লিলি চক্রবর্তী। —ফাইল চিত্র।
উত্তম কুমারের আগামী বছর শতবর্ষ। বলতেই তিনি বলে উঠলেন, “এ বছর আমার ৮৩ পেরিয়ে ৮৪।” লম্বা সফর, দীর্ঘ অভিনয় জীবন। বিশেষ দিনে কি অতীত স্মরণ করেই কাটে সারা বেলা? বললেন, “যতটুকু বলব ততটুকুই লিখবেন তো?” কথা দিতেই অনর্গল লিলি চক্রবর্তী।
প্রশ্ন: জন্মদিনটায় কী করেন?
লিলি: আমি তো কিছুই করি না। একা বাড়িতে থাকি এখন। এক বোনঝি আছে। ও অফিস যায়। ফিরে কেক কাটে। কয়েকজন হয়তো আসবেন। এমনিই আসেন, ভালবাসেন বলে। তাঁদের মিষ্টি খাওয়াব। এই, ব্যস।
প্রশ্ন: আগে নিশ্চয় খুব ধুমধাম হত?
লিলি: আগে আমার স্বামী পার্টি দিতেন। বাড়ির সবাই এসে খাওয়াদাওয়া করতেন।
প্রশ্ন: উত্তম কুমার তাঁর ‘বৌঠান’-এর জন্মদিনে আসতেন না?
লিলি: না, আসতেন না। কারণ, আমার স্বামী আমাদের সব আত্মীয়, আমার মা-বাবা— এঁদের আমন্ত্রণ জানাতেন। একদম ঘরোয়া পার্টি। বাইরের কেউ বা ইন্ডাস্ট্রির কাউকে কখনও আমন্ত্রণ জানানো হয়নি।
প্রশ্ন: পছন্দের পদ রাঁধা হত?
লিলি: সে হত। পায়েস রাঁধা হত। পাঁঠার মাংস, মাছ। যে কোনও বাঙালি পদ আমার প্রিয়। মাংসের চেয়ে মাছের পদ বেশি ভালবাসি।
প্রশ্ন: জন্মদিনটা এলে অতীত ফিরে দেখেন?
লিলি: আমি কখনও পিছনে ফিরে দেখি না! অনেক ভাল কিছু ঘটেছে। অনেক কিছু সহ্যও করতে হয়েছে। এগুলো সব স্মৃতি এখন। যা চলে গিয়েছে তা নিয়ে আর মাথা ঘামাই না। কাউকে বলিও না। এগিয়ে যাওয়ার কথা ভাবি। (একটু থেমে) আর ক’দিনই বা এগোব।
প্রশ্ন: আগামী দিনের জন্য কি কিছু ঠিক করে রাখেন?
লিলি: কিচ্ছু আগাম ঠিক করি না। যা আসবে সেটা মেনে নেব। এখন যেমন সিরিয়াল করি না। করবও না বলেছিলাম। কারণ, আমার পছন্দের সঙ্গে মেলে না। গল্প গোড়ায় ঠিক থাকে। শেষের দিকে সব এক। ভাল লাগে না। এই জন্য ধারাবাহিক ‘নিমফুলের মধু’র কাজ শেষে ছেড়ে দিয়েছি। বদলে ছবি করছি। কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘অর্ধাঙ্গিনী ২’তে কাজ করলাম। ছবিও তো সে রকম হচ্ছে না। মানে, ছবিতে আমাদের মতো চরিত্র নিয়ে কেউ ভাবে না।
প্রশ্ন: পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়ের ‘এই রাত তোমার আমার’ ছবি কিন্তু প্রবীণ দম্পতির গল্প নিয়ে তৈরি।
লিলি: হ্যাঁ, কয়েকজন ভাবেন। কিন্তু সেই সংখ্যা কম। বেশির ভাগই ভাবেন না। যাঁরা আমাদের নিয়ে ভাববেন, ভালবেসে কাজ দেবেন, তাঁদের সঙ্গে কাজ করব। না হলে বসে থাকব।
প্রশ্ন: লিলি চক্রবর্তীর দিন কাটে কী করে?
লিলি: অনেক কিছু করে। সকালে যোগ ব্যায়াম করি। শরীরটাকে ভাল রাখতে হবে তো। বাইরে বেরোতে পারি না। বাড়িতেই কয়েক পাক জোরে জোরে হাঁটি। তার পর স্নান করে পুজো। একটু টিভি দেখি। ধারাবাহিক নয়, খেলা দেখি। যেমন, ক্রিকেট খেলা দেখছিলাম। এ ভাবেই কেটে যাচ্ছে। বই বেশি পড়তে পারি না। চোখে লাগে।
প্রশ্ন: সবাই বলেন, স্মৃতি সততই সুখের...
লিলি: আমার সবই সুখের। মেনে নিয়েছি অনেক কিছু। আমার সঙ্গে ভালই হয়েছে। এখন মানা, না মানা সমান। হয়তো বলবেন, আপনি তো নায়িকা হননি। তার পরেও বলব, আমি যা পেয়েছি না, অনেকেই পায়নি! অনেক ভাল ভাল পরিচালকের সঙ্গে কাজ করেছি। সত্যজিৎ রায়, তপন সিংহ, তরুণ মজুমদার, চিত্ত বসু, মুম্বইয়ের গুলজ়ার, হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে কাজ করেছি। যাঁদের সঙ্গে কাজ করেছি, যাঁদের সঙ্গ পেয়েছি— এখন দেখি তাঁদের থেকে অনেক ভাল আছি। সবটাই আমার ভাগ্যের জোরে পেয়েছি।
প্রশ্ন: ভাল কিছু পেতে গেলে কিছু তো ত্যাগও করতে হয়...
লিলি: আমায় কিচ্ছু স্যাক্রিফাইস করতে হয়নি। ঘরে বসেই এই সমস্ত পরিচালকদের সঙ্গে কাজের সুযোগ পেয়েছি। কারও কাছে গিয়ে বলতে হয়নি, আমায় কাজ দাও। আমি করব। জানেন, আমার অনেক রোল অনেকে কেড়ে নিতে চেয়েছেন!
প্রশ্ন: তাই?
লিলি: হ্যাঁ। যাঁরা নিয়েছেন, নিয়েছেন। তাঁরা কি আমার ভাগ্য কেড়ে নিতে পেরেছেন? মুম্বইয়ে বসে সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে অভিনয়ের ডাক পেয়েছি। ‘ফুলেশ্বরী’তে অভিনয়ের জন্য মুম্বই থেকে ডেকে নিয়ে এসেছেন তরুণ মজুমদার। একদম নতুন আমি তখন। অজয় কর, তপনবাবু ডেকে কাজ দিয়েছেন।
প্রশ্ন: শুরু থেকেই অভিনেত্রী হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন?
লিলি: ছোটবেলা থেকেই অভিনয় ভালবাসতাম। মধ্যপ্রদেশে বড় হয়েছি। ওখানে বাঙালিদের উৎসবে কয়েক ঘর বাঙালি মিলে নাটক করতাম, অনুষ্ঠান করতাম। আমার মা পরিচালনা করতেন। হয়তো তখনই অভিনয়ের প্রতি ভালবাসাটা তৈরি হয়। আমরা অনেক ভাই-বোন, কষ্টের সংসার। বাবা ঢাকা থেকে কলকাতায় চলে এসেছিলেন। প্রত্যেকেই কিছু না কিছু করে বাবাকে আর্থিক দিক থেকে সহায়তা করতেন। আমার মেজদি নাটক করত। একদিন মেজদি আমাকে মহড়ায় নিয়ে গিয়েছিল। সেখানে পরিচালক আমায় প্রথম একটি দৃশ্যে ছোট্ট একটি পার্ট দিয়েছিলেন। সেখান থেকে অন্য অফিস ক্লাবের নাটকে কাজ পাই। সেখান থেকেই পরিচালক কনক মুখোপাধ্যায়ের ভাই ‘ভানু পেল লটারি’তে সুযোগ দিলেন! ৬৬ বছর আগে প্রথম উপার্জন ৫০ টাকা। বাবার হাতে গর্বের সঙ্গে তুলে দিয়েছিলাম! সেই শুরু। ‘সূর্যস্নান’ ছবিতে শম্ভু মিত্রের বিপরীতে দ্বিতীয় নায়িকা হয়েছিলাম।
প্রশ্ন: সিনেমায় তখনও সকলে ‘নামতেন’ এখনও ‘নামা’ কথাটাই চলে...
লিলি: আমার বাড়ি থেকে কিন্তু আপত্তি ছিল না। কারণ, আমার মা নিজে নান্দীকার নাট্যদলে অভিনয় করতেন। আমার স্বামীও বুঝেছিলেন। তিনিও একটি ছবি করতে এসেছিলেন। সেটা না করে শেষ পর্যন্ত আমাদের সংসারের হাল ধরেছিলেন। ওঁর পরামর্শেই বরাবর চলেছি।
প্রশ্ন: শোনা যায়, অনেক কিছুর বিনিময়ে ছবিতে কাজ মেলে!
লিলি: আমাকে কিচ্ছু দিতে হয়নি। শুনি ইদানীং। ভাবি, কী করে বলে! তা হলে কাজ না করলেই তো পারে। আমি হলে তো করতাম না। এ রকম বিনিময় প্রথা আমি অন্তত দেখিনি।
প্রশ্ন: আপনাদের সময়ে তা হলে বোধহয় হয়তো বিনিময় প্রথার চল কম ছিল...
লিলি: কম ছিল না! আমার সময়ে এ রকম অনেককেই দেখেছি প্রযোজকের ঘরে যেতে। নিজেরাই আবার গল্প করত, প্রযোজকের বাড়ির বাজার পাঠিয়ে দিয়েছি। আমার সঙ্গে এ রকম কিছু ঘটেনি।
প্রশ্ন: ‘কম্প্রোমাইজ়’ করেননি বা করতে হয়নি বলেই কি নায়িকা হননি?
লিলি: আমার কোনও দিন নায়িকা হওয়ার ইচ্ছেই ছিল না। নায়িকা হব ভাবিনি। বরাবর অভিনেত্রী হওয়ার শখ ছিল। যার জন্য প্রচুর ভাল ভাল চরিত্র পেয়েছি। ওই চরিত্রগুলোতে অভিনয় করে যথেষ্ট সুনাম কুড়িয়েছি। যদিও এ রকম অনেক চরিত্র হাতছাড়াও হয়েছে....
প্রশ্ন: কী রকম?
লিলি: প্রযোজক আমায় অ্যাডভান্স দিয়েছেন। অন্য অভিনেত্রী সেই চরিত্র কেড়ে নিয়েছে! আমি টাকা ফেরত দিতে চেয়েছি। প্রযোজকেরা নেননি। বলেছেন, “আপনি করতে চাননি, এমনটা তো নয়! আমরা নেব না।” অথচ যে সব অভিনেত্রী কাজ কেড়ে নিয়েছেন, তাঁরা কিন্তু সামনে ভীষণ মুখে মিষ্টি ছিলেন।
প্রশ্ন: ‘দেয়ানেয়া’তে আপনি উত্তম কুমারের ‘বৌঠান’। আরও অনেক ছবিতে একসঙ্গে কাজ করেছেন আপনারা। মানুষটা কেমন ছিলেন?
লিলি: ভীষণ ভাল। আমায় ‘বৌঠান’ বলেই সম্মান করতেন। কখনও কোনও খারাপ আচরণ পাইনি। এত ভাল মানুষ খুব কম দেখেছি। প্রচুর দান-ধ্যান তাঁর। কিন্তু নিজের বাঁ হাতকে ডান হাতের কাজ জানতে দিতেন না! ওঁর অভাবে বাংলা ছবির ভবিষ্যৎ একটা সময় অন্ধকার হয়ে পড়েছিল। শেষ যাত্রায় সারা শহরের সব বয়সের নারী-পুরুষ বুক চাপড়ে কেঁদেছিলেন। ওঁর চলে যাওয়ার ৪৫ বছর পরেও উত্তম কুমারকে নিয়ে হাহাকার! ওঁর অভাব যেন পূরণ হওয়ার মতো নয়। উত্তম কুমার থাকলে আরও কত কাজ করতেন।
প্রশ্ন: তা হলে উত্তম কুমারকে ঘিরে এত গুঞ্জন কেন? অনেকেই নাকি তাঁদের পরিবারের মেয়েদের তাঁর কাছে ঘেঁষতে দিতেন না!
লিলি: (উত্তেজিত কণ্ঠে) সেটা মেয়েদের সমস্যা। ওঁর নয়। উত্তম কুমারকে দেখলে মেয়েরা নিজেরাই নিজেদের সামলাতে পারত না। দোষ হত উত্তম কুমারের। উনি কখনও কোনও মেয়ের কাছে যাননি। মেয়েরা তাঁর গায়ে পড়ত।
প্রশ্ন: টলিউড হাহাকার করে মহুয়া রায়চৌধুরীর মৃত্যু নিয়েও...
লিলি: খুব মিষ্টি মেয়ে। দারুণ মিশুকে। আমি অনেক ছবিতে ওর মা হয়েছি। মহুয়া তাই ‘মামণি’ ডাকত। মনে আছে, ‘অমৃতকুম্ভের সন্ধানে’ ছবির আউটডোরে গিয়েছি। মহুয়া সারাক্ষণ আমার সঙ্গে ছিল। ওর মৃত্যুটা মেনে নিতে পারিনি।
প্রশ্ন: মহুয়া সত্যিই খুব দুঃখী ছিলেন?
লিলি: তা নয়। ওই যে বললাম, খুব মিশুকে ছিল। কাজের পরে বন্ধুদের সঙ্গে একটু-আধটু ড্রিঙ্ক করত। ওর বর তিলক চক্রবর্তী সেটা মানতে পারত না। অথচ ওর ড্রিঙ্কের অভ্যাস বরের জন্যই হয়েছিল। একটা মেয়ে কখনও বাচ্চার দুধ গরম করতে গিয়ে আগুনে পুড়ে মারা যায়? হয় নাকি কখনও! কিছু একটা অস্বাভাবিক ছিল। কেউ ধরতে পারেনি সেটা।
প্রশ্ন: আপনার সময়ের টলিউড আর এখনকার টলিউডের মধ্যে অনেক ফারাক। বাংলা ছবির কি সার্বিক উন্নতি হয়েছে?
লিলি: সার্বিক উন্নতি হলে বাংলা ছবি তৈরির সংখ্যা বাড়ত। বাড়ছে কই? ছবি ভাল ব্যবসা করলে প্রযোজকেরা দু’দিন অন্তর পালিয়ে যেতেন না! তার মানে ভাল ছবি হয় না, তা তো নয়। সে রকম ছবি তৈরি হলে দর্শক দেখেনও। ছবি ভাল না হলে তাঁরা মুখ ফিরিয়ে নেবেন।
প্রশ্ন: এর জন্য কি টলিউডের অন্দরের কোন্দল দায়ী?
লিলি: কিছুটা তো বটেই। অন্তত, খবরের কাগজ পড়ে সেটাই মনে হয়। প্রত্যেকে ‘আমি’, ‘আমার’ করতেই ব্যস্ত। ‘আমরা’ বা ‘আমাদের’ না হলে ইন্ডাস্ট্রির ভাল হবে কী করে!
প্রশ্ন: টলিউডের অনেক কিছু বদলালেও একটা বিষয় এখনও এক। নায়ক-নায়িকাদের নিয়ে গুঞ্জন।
লিলি: যেমন?
প্রশ্ন: যেমন, শুভশ্রী-দেব-রুক্মিণী?
লিলি: (ফের উত্তেজিত) পুরোটাই সংবাদমাধ্যমের তৈরি। ১০ বছর পরে ‘ধূমকেতু’ মুক্তি পাচ্ছে। খুব ভাল কথা। তা বলে ওরা প্রেম করতে যাবে কেন! যা ছিল তা ছিল। সেটা মিটে গিয়েছে। শুভশ্রী বিবাহিত। ওর সংসার রয়েছে। দেবও তো রুক্মিণীর সঙ্গে সম্পর্কে রয়েছে। অবশ্যই জনপ্রিয় জুটি আবার ছবি করতে পারে। তা বলে কেন খামোখা আবার প্রেমে জড়াবে?
প্রশ্ন: আপনি কখনও কারও প্রেমে পড়েননি?
লিলি: (হেসে ফেলে) মিঠুন চক্রবর্তী আমার পুরনো দিনের ছবি দেখে একই প্রশ্ন করেছিলেন! বলেছিলেন, বেশ লাবণ্যময়ী। বিশ্বজিৎ চট্টোপাধ্যায়-সহ অনেকেই সেখানে উপস্থিত। বিশুদা হাসতে হাসতে বলেছিলেন, ওর মুণ্ডু একজনই ঘুরিয়েছে। তাকে নিয়েই সুখে সংসারী লিলি। (একটু থেমে) খুব অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে গিয়েছিল তো!