েছেন, হাতে নতুন ছবি, তার পরও টেলিভিশনেই এত বেশি কাজ করছেন?

অরিজিতা: প্রত্যেকটা মাধ্যমই আলাদা। মঞ্চও সেই ছোট্টবেলা থেকে আমার প্রিয়। কিন্তু একটা সম্পূর্ণ অচেনা দর্শকগোষ্ঠীর সঙ্গে টেলিভিশনে কাজ করতে গিয়েই দেখা হল। যাঁরা কলকাতা, ক্যাফে, বুদ্ধিজীবী কালচারের মধ্যে অধিষ্ঠান করেন না। তাঁরাই আসলে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসাধারণ। রোজ টেলিভিশন দেখেন। তাঁদের সামনে নিজেকে তুলে ধরা, প্রত্যেক সপ্তাহে পরীক্ষা দেওয়ার মতো। তাঁরাই দেশের ভোটব্যাঙ্ক। টিআরপির প্রকাশের দিন আমার বুক কাঁপে। তাঁরা আমায় পছন্দ করেছেন বলেই জোর পেয়েছি। তাঁরা কী চাইছেন, সেই অনুযায়ী নিজেকে পাল্টানোর চেষ্টা করি।

প্রশ্ন: সেই তো শাশুড়ি-বউমা গতে-বাঁধা গল্পে বাঁধা পড়ে গেলেন, লক্ষ্য কি এটাই ছিল?

অরিজিতা: বদল আনতে সময় লাগে, এখনও সেই সিঁড়ি দিয়ে উঠছি তো। সবে রাজনীতির বাইরে এসে বিনোদন দিয়ে এই জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছলাম। আমি মনে করি, খুব জরুরি ছিল এখানে আসা। প্রমাণ করার ছিল, দেখতে সুন্দর না হলেও মানুষকে ছোঁয়া যায়, ভালবাসা পাওয়া যায়। রাস্তায় দেখা হলে মানুষ যখন এখন দাঁড়িয়ে পড়েন, আমার চরিত্রের নাম ধরে ডাকেন আর বলেন ‘আপনাকে খুব ভাল লাগে’, তখন নিজেকে সফল মনে হয়।

প্রশ্ন: ইন্ডাস্ট্রিতে চেহারা নিয়ে খোঁটা শুনতে হয়েছে?

অরিজিতা: বাবা! আমাকে যথেষ্ট ভাল দেখতে নয়— শুধু এই বলে বেশ কিছু কাজ থেকে বাতিল করা হয়েছিল। সহকর্মী থেকে শুরু করে ইন্ডাস্ট্রির অনেকেই বডিশেমিং করেছে। যেন আমি একটা মাংসের তাল! আর কোনও অস্তিত্ব নেই! সেখান থেকে প্রমাণ করতে হয়েছে যে, অভিনয়টা পারি। ওটাই পারি, আর যত দিন যাবে আরও ভাল পারব। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, চরিত্রের প্রয়োজনে আমি ওজন কমাব না! সেটা এক বারও বলিনি। এখনও দরকার হয়নি তাই নিজের চেহারাতেই ক্যামেরার সামনে আসি। ফিটনেস নিয়েও আমার কোনও সমস্যা হয়নি।

প্রশ্ন: ‘সম্পূর্ণা’, ‘ইন্দু’ কিংবা ‘কুলের আচার’— সব ধরনের চরিত্রেই আপনার উপস্থিতি দর্শকের মনে দাগ কেটেছে। তিন বছরের অভিনয়-জীবনে চেহারার বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে?

অরিজিতা: আসলে আমরা (শিল্পীরা) উলঙ্গ। পারফর্মারের শরীর তেমনই হওয়া উচিত বলে মনে করি। যে চরিত্র প্রয়োজন, নিজেকে তখন তাতে ভরব। সবাই আমাকে বললেন, ‘‘সম্পূর্ণা’-য় তোমাকে খুব ভাল লাগল।’’ কেউ বলেননি কিন্তু, ‘‘তোমায় কী মোটা লাগল!’’ ‘কুলের আচার’-এ ছিঁচকাঁদুনে মহিলা চরিত্রেও আমার চেহারা নিয়ে কারও অভিযোগ শুনিনি। চরিত্রটা যেমন বিরক্তিকর, তেমন মানুষ তো চারপাশে আছেন। আমি শুধু সেটাকেই বিশ্বস্ত করে তুলতে চেয়েছি।

অরিজিতার তিন বছরের অভিনয়-জীবনে চেহারার বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে?

প্রশ্ন: চেহারা কি শাপে বর হয়েছে কখনও কখনও?

অরিজিতা: আমি খুব আনন্দ পেয়েছি যে টেলিভিশনে মা-কাকিমা-জেঠিমা যেমন করছি, তার পাশাপাশি এমন ক্ষমতাশালী নারী চরিত্রেও ভাবা হয়েছে আমায়। সেটা চেহারার গুণে না অভিনয়ের, না দুটোই— জানি না। যেমন, ‘মিঠাই’য়ে এখন প্রমীলা লাহার চরিত্র করি। যে রাজনৈতিক ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে প্রতি দিন নোংরামি করে চলেছে। চারপাশে যা হচ্ছে তারই প্রতিফলন এ চরিত্রে। এর আগে ‘ফ্যালনা’ বলে একটা সিরিয়াল করতাম, সেখানে গ্যাংস্টার হয়ে বাচ্চা পাচার করেছি। লরি করে বাচ্চা নিয়ে ঘুরেছি। প্রথম কাজ ‘আয় খুকু আয়’-তেও কাছাকাছি এক চরিত্র ছিল। আমার এগুলো করতে খুবই ভাল লাগে।

প্রশ্ন: আগামী ছবিতে বোধহয় চেহারা নিয়েই গর্ব করতে পেরেছেন!

অরিজিতা: একদমই। উইন্ডোজ-এর প্রযোজনায় অরিত্র মুখোপাধ্যায়ের ছবি ‘ফাটাফাটি’তে ফাটিয়ে কাজ করেছি। স্বপ্নপূরণের গল্প। যেখানে মূল চরিত্র এটিই বলতে চেয়েছে যে, চেহারার মাপ কোনও দিনই স্বপ্নের ব্যাপ্তিকে ছাড়িয়ে যেতে পারে না। মানুষ যদি পরিশ্রম করে সৎ ভাবে, লক্ষ্যে সে পৌঁছবেই। সেই নিয়েই গল্প। আগামী বছর মুক্তি পাবে। অবশ্য, সৃজিতদার (মুখোপাধ্যায়) সঙ্গে ‘এক্স=প্রেম’ আমার প্রথম ছবি। সেখানেও আমার চেহারা কারও চোখে পড়েনি। অভিনয়ের জন্যই প্রশংসা পেয়েছি।

পারফর্মার আসলে উলঙ্গ, মনে করেন অরিজিতা।

প্রশ্ন: ‘দম লগাকে হাইশা’-র মতো বাংলায় মূল চরিত্ররা স্থূলকায় হওয়া কি সম্ভব?

অরিজিতা: ‘দম লগা কে হাইশা’-র মতো কাজ হচ্ছে না, তা নয়। ভারী চেহারার উদ্‌যাপন বাংলাতেও হচ্ছে। ‘একান্নবর্তী’-তে অনন্যার কথা বলা যায়। কিংবা ‘সম্পূর্ণা’য় আমি। সিনেমা খুব শক্তিশালী মাধ্যম। সবার কাছে বার্তা পৌঁছে দেওয়া যায়। কিন্তু সেই বার্তা নিয়মিত হতে হবে। ‘ফাটাফাটি’-র মতো ছবি একটা হয়ে থেমে গেলে চলবে না। আমরা যারা এ ধরনের চরিত্রে অভিনয় করলাম, তারাই যখন আবার অন্য ধরনের চরিত্র করছি, তখনই তো স্টিরিয়োটাইপ ভেঙে যাচ্ছে। মানুষ যদি শরীর না দেখে ভাল অভিনয়টা দেখে, তা হলেই কিন্তু এই দিন আসতে পারে।

প্রশ্ন: মঞ্চ মিস করেন?

অরিজিতা: ভীষণই করি। ইংল্যান্ড থেকে ফিরে নাটকের দল খুললাম। 'আগশুদ্ধি', 'ভাদ্রজা', 'লজ্জাতীর্থ', 'দৃষ্টিকন্যা'-র মতো প্রযোজনায় কাজ করতে পেরেছি বলে নিজেরই ভাল লাগে। তবে চপল ভাদুড়ীর সঙ্গে একই মঞ্চে অভিনয় করার সুযোগ আমার জীবনদর্শন বদলে দিয়েছিল। মাস্টার্সের পর শেখর সমাদ্দারের ‘সুন্দর বিবির পালা’ নাটকে ডাক পড়ল। রিহার্সালে এসে আমিও চরিত্র করছি, ও দিকে চপলদাও করছেন। আমি ওঁকে দেখে ভাবছি, আমি কী করছি! কিছুই হচ্ছে না। চপলদা ভরসা দিয়ে বললেন, “খুব ভাল হচ্ছে রে, শুধু যেটা করছিস আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে কর। জোর গলায় কর। ক্ল্যাপ তুই পাবিই।” কানে বেজেছিল সেই কথাটা। তাঁরা অন্য সময়ের মানুষ, ক্ল্যাপের অর্থ আমি তাঁর মুখ থেকে না শুনলে বুঝতাম না। সত্যিই হাততালি পেয়েছিলাম ফাইনাল শো-তে। এক বার, বার বার। এখনও সেই ‘ক্ল্যাপ’ পাওয়ার নেশা পেয়ে বসেছে। ওই মন্ত্রের টানেই ছুটেছি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন