একশো বছর পর শুধু ফ্রেমটাই থেকে যাবে

তাঁর ইন্টারভিউ পাওয়াই যায় না। কিন্তু কথা শুরু হলে সঞ্জয় লীলা বনশালী-র পৃথিবীটা চমকে দেওয়ার মতো। মুম্বইয়ে তাঁর মুখোমুখি ইন্দ্রনীল রায়।জেভিপিডি স্কিমের সিক্সথ রোডে একদম মধ্যবিত্ত বিল্ডিং। নাম ‘স্বাতী মিত্র’। তার ফিফথ আর সিক্সথ ফ্লোরে তাঁর অফিস। পাঁচ তলার অফিসটা প্রধানত ওয়েটিং রুম কাম গোডাউন। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে ছ’তলার ফ্ল্যাটে ঢুকতেই বোঝা গেল গড়পড়তা বলিউড নয়। একটু অন্য রকম রুচি দিয়ে সাজানো ফ্ল্যাট। পাজামা-পাঞ্জাবি পরে লাল কাউচে এসে বসলেন তিনি। শুরু হল আড্ডা...

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৭ নভেম্বর ২০১৫ ০০:৩২
Share:

জেভিপিডি স্কিমের সিক্সথ রোডে একদম মধ্যবিত্ত বিল্ডিং। নাম ‘স্বাতী মিত্র’। তার ফিফথ আর সিক্সথ ফ্লোরে তাঁর অফিস।

Advertisement

পাঁচ তলার অফিসটা প্রধানত ওয়েটিং রুম কাম গোডাউন। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে ছ’তলার ফ্ল্যাটে ঢুকতেই বোঝা গেল গড়পড়তা বলিউড নয়। একটু অন্য রকম রুচি দিয়ে সাজানো ফ্ল্যাট। পাজামা-পাঞ্জাবি পরে লাল কাউচে এসে বসলেন তিনি। শুরু হল আড্ডা...

Advertisement

আপনার অফিসটা কিন্তু একদম ঋতুপর্ণ ঘোষের বাড়ির মতো সাজানো...

তাই?

একদম তাই। সেই রকম ফার্নিচার, সেই রকম পেন্টিং, শো পিস...

ঋতু আমার খুব ভাল বন্ধু ছিল। এসেছিল আমার এই অফিসে যখন ‘চোখের বালি’র কাস্টিং করছিল।
বলেছিল, নন্দিতা দাসকে নিয়ে বানাবে ছবিটা। তখন আমি ওকে বলি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গল্প নিয়ে তুমি ছবি করছ, দেয়ার শুড বি মোর নয়েজ। যেখানে আপনি বসে আছেন, সেখান থেকে ঐশ্বর্যাকে ফোন করেছিলাম।

তার পর?

ঐশ্বর্যাকে বললাম, ‘‘ঋতু এসেছে। ও একটা ছবি প্ল্যান করছে। তুমি কি ওকে মিট করবে?’’ তার পর তো ঋতুর সঙ্গে ঐশ্বর্যার দারুণ ভাল বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল।

তার মানে ‘চোখের বালি’র প্রধান কাস্টিংটা করেছিলেন সঞ্জয় লীলা বনশালী...

(হাসি) হ্যাঁ, আমি ঋতুর সঙ্গেও ছবি করতে চেয়েছিলাম। স্ক্রিপ্টও পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু কিছু দিন পরে বুঝলাম এগোচ্ছে না কিছু। তার পর আর তা নিয়ে কথা বলিনি।

অনেক ফিল্ম জার্নালিস্টের সঙ্গে কথা হয়। কুড়ি বছর এই পেশায় আছে এমন সাংবাদিকও বলেন কিছুতেই বনশালীর ইন্টারভিউ তাঁরা করতে পারেননি। এতটা দূরের জগতে কেন বাস করেন আপনি?

আমি তো এমনিতে চুপচাপ। অত মিডিয়া, ইন্টারভিউ, খাওয়াখাওয়ি — আমার ভাল লাগে না। আমি আমার জগতে থাকি।

আপনার ব্যাপারে প্রচুর গল্প আছে কিন্তু বাজারে। আপনি বদমেজাজি, মারেন অ্যাসিস্ট্যান্টদের, খুব রাগী... এত দিনকার এত রাগ, দুঃখ, অভিমানের ক্লাইম্যাক্স কি তা হলে আপনার ড্রিম প্রোজেক্ট ‘বাজিরাও মাস্তানি’?

হ্যাঁ, সম্ভবত তাই। আমার প্রথম প্রেম সিনেমার ওই ফ্রেমটা (হাত দিয়ে একটা ফ্রেম দেখালেন)। আমার কাছে মনিটরের ওই ফ্রেমটাই ভগবান। ওটাই পুজো করি। ওই ফ্রেমের প্রত্যেকটা মিলিমিটার আমার। আমার নিজের। এই মুহূর্তেও আমার, একশো বছর পরেও আমার। আই ওন দ্যাট। ওই একটা ফ্রেমের থেকে বড় সত্য নেই আমার কাছে। (হাসি) আমি এ রকমই। একটু ক্র্যাকড, একটু বেশি প্যাশনেট।

প্রথম দিন থেকেই কি তাই? আপনি তো ‘পরিন্দা’তে বিধু বিনোদ চোপড়ার অ্যাসিস্ট্যান্ট ছিলেন?

হ্যাঁ, প্রথম দিন থেকেই তাই। কখনও আমার ছবি চলেছে। কখনও চলেনি। কিন্তু ভালবাসাটা সিনেমার প্রতি একই রকম থেকে গেছে।

আমি আমার সিনেমা আর তার চরিত্রদের মধ্যে দিয়ে জীবন খুঁজে পাই। আমি নিজেকে আটকেও রাখি না। আমার আনন্দ হলে সেটা আমার সিনেমায় প্রতিফলিত হয়। দুঃখ হলেও তাই। রাগ হলেও। তবে সব সময় রেগে যাই না। মাঝেমধ্যে চুপচাপও থাকি। সেটা নিয়ে মিডিয়া সে রকম কিছু লেখে না। (হাসি)

কী করে লিখবে? শুনেছি চুপচাপ খুব কমই থাকেন সেটে, বেশির ভাগ সময় তো অ্যাসিস্ট্যান্টদের চড়থাপ্পড় মারার গল্প শুনি। সেটা রণবীর কপূরই হোক কী সোনম!

(হাসি) থাকি, থাকি চুপচাপ। আর দেখুন প্রত্যেকটা কাজ হৃদয় দিয়ে করি। যখন দেখি কেউ ততটা হৃদয় দিয়ে কাজ করছে না, তখন আর নিজেকে সামলাতে পারি না। বিশ্বাস করি, ভাল কাজ আর মহান কাজের একমাত্র তফাত গড়ে দেয় অ্যাটেনশন টু ডিটেলস। আর কিছু নয়। আর একশো বছর পর তো কেউ থাকবে না, শুধু ফ্রেমটা থেকে যাবে। ফর লাইফটাইম অ্যান্ড বিয়ন্ড। সেটাকে পারফেক্ট করাটা আমার প্রধান দায়িত্ব।

প্রত্যেকটা প্রশ্নের উত্তরে আপনি ফ্রেমকে সুন্দর করার কথা বলছেন। প্রত্যেকটা ফ্রেমকে সুন্দর করতে করতে কোথাও সিনেমা থেকে হৃদয় হারিয়ে যাওয়ার ভয় থাকে না?

দ্যাট ইজ অ্যান ইন্টারেস্টিং কোশ্চেন। কিন্তু আমার মনে হয় না ভয় থাকে। প্রত্যেকটা ফ্রেম ভাল করতে করতে এগোলে এন্ড প্রোডাক্টটা ভাল হবেই।

আমি আজকে ‘বাজিরাও মাস্তানি’র ধরাবাঁধা প্রোমোশনাল ইন্টারভিউয়ের বাইরে গিয়ে, মানুষ সঞ্জয় লীলা বনশালীকে চিনতে চাইছি।

উফ্, বাঙালিরা না... আমি রেগেও যাই বাঙালিদের উপর। কিন্তু তাদেরকে ভালবাসি বড্ড। তাই কিছু বলতেও পারি না। বলুন কী জানতে চান...

গতকাল আপনার ‘দেবদাস’‌য়ের সময়কার একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টরের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। উনি আমাকে কিছু কথা বলেছেন।

(প্রচণ্ড হাসি) যেমন?

বলেছেন, আপনার বাড়িতে আজও আপনার বাবার সেই আধখাওয়া রামের বোতলটা আছে। যেটা খেতে খেতে উনি মারা গিয়েছিলেন...

(গম্ভীর হয়ে) হ্যাঁ, আছে।

কী হয়েছিল একটু বলবেন?

আমার বাবা ’৫৭-’৫৮ সালে ছবির প্রযোজক ছিলেন। ফ্লপ প্রোডিউসর। তার পর ডিপ্রেশন। শেষ দিকে বাবা রেশমার গান খুব শুনতেন। আমাকে সে দিন বলেছিলেন, রেশমার ‘হাইয়োঁ রব্বা’ গানটা শুনতে খুব ইচ্ছে করছে। এটা জাস্ট কোমায় চলে যাওয়ার আগে। আমি সঙ্গে সঙ্গে ছুটে রিদম হাউজ থেকে ক্যাসেটটা বাড়ি নিয়ে দেখি সব শেষ। তার পর থেকে আর কোনও দিন ওই গানটা শুনিনি।

বুঝলাম। আজও শুনি দক্ষিণ মুম্বইয়ের ভুলেশ্বর, যেখানে আপনার ছোটবেলা কেটেছে, সেখানে নাকি নিয়মিত যান?

যাই তো। আমার বাড়িটা ভুলেশ্বর আর ভেন্ডি বাজারের কর্নারে। ওখান থেকেই আমি আমার রাগ পাই, সুর পাই, প্যাশন পাই, ভালবাসা পাই। আমার আত্মা আজও ভুলেশ্বর আর ভেন্ডি বাজারের ক্রসিংয়ে।

ছোটবেলাটা তো সচ্ছল ছিল না?

না, ছিল না। কিন্তু সেটা নিয়ে ভাবিনি। আমাকে বেশি বদার করত অন্য ব্যাপার। আমার সঙ্গে মহল্লার বাকি ছেলেরা কেউ কথা বলত না। তাদের কাছে আমার কোনও অস্তিত্বই ছিল না। তার থেকেও ডেঞ্জারাস একটা ব্যাপার শুরু হয়েছিল মনে মনে...

কী সেটা?

আমার নিজের চোখেই আমার কোনও অস্তিত্ব ছিল না। আই ফেল্ট আই ওয়াজ অ্যান ইনভিসিবল চাইল্ড। আমি কারও দিকে তাকিয়ে হাসলে মনে হত, সে তো আমার দিকে তাকাচ্ছে না। আমি আসলে এতই সাধারণ ছিলাম যে, কারও মনে কোনও দাগ কাটতে পারেনি। এক সময় ভাবতাম, আমি বোধহয় আগলি চাইল্ড। আয়নায় দেখতাম নিজেকে। মনে হত, এতটাই কি আগলি যে আমি রেজিস্টারই করছি না কারও মনে!

তার পর?

এ রকম চলল বহু বছর। তার পর আমার বোন ফিল্ম স্কুলে যোগ দিল। বোনকে দেখাদেখি আমিও যোগ দিলাম। কিছুই বুঝতে পারছিলাম না জীবনের। ভাবতাম এই তো আমার ব্যাকগ্রাউন্ড, কে আমাকে কাজ দেবে! বাবা ছিলেন ফ্লপ প্রোডিউসর। কেন কেউ আমাকে অফিসে ডাকবে! কিন্তু নিয়তি অন্য খেলা খেলছিল। বিনোদ চোপড়া আমাকে অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে নিল ওর ছবিতে। প্রথমেই একটা গান শ্যুট করার দায়িত্ব পড়ল।

সেই সময় এফটিআইআই-তে একটা প্রেম হয়েছিল নাকি আপনার?

হ্যাঁ।

শুনেছিলাম সেই ব্রেক আপটা এতটাই দুঃখ দিয়েছিল আপনাকে যে তার পর থেকে...

(থামিয়ে দিয়ে) দিয়েছিল তো। আর একটা জিনিস দিয়েছিল সেই ঘটনাটা। আমার মধ্যে একটা রাগ তৈরি করেছিল। একটা ইনকমপ্লিটনেস এনে দিয়েছিল। এই ইনকমপ্লিটনেসটা কিন্তু ফিল্ম মেকার হিসেবে সময় সময় আমাকে খুব হিংস্র করে দিয়েছে। দিস ইনকমপ্লিটনেস হ্যাজ মেড মি ফেরোসাস অ্যাজ আ ফিল্মমেকার। এটা একটা ফোর্সের মতো, যেটা আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। এই ইনকমপ্লিটনেসটা থেকে শান্তি পেতাম আমি একটা জায়গাতেই।

মিউজিকে?

হ্যাঁ, মিউজিকে। লতাবাঈয়ের গলায়। সবার গান শুনতাম, রফি, কিশোর এবং আরডি বর্মন ছিলেন ভগবানের মতো। গান আমাকে শান্তি দিত। কিন্তু ধীরে ধীরে আমার ব্যক্তিত্বে আরও একটা পরিবর্তন ঘটল।

কী?

বুঝতে পারছিলাম ইনকমপ্লিটনেসটা আমাকে সম্পূর্ণ গ্রাস করে ফেলেছে। ওটাই তখন আমার মোটিভেশন হয়ে উঠেছে। আমার জীবন কমপ্লিট হয়ে উঠুক, সেটাও চাইতাম না। অদ্ভুত মাইন্ডস্পেস সেটা। কমপ্লিট হলেই মনে হত, মোটিভেশন চলে গেছে। ইনকমপ্লিটনেসই ভাল।

আজও কি তাই?

আজও তাই। ইনকমপ্লিটনেস আমার সব ছবির চরিত্রে। আমাকে ইনকমপ্লিটনেস টানে।

অনেকে বলে আপনার ছবিতে টাইম অ্যান্ড স্পেসের মাত্রা থাকে না। বিরাট বিরাট ঘর, কখনও সেটা নীল, কখনও ধূসর...

থাকতাম তো ভুলেশ্বরের চৌলে। আমার জীবনে স্পেস ছিল না। তাই কল্পনায় আমি বাড়ির দেওয়ালগুলো ঠেলে ঠেলে দূরে সরিয়ে দিতাম। সরিয়ে তাতে মনের মতো রং করতাম। সেই ভাবেই ‘ব্ল্যাক’। সেই ভাবেই ‘সাঁওয়ারিয়া’, সেই ভাবেই ‘গুজারিশ’। কারও খারাপ লাগত, কেউ কেউ বলত ভাল।

শুনেছি আপনি কোনও রেস্তোরাঁয় যান না। বন্ধু প্রায় নেই বললেই চলে?

হ্যাঁ, খুব কম বন্ধু আমার। আমি রেস্তোরাঁয় যাই না। বেড়াতে যাই না। ড্রাইভে যাই না। সিনেমা হলেও যাই না। আমি আমার বাড়িতে থাকি, গান শুনি, লিখি, আর আমার ছবির প্রত্যেকটা ফ্রেমকে কী ভাবে সুন্দর করা যায় সেটা ভাবি।

ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ডের সময় আপনার ‘বাজিরাও...’‌য়ের ডিওপি সুদীপ চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন আপনি নাকি আপনার অ্যাসিস্ট্যান্টদের বলেন বাংলা ছবি দেখে শিখতে কী করে কম বাজেটে ছবি করা যায়?

বলি তো। ‘চোখের বালি’ আজও বুঝি না কী করে আশি লাখে বানানো হয়েছিল!

সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের ‘চতুষ্কোণ’ নাকি আপনার খুব প্রিয় ছবি?

ইয়েস, আই লাভড ইট। সৃজিত ইজ আ ব্লাডি গুড ডিরেক্টর। আমি তো অন্তত দশ বার ওকে বলেছি আমার জন্য ছবি করতে। তার পর ওর পা ভাঙল। সৃজিতের মতো ট্যালেন্টের সঙ্গে কথা বলতে ভাল লাগে। ওর সঙ্গে কাজ করতে আমি খুব ইচ্ছুক। কিন্তু এটার সঙ্গে সঙ্গে আমি কিন্তু ওকে হিংসেও করি। যে কোনও ভাল কাজ দেখলে আমার খুব হিংসে হয়।

ইদানীং কোন ছবি দেখে আপনার হিংসে হয়েছে?

সুজিতের ‘পিকু’ দেখে ভীষণ ভীষণ হিংসে হয়েছে। খালি মনে হয়েছে, ভগবান! সুজিতকে বুদ্ধিভ্রষ্ট করে দাও, ও যেন আর ছবি বানাতে না পারে। (হাসি)

জানেন আপনার কথাবার্তাও অনেকটা ঋতুপর্ণ ঘোষের মতো।

(হাসি)

থ্যাঙ্ক ইউ। বেস্ট অব লাক ফর ‘বাজিরাও মাস্তানি’ মিস্টার বনশালী...

থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন