বাঙালি আক্রমের নৃত্য-ছন্দে বিশ্বযুদ্ধের স্মরণিকায় ভারত

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের (১৯১৪-১৯১৮) শতবর্ষ স্মরণ-পর্ব চলছে। ব্রিটেনে সমসাময়িক নৃত্যশৈলীতে প্রথম সারির মুখ, বঙ্গতনয় আক্রম খান সেখানে পরিবেশন করছেন নৃত্য-আলেখ্য ‘জ়েনস’।

Advertisement

জাগরী বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০১৮ ১৬:০৯
Share:

মঞ্চে আক্রম। ছবি: ফেসবুক

দেশীয় নবাবের দরবারে নৃত্যশিল্পী ছিল সে। ব্রিটিশের হুকুমে চলে যেতে হল ভিন্ দেশে, যুদ্ধ করতে। যুবক বুঝতে পারে না এ কী হল। শরীরকে নাচের ছন্দে ব্যবহার করতে অভ্যস্ত ছিল, এখানে সেই শরীরই হয়ে উঠছে যুদ্ধের উপকরণ!

Advertisement

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের (১৯১৪-১৯১৮) শতবর্ষ স্মরণ-পর্ব চলছে। ব্রিটেনে সমসাময়িক নৃত্যশৈলীতে প্রথম সারির মুখ, বঙ্গতনয় আক্রম খান সেখানে পরিবেশন করছেন নৃত্য-আলেখ্য ‘জ়েনস’। যার মূল চরিত্র এক ভারতীয় সৈনিক। সম্প্রতি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিতে ক্রিস্টোফার নোলানের ‘ডানকার্ক’ দেখে অনেকের মনেই প্রশ্ন জেগেছিল, ঔপনিবেশিক সৈন্যদের কথা বলা হল না তো! প্রথম বিশ্বযুদ্ধের স্মরণিকায় সেই অভাব থাকছে না, আক্রমেরই সৌজন্যে।

গত দু’দশক ধরে আক্রম ব্রিটেন তো বটেই, সার্বিক ভাবে আন্তর্জাতিক স্তরেই নৃত্যশিল্পী এবং নৃত্যনির্দেশক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। অন্তত ১৪টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার তাঁর ঝুলিতে। কাজ করেছেন জুলিয়েট বিনোশ, কাইলি মিনোগ, অনীশ কপূর, হানিফ কুরেশিদের সঙ্গে। লন্ডন অলিম্পিক্সের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তাঁর নাচ মুগ্ধ করেছিল গোটা পৃথিবীর দর্শককেই।

Advertisement

জন্ম-কর্ম সবই ব্রিটেনে। আক্রম কিন্তু বাংলা বলেন দিব্যি। লিখতে-পড়তেও পারেন, একটু ধীরে। ডাকনাম শুভ। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ থেকে আক্রমের পরিবার ব্রিটেনে চলে আসে। পরের বছরই আক্রমের জন্ম। ছোট্ট বয়স থেকে কত্থক শিখেছেন বিরজু মহারাজের শিষ্য প্রতাপ পওয়ারের কাছে। পিটার ব্রুকের ‘মহাভারতে’ যে বালককে মহামুনি ব্যাস তাঁর আখ্যান শোনান, সে-ই বড় হয়ে আক্রম খান। পিটার তাঁর অন্যতম পথপ্রদর্শক।

ব্রিটেনের মতো দেশে বাদামি চামড়া, ধর্মীয় সংখ্যালঘু পরিচয় নিয়ে এত দূর আসতে বাধা পাননি? আক্রম বলেন, ‘‘প্রতিকূলতাকে আপনি কী ভাবে ব্যবহার করছেন, সেটাই বড় কথা। চাইলে ওটাও আপনার শক্তি হতে পারে!’’ আক্রমের শক্তির উৎস, তাঁর মা আনোয়ারা। আক্রমের বর্ণনায়, ‘‘উনি একজন অগ্নিকন্যা। ঘরে-বাইরে সাম্যের জন্য লড়াই করেছেন।’’ বাংলা এবং ভারতীয় সাহিত্য-সংস্কৃতি, বিশ্বের পুরাণ কাহিনির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন ছোট থেকেই। নাচকে আঁকড়ে এগোনোর সাহস জুগিয়েছেন।

পিটার ব্রুকের হাত ধরে ‘মহাভারতে’র অংশ হয়েছিলেন, পরে নিজের কাজেও ফিরে গিয়েছেন মহাভারতে (আনটিল দ্য লায়ন্স)। বাঙালি আর ব্রিটিশ সত্তার টানাপড়েন ধরা আছে নৃত্যআলেখ্য ‘দেশ’-এ। বিশ্বযুদ্ধকে মনে রেখেই আক্রমের আর একটি কাজ, ‘কাদামাটি’। বাঙালি সংস্কৃতির প্রভাব কতটা তাঁর নাচে? ‘‘অনেকখানি,’’ উত্তর দেন আক্রম। স্বাধীনতা আর বৈশাখী উদযাপনের আবহে বড় হয়েছেন। পঞ্চমুখে বলেন সত্যজিৎ রায়ের কথা। ‘‘ওঁর ছবিতে যে নৈঃশব্দ্য, ওই যে আপাত স্থাণু ক্যানভাস— ওইটা আমার নাচে আনতে চেষ্টা করেছি। সত্যজিতের ফ্রেম আমাকে জাপানি চিত্রশৈলীর কথা মনে করায়।’’

ভারতে এসেছেন আগে, মনে করতে পারেন কলকাতার কলামন্দির প্রেক্ষাগৃহকেও। ‘জ়েনস’ দেখবে না ভারত? ‘‘কথাবার্তা চলছে। কিন্তু এত বড় সেট নিয়ে যাওয়া, বিপুল খরচ।’’ কিন্তু ব্রিটেনে বসে ব্রিটেনেরই গৌরব হয়ে উঠে ‘নেটিভ’ সেনানীর গল্প বলা— ইতিহাস কি একটা বৃত্ত সম্পূর্ণ করল না? আক্রম হেসে বলেন, ‘‘পুনরাবর্তনেও কিন্তু ছেড়ে যাওয়া বিন্দুতে ফেরা হয় না! বিন্দুও পাল্টে যায়, ফিরে আসা মানুষও এক থাকে না। ভারতীয় দর্শন তো তা-ই বলে!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন