লেখায় যত বিবাদ উঠে আসবে ততই ভাল

‘দেশ’ পত্রিকায় লেখক লেখিকাদের নিয়ে তাঁর নানা বিস্ফো‌রক তথ্য তুলছে নতুন নতুন বিতর্ক। কী বলছেন প্রকাশক-লিখিয়ে বাদল বসু? শুনলেন স্রবন্তী বন্দ্যোপাধ্যায় ‘দেশ’ পত্রিকায় লেখক লেখিকাদের নিয়ে তাঁর নানা বিস্ফো‌রক তথ্য তুলছে নতুন নতুন বিতর্ক। কী বলছেন প্রকাশক-লিখিয়ে বাদল বসু?

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৪ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০০:০১
Share:

লেখকদের নিয়ে ধারাবাহিক লিখবেন প্ল্যান করেছিলেন কখনও?

Advertisement

শুনুন তবে, একটা কথা পরিষ্কার বলি। কর্মসূত্রে প্রকাশক হিসেবে বহু গুণী লেখকের সান্নিধ্য পেয়েছি। সেই লেখকদের নিয়েই শুধুমাত্র আমার জমানো চিঠির ওপর ভিত্তি করে স্মৃতি থেকে লিখছি আমার কলম ‘পিওন থেকে প্রকাশক’। এই লেখা তো খুব একটা বড় কিছু ব্যাপার নয়। ‘দেশ’-এর জন্য চার-পাঁচ পাতা করে লেখা। সকলে ভাবছেন আমি বুঝি লেখক! বলুন তো, খামোখা নিজেকে লেখক ভাবতে যাব কেন? আমি উপন্যাস বা ছোটগল্প লিখছি কি?

Advertisement

কিন্তু উপন্যাস বা ছোটগল্পের চেয়েও এখন এই লেখা নিয়ে বেশি চর্চা হচ্ছে। প্রতিক্রিয়াগুলো একটু বলবেন?

চর্চা তাঁরাই করছেন, যাঁরা লেখকের সঙ্গে যুক্ত। ধরুন অমর্ত্য সেনকে নিয়ে লিখছি। অমর্ত্য সেনকে নিয়ে যাঁদের আগ্রহ, তাঁরাই লেখাটা পড়বেন। আর এ রকম লোকও প্রচুর আছেন যাঁরা বলবেন কে অমর্ত্য সেন? তাঁকে নিয়ে পড়তে যাব কেন? আসলে ভালমন্দ দু’ধরনের প্রতিক্রিয়াই আছে।
কেউ বলছেন আহা, বাদলবাবু আপনার লেখার জন্য বসে থাকি। ওই যে নীরদ সি চৌধুরীর অফিশিয়াল কনট্র্যাক্টটা ছাপালেন, তার ইংরেজিটা পড়ে আমরা নতুন করে ইংরাজি শিখলাম। আবার কেউ বলছেন বাদলবাবু কর্মসূত্রে বিখ্যাত লোকেদের সঙ্গে মিশেছেন। ওঁর লেখায় বড় বড় নাম উল্লেখ করে সেটাই বোঝাতে চান।

এগুলো তো সাধারণ প্রতিক্রিয়া। কিন্তু আপনাকে লেখা লেখকদের চিঠি আপনি ছেপে দিচ্ছেন। জয় গোস্বামীর কথা যদি ধরি, জয়-এর ব্যক্তিগত চিঠি প্রকাশ করা কি ঠিক হচ্ছে?

(উত্তেজিত হয়ে) দাঁড়ান, দাঁড়ান। এটা ব্যক্তিগত চিঠি কোথায়? কোম্পানির সঙ্গে কবি জয় গোস্বামীর চিঠি আদানপ্রদান হয়েছে। সমস্তটাই ‘অফিশিয়াল’। না ছাপার কী আছে? আর ‘দেশ’-এ এই ধারাবাহিকের অনেকগুলো সংখ্যাই তো বেরোল। এখনও পর্যন্ত কোনও লেখক বা তাঁর পরিবারের কেউ তো আমাকে বলেননি যে, আপনি কেন এ সব লিখছেন? মিথ্যে বা ভুল কিছু লিখলে তাঁরা নিশ্চয়ই প্রতিবাদ জানাতেন। প্রতিবাদ তো হয়নি। বরং উল্টোটাই হয়েছে।

উল্টো মানে?

এই তো সত্যজিৎ রায়ের কথা যখন লিখছি। লিখতে লিখতে মঙ্কুদির (বিজয়া রায়) কথা চলে এল। মঙ্কুদি বিদেশে গেলেই একটা সুগন্ধী আর একটা চকোলেট কিনতেনই। সুগন্ধীর নাম ছিল ‘টস্কা’। কিন্তু চকোলেটের নামটা কিছুতেই মনে করতে পারছিলাম না। সন্দীপ রায়কে জিজ্ঞেস করতে উনি বললেন, ‘মায়ের এই শখের কথা তো আমরা জানতাম না!’ পরে ওঁর পরিবারে অনেকের থেকে খোঁজ নিয়ে জানা গেল চকোলেটটা ছিল ‘আফটার এইট’। লিখতে লিখতে অনেক নতুন তথ্যও বেরিয়ে আসছে। তাতে লোকেরা খুশিও হচ্ছে। যেমন নীরদ সি চৌধুরীর ছেলে ধ্রুবনারায়ণ চৌধুরী ফোন করে বললেন, ‘আমাদের তিন ভাইয়ের, বাবার লেখালিখির কপিরাইট নিয়ে নানা প্রশ্ন ছিল। আপনার লেখায় সেটা দূর হল।’

জয় গোস্বামীর ফোন পাননি?

না, জয়ের ফোন পাইনি। তবে জয়ের স্ত্রী কাবেরী প্রত্যেক বারের মতো এ বারেও আমার জন্মদিনে ফোন করে শুভেচ্ছা জানিয়েছে। জয়কে নিয়ে আমার লেখার বিষয়ে ওর সঙ্গে কোনও কথা হয়নি।

বাজারসফল লেখকের তো বায়নাক্কা থাকেই। শক্তি চট্টোপাধ্যায় তাঁর লেখকজীবনে প্রচুর প্রশ্রয় পেয়েছিলেন। জয় গোস্বামীর বেলাতেই...

(থামিয়ে দিয়ে) আগে শুনুন। শক্তি চট্টোপাধ্যায় মানুষটা বোহেমিয়ান ছিলেন। টাকাপয়সা নিয়ে জীবনে কখনও মাথা ঘামাননি। আর যাই হোক, আমি এটুকু জানি যে উনি কখনও আমাকে বলবেন না, ‘আমি কবি আর আপনি কর্মচারী’। দেখুন, আমি কাউকে ছোট করছি না। জয় জয়ের জায়গায়। শক্তি শক্তির জায়গায়। অন্যায়টা কী করেছি বলুন তো? জয় আমাকে নিয়ে ব্যঙ্গ করে কবিতা লিখেছিল। সেটা যদি ছাপতে পারি, তা হলে চিঠি ছাপতে দোষটা কোথায়?


জয়ের চিঠি ছাপার পর কবিতামহল থেকে কোনও ফোন এসেছিল?

না, ফোন তো আসেইনি। উপরন্তু যে সব কবি ফোন করে আগের লেখা নিয়ে মতামত দিয়েছেন, তাঁরা দেখলাম ফোন করাই বন্ধ করে দিয়েছেন। কবিমহল থমথমে। কেন, তার ব্যাখ্যা আমি দিতে পারব না। তবে মিতালি নামে একটি মেয়ে ফোন করেছিল পনেরো বছর পর। সে অনেক দিন আগের কথা। তখন জয়ের বয়স অল্প। মজা করে আমি বলতাম, ‘মিতালি জয়কে বিয়ে করো।’ সেই মিতালি ফোনে হেসে বলল, ‘লেখাটা পড়লাম। ভাগ্যিস জয়কে বিয়ে করিনি।’ আমার লেখা নিয়ে সমালোচনা হোক না। আসুক না মতামত। আমি সমস্ত প্রশ্নের উত্তর দিতে প্রস্তুত।

আপনার লেখা নিয়ে তসলিমা তো চিঠি পাঠিয়েছেন। ফেসবুকেও দেখলাম আপনাকে ঘিরে নানান কুকথা। এটার জন্য কি প্রস্তুত ছিলেন?

দেখুন প্রমাণপত্র নিয়ে আমি বসে আছি। কেউ ফোঁস করলেই উত্তর দেব। তসলিমার চিঠির উত্তর আমিও ‘দেশ’-এ দিয়েছি। তসলিমা বলেছিলেন আমি ফালতু লোক, মিথ্যেবাদী। বানিয়ে বানিয়ে লিখেছি উনি ধূমপান করেন। আমি অমনি তসলিমার ধূমপান করার ছবি ‘দেশ’-এ ছাপিয়ে দিয়েছি। দরকার হলে আরও দেব। এত রিঅ্যাক্ট করার কী আছে? পরের লেখায় তো লিখেছি তসলিমা কত জনপ্রিয় লেখিকা ছিলেন। ওঁর ‘নির্বাচিত কলাম’, ‘লজ্জা’ যে রকম হুহু করে বিক্রি হয়েছিল, খুব কম লেখকের বই-ই এত দ্রুত বিক্রি হয়েছে। এগুলোও তো লিখছি। সে সব পড়লেনই না। একটু অপেক্ষাও করলেন না। দুম করে আমাকে যা নয় তাই বলতে শুরু করে দিলেন।

আটাত্তর বছর বয়সে এই চাপ নেওয়ার কি খুব প্রয়োজন ছিল?

চাপের তো কিছু নেই!

চাপ নেই? লেখকের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কথা বলছেন। জয় গোস্বামী একজন কবি। পাঠক তাঁর এই চিঠি পড়ে বা আপনার লেখা পড়ে তাঁর কবিতা আর পড়বে না? বা কবিতার বই কম বিক্রি হবে?

জয়কে নিয়েই কেন বারবার প্রশ্ন করছেন বলুন তো? জয়ের কবিতার বই আজও প্রচুর বিক্রি হয়। বোঝাই যাচ্ছে এই লেখার সঙ্গে বই বিক্রির কোনও সম্পর্ক নেই। আর ব্যক্তিগত জীবন? আচ্ছা বলুন তো, আজও রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কেন কথা হয়? রবীন্দ্রনাথের প্রেম তো হটকেকের মতো বাজারে বিক্রি হচ্ছে। কী না হচ্ছে! সিনেমা, সিরিয়াল! উফ, সিরিয়াল যেটা হচ্ছে, সেটা তো দেখা যায় না। শুধু কি রবীন্দ্রনাথ? সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মদ্যপানের প্রসঙ্গও তো বারবার উঠে আসে। এ-ও শুনি, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় ওঁকে বারণ করতেন মদ্যপান করতে। কিন্তু এটা হয়তো অনেকে জানেন না, সেই সুনীলই বন্ধু শীর্ষেন্দু কোনও ঝামেলায় পড়লে ছুটে যেতেন। আমার তো মনে হয় লেখায় যত বেশি ব্যক্তিগত জীবন এবং বিবাদ থাকবে, ততই ভাল।

রমাপদ চৌধুরী স্মৃতিকথা লিখতে গিয়ে বলেছিলেন সেখানে যেন আত্মকথন না আসে। রবিশঙ্করের সঙ্গে যতই বিবাদ হোক, সত্যজিৎ রায় কোনও দিনই তা প্রকাশ্যে আনেননি। কিন্তু আপনার লেখায় নানা বিবাদ উঠে আসছে...

প্রথম কথা, আত্মকথন আমার লেখাতেও নেই। তবে আমি মনে করি যত বিবাদ উঠে আসবে, ততই সেই লেখককে নিয়ে জানার ক্ষেত্রটা বাড়বে। বিখ্যাত লেখকদের নিয়ে গবেষণার ক্ষেত্রে সেটা কাজে দেবে বলে আমি বিশ্বাস করি।

সাড়ে তিন হাজার চিঠি এবং প্রায় সম পরিমাণ ছবি আপনার সংগ্রহে। আপনি তা হলে মানছেন তো, বাংলার সাহিত্যিকদের জানার ক্ষেত্রে আপনি জলজ্যান্ত আর্কাইভ?

আমি কিন্তু এ সব একবারও বলছি না। আমি সাইকেল চালিয়ে পিয়নগিরি করতাম। পরবর্তী কালে প্রকাশক হয়েছি। কোনও দিন লেখক হব ভাবিনি। তা হলে তো ডায়েরি লিখতাম।

প্রকাশকরা যখন স্মৃতিকথা লিখতে কলম ধরেছেন, তখন তাঁদের লেখায় বইপাড়ার ইতিহাস, বইয়ের সংস্করণের নথি, বই সংক্রান্ত নানা তথ্য উঠে এসেছে। আপনার স্মৃতিকথায় সেগুলো পাচ্ছি না কিন্তু।

আমি বইয়ের ইতিহাস লিখছি না। প্রকাশনার ইতিহাসও লিখছি না। সুতরাং এই ধরনের তথ্য আমার লেখায় আশা করাটা ঠিক নয়।

আত্মসমালোচনা করেছেন কখনও?

কেন করব না? আমার ভুলের জন্য কত পাণ্ডুলিপি খুইয়েছি। সেটা তো লিখেওছি আমি। দেখুন, আমি প্রকাশক ছিলাম। সবজান্তা নই। সব বিষয়ে আমার জ্ঞান ছিল না। একবার সুখময় ভট্টাচার্যের ‘সংস্কৃতানুশীলনে রবীন্দ্রনাথ’ নামের এক পাণ্ডুলিপি আমার হাতে আসে। বিশেষজ্ঞের পরামর্শে সেটা বাতিল করেছিলাম। এটা আমার ভুল ছিল।

মহিলা লেখকদের নিয়ে কি কম লিখছেন?

একটু ধৈর্য ধরুন। সব পাবেন। স্মৃতিতে যেমন আসছে, লিখছি। মহিলা, পুরুষ এ ভাবে তো আলাদা করা যাবে না! সুকুমারী ভট্টাচার্য, বাণী বসু, কেতকী কুশারী ডাইসনের কথাও তো লিখছি। অপেক্ষা করতে হবে!

এখন বাংলা সাহিত্যে মরা গাঙ। একজন প্রকাশক হিসেবে আপনার কী মনে হয়?

এখন কিন্তু আমি আর প্রকাশক নই। এ বিষয়ে কিছু বলা বোধহয় ঠিক হবে না।

অভিজ্ঞতা থেকে বলুন না...

দেখুন শূন্যতা কিন্তু আসবেই। বঙ্কিম ছিলেন। তার পর তারাশঙ্কর-মানিক-বিভূতি। কিছু দিন আবার শূন্যতা। তার পর সুনীল-শীর্ষেন্দু-সমরেশ। এ রকমটাই হয়ে আসছে। ধারাবাহিক বঙ্কিম কি কখনও হয়? আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।

সারা জীবন তো বহু লেখককেই সাহায্য করেছেন। তাঁদের পরিবারের একজন হয়ে গিয়েছেন। কোন লেখক আপনাকে সবচেয়ে আনন্দ দিয়েছেন?

আমি সৌভাগ্যবান যে সলমন রুশদি, গুন্টার গ্রাসের মতো ব্যক্তিত্বের সঙ্গ পেয়েছি। সুনীলের মতো লেখকের সঙ্গে বহু দিন-রাত কেটেছে আমার। সুনীল বটবৃক্ষের মতো। নিউ ইয়র্কের বিলাসবহুল হোটেলেও যেমন থাকতে পারত, তেমন আমলাশোলেও দিব্যি কাটিয়ে দিতে পারত। সব ধরনের সহনশীলতা ওর মধ্যে ছিল। বাংলা সাহিত্য ওর কাছে ঋণী।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন