চিন্ময় রায়। রেখে গিয়েছেন তাঁকে নিয়ে অনেক গল্পকথা আর কিছু ভাল ছবি।
সেই ‘চারমূর্তি’ ছবিতে হাঁড়ি আঁকড়ে বসে তাঁর রসগোল্লা খাওয়ার দৃশ্যটা আজও আইকনিক! ব্যক্তিজীবনেও চিন্ময় রায় খাদ্যরসিক ছিলেন। এক বার সন্ধ্যা রায়ের সঙ্গে একটি অনুষ্ঠানে গিয়েছেন চিন্ময়। উদ্যোক্তারা অতিথিদের মিষ্টি খাওয়ানোর পরে সন্ধ্যা রায়ের জন্য আলাদা করে এক হাঁড়ি মিষ্টি গাড়িতে তুলে দেন। সন্ধ্যা বাড়ি ফিরে দেখলেন, হাঁড়ি উধাও! ঘটনার দিন চারেক পরে অভিনেত্রীর বাড়িতে ফোন আসে। ‘‘মিষ্টি খেলাম অনেক। ছানার জিলিপি... আরও কত কী! হাঁড়িতে অবশ্য নাম লেখা ছিল ‘সন্ধ্যা রায়’। কিন্তু আমি খেয়ে নিলাম। ভাবলাম সন্ধ্যা তো খায় না। আমি ভালবাসি, আমিই খাই। খেয়ে নিয়ে ফোন করব!’’ বক্তা চিন্ময় রায়। অভিনেতার স্মৃতিচারণায় কথাগুলো বলছিলেন সন্ধ্যা। হাঁড়িটি আসলে ভুল করে চিন্ময়ের গাড়িতে রাখা হয়েছিল!
রবিবার রাতে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে চলে গেলেন চিন্ময় রায়। রেখে গিয়েছেন তাঁকে নিয়ে অনেক গল্পকথা আর কিছু ভাল ছবি। ‘বসন্ত বিলাপ’, ‘চারমূর্তি’, ‘ননীগোপালের বিয়ে’...
বরানগরে ছোটবেলা কেটেছিল তাঁর। আদতে অবশ্য তিনি পূর্ববঙ্গের মানুষ। হইচই করে আড্ডা দিতে ভালবাসতেন। যে কারণে শুটিংয়ের কলটাইমের আগেই হাজির হয়ে যেতেন সেটে। ‘‘চিন্ময় ভীষণ টিমম্যান ছিলেন। দশটায় কলটাইম হলে চলে আসতেন ন’টার সময়। মেকআপ রুমে সকলের সঙ্গে বসে আড্ডা দেবেন বলে। এই কালচার আর আছে কি না আমার জানা নেই,’’ বলছিলেন পরিচালক তরুণ মজুমদার। যাঁর ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’, ‘ঠগিনী’, ‘ফুলেশ্বরী’তে অভিনয় করেন চিন্ময়।
বসন্ত বিলাপ
জহর রায়, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, রবি ঘোষের পরে কৌতুক চরিত্রে দক্ষ অভিনেতা হিসেবে চিন্ময়ের নাম উচ্চারিত হতো। কমিক চরিত্রে বেশি অভিনয় করলেও সব ধরনের কাজেই সমান স্বচ্ছন্দ ছিলেন তিনি। গ্রুপ থিয়েটারও করতেন নিয়মিত। তবে আক্ষেপ ছিল, সিনেমার ক্ষেত্রে শুধু কমিক চরিত্রেই তাঁকে ভাবা হতো বলে। ‘‘অন্য ধরনের তেমন কোনও চরিত্র না পাওয়ার দুঃখ ছিল ওঁর,’’ বলছিলেন সন্ধ্যা।
চিন্ময় বিয়ে করেছিলেন জুঁই বন্দ্যোপাধ্যায়কে। ‘বালিকা বধূ’তে প্রথম দেখেছিলেন তাঁকে। সরাসরি গিয়ে বিয়ের প্রস্তাব দেন। এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘‘প্রেমে পড়লে বেশি দিন ফেলে রাখতে নেই। লজ্জা না করে প্রোপোজ় করতে হয়।’’ ব্যক্তিজীবনেও মানুষটা এতটাই আমুদে ছিলেন।
চারমূর্তি
খাদ্যরসিক মানুষটি নিজে রাঁধতেও ভালবাসতেন। ছুটির দিন মানেই খাওয়াদাওয়া আর আড্ডা! ইন্ডাস্ট্রির চিন্ময় রায় কিন্তু বাড়িতে একেবারে বাবারা যেমন হন, ঠিক তেমন ছিলেন। শঙ্খ রায় আর পরমা মুখোপাধ্যায় তাঁর দুই ছেলেমেয়ে। ছেলের কথায়, ‘‘কাজে ব্যস্ত থাকলেও আমরা কী করছি, সে সব দিকে নজর রাখতেন। ছোটবেলায় আমাদের তাড়াতাড়ি ঘুম পাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা হলেও জেগে থাকতাম, বাবা এলে গল্প করব বলে।’’ দুষ্টুমি করার জন্য অবশ্য বাবার কাছে বকুনিও খেয়েছেন।
থিয়েটার, সিনেমার পাশাপাশি গান নিয়েও অসম্ভব প্যাশনেট ছিলেন অভিনেতা। মান্না দে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, লতা মঙ্গেশকর, কিশোরকুমার ছিলেন তাঁর পছন্দের শিল্পী। ছেলে শঙ্খ বলছিলেন, ‘‘বাবা পুরনো দিনের ওয়েস্টার্ন মুভি দেখতে ভালবাসতেন। এখনকার বাংলা সিনেমা দেখতেন না সে ভাবে। টেলিভিশনে ক্রিকেট-ফুটবল, নিউজ় দেখার আগ্রহ ছিল।’’
চিন্ময়ের চলে যাওয়া মানে একটা যুগের অবসান। আজকের দিনে সেই কথাটাই বার বার মনে পড়ছে দীপঙ্কর দে-র। ‘সমাধান’, ‘অন্তর বাহির’-সহ বেশ কয়েকটি ছবিতে চিন্ময় রায়ের সঙ্গে কাজ করেছিলেন তিনি। ‘‘উনি শুধু আমার সহকর্মী ছিলেন না, বন্ধুও ছিলেন। ওঁর অভিনীত চরিত্রগুলোর মতোই মজার মানুষ ছিলেন। অনেক দিন ধরেই শুনছিলাম, অসুস্থ। আমাদের সময়ের এক-এক জন করে চলে যাচ্ছেন। মন খারাপ হয়ে যায়,’’ ভারাক্রান্ত গলা দীপঙ্করের।
‘বসন্ত বিলাপ’ ছবিতে প্রেমিকার উদ্দেশে চিন্ময়ের একটি সংলাপ ছিল, ‘এক বার বলো উত্তমকুমার...’ তাঁর উত্তমকুমার হওয়ার দরকার পড়েনি। দর্শকের মনে তিনি চিন্ময় রায় হয়েই থেকে যাবেন।