Entertainment news

ফিল্ম রিভিউ ‘আড্ডা’: সবথেকে বড় পাওনা সৌমিত্র এবং সব্যসাচী

ফিল্মটিকে ‘স্লাইস অব লাইফ’ জঁরের অন্তর্গত বলে দাবি করা হয়েছে। ‘স্লাইস অব লাইফ’ ধারাটি জীবনের মুহূর্ত স্লাইস করে কেটে নিয়ে বাস্তববাদী রীতিতে গল্প বলে ও দেখায়।

Advertisement

মৌসুমী বিলকিস

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ১৩:৪৯
Share:

ছবির একটি দৃশ্য।

টপ অ্যাঙ্গেল মুভিং শটে কলকাতা দেখতে দেখতে ফিল্মের ভেতর প্রবেশ করেন দর্শক। দারুণ ছবি ও মাঝে মাঝে স্যাক্সোফোনের মন কেমন করা আবহ দর্শকের চাহিদা বাড়িয়ে দেয় প্রথমেই। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের অপূর্ব স্থাপত্যের জ্যামিতিক সৌন্দর্যের পরেই আপাদমস্তক মরা গাছে শকুনের আবাস যেন কিছুটা প্রতীকী হয়েই ভেসে থাকে মনে। যে মানুষগুলি অব্যবহিত পরেই ভেসে উঠবে পর্দায় তাদের জীবন সম্পর্কে যেন প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত দিয়ে যায়। কিন্তু আদতে কি একটা নিটোল গল্পই দেখে ও শোনে দর্শক?

Advertisement

ফিল্মটিকে ‘স্লাইস অব লাইফ’ জঁরের অন্তর্গত বলে দাবি করা হয়েছে। ‘স্লাইস অব লাইফ’ ধারাটি জীবনের মুহূর্ত স্লাইস করে কেটে নিয়ে বাস্তববাদী রীতিতে গল্প বলে ও দেখায়। তাতে না থাকে চরিত্র নির্মাণের দায়, না থাকে গল্প বলার দায়িত্ব। সিনেমায় নিটোল প্লট দেখার পরম্পরাকেই অস্বীকার করে এই রীতি। ফলে ‘আড্ডা’ ফিল্মটি দেখতে বসে নিটোল গল্প পাওয়ার আশা ত্যাগ করতে হবে। কিন্তু কোনও একটি ফিল্মকে কোনও বিশেষ রীতির অন্তর্গত করে দেখা বোধহয় কাম্য নয়।

ফিল্মটির সবথেকে বড় পাওনা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এবং সব্যসাচী চক্রবর্তী। যদিও দু’জনকে এক ফ্রেমে দেখা যায় না দু’-একটি মুহূর্ত ছাড়া। দুই চরিত্র দুই জগতের। সব্যসাচী চক্রবর্তী সাদা দেবদূত। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এ জগতের বাসিন্দা। তাই মুখোমুখি কথোপকথন নেই। সাদা ও কালো দেবদূতের সংলাপ ছন্দে বাঁধা। কঠিন কঠিন বিষয় ছন্দে নিয়ে আসা মোটেও সহজ কাজ নয়। কিন্তু অন্ত্যমিলের খাতিরে যে সব শব্দ চয়ন করা হয়েছে কোথাও কোথাও তা কানের ব্যাঘাত ঘটায়। যেমন, ‘মমতার ক্ষমতা এখনও দেখা বাকি/ হুটপাট এরম রটাস না যে মানুষ বদ্ধ পাজি’। বড্ড ছেলেমানুষি পদ্য। কোথাও কোথাও ছন্দ কেটে গিয়ে বিড়ম্বনা জাগায়। সংলাপ বলার ক্ষেত্রে এ ধরনের পদ্য অভিনেতার সমস্যা তৈরি করতেও পারে। সব্যসাচীর মতো অভিনেতা বলেই হয়তো দক্ষতায় ধরে রাখেন সংলাপ। সত্যজিৎ রায় তো বটেই, এ সময়ের অনীক দত্তও এ ধরনের সংলাপ ব্যবহারে চূড়ান্ত সফল হয়েছেন।

Advertisement

আরও পড়ুন: খারাপ সময়েই শ্রীকান্তের কাছাকাছি এনে দিল সরিতাকে

বড় ভাল লাগে বৃদ্ধদের আড্ডার দৃশ্য। খাটে বসা এক অসুস্থ বৃদ্ধের ঘরের জানলার সামনে বসে তিন বৃদ্ধের কথোপকথন সত্যিই আড্ডার মেজাজ ধরে রাখে। সবুজ জানলা, দেওয়ালের ইটের রং, সামনে বসা তিন বৃদ্ধ ও জানলার ওপারের বৃদ্ধের অবয়ব মিলিয়ে দৃশ্যগত সৌন্দর্যও তৈরি করে। তবে আর একটু দূর থেকে লং শটে দৃশ্যটি দেখতেও ইচ্ছে করে। এই আড্ডায় সৌমিত্র এক ঘরোয়া বৃদ্ধ যিনি সহজ সরল ভঙ্গিতে নিজের বিশ্বাস ব্যক্ত করতে থাকেন। কলেজের উপাচার্য সৌমিত্র এই আড্ডার বাইরের আর এক মানুষ, যদিও চরিত্রর বিশ্বাসটি ধ্রুব। এই জেনারেশন সম্পর্কে যার নেই তেমন কোনও ভালত্বের বোধ। যে বোধে আক্রান্ত ‘আমাদের সময় এ রকম হত না’ সংলাপে আটকে থাকা আমজনতাও।

‘ফিল্ম উইদিন ফিল্ম’ টেকনিকও ব্যবহার করে ফিল্মটি। একটা আস্ত সিকোয়েন্স হয়ে যাওয়ার পর মালুম হয় আসলে তা ছিল একটি শুটিংয়ের অংশ। এই অংশে মেয়েদের খুল্লামখুল্লা আড্ডা শুনে মনে হয় বাংলা ফিল্মের সংলাপের বিষয় সাবালক হইল। ছেলেদের এ রকম আড্ডা আকছার দেখা যায় ফিল্মে। সাম্প্রতিক ‘পরিণীতা’ ফিল্মেও স্কুলের মেয়েদের ‘নিষিদ্ধ সংলাপ’ শোনা গেছে।

আরও পড়ুন: জি বাংলায় এবার দুর্গার ভূমিকায় কে জানেন? দিতিপ্রিয়াকে কি দেখা যাবে এই বারও?

পরিচালক দেবায়ুষ চৌধুরীর প্রথম ফিল্ম ‘আড্ডা’। বেশির ভাগ পরিচালকের প্রবণতা থাকে প্রথম ফিল্মে নিজের বিশ্বাস, অবিশ্বাস, ভাললাগা, মন্দ লাগার যাবতীয় প্রসঙ্গ সন্নিবেশিত করার। এই ফিল্ম সেই প্রবণতা এড়াতে পারেনি বলেই মনে হল। জীবনের স্লাইসের ভেতর যে আড্ডাগুলো পায় দর্শক তাতে আড্ডার থেকে জ্ঞানের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার সংলাপই মুখ্য ভূমিকা নেয়। সব মিলিয়ে যা দাঁড়ায় তাতে চোখ বন্ধ করেও ফিল্মটি বুঝে নেওয়া যায়। অর্থাৎ সংলাপের নিরবচ্ছিন্ন আধিক্য একটি রেডিও নাটকের বোধ জাগায়। সংলাপের আধিক্যওয়ালা ফিল্মও হাজির হতে পারে তার অসাধারণত্ব নিয়ে। সারা বিশ্বের ফিল্মের দিকে তাকালে সে রকম উদাহরণও আমরা পেয়ে যাই। কিন্তু সে সব ফিল্মেরও থাকে নিজস্ব বলার ভঙ্গি। সেই কারণেই তারা কাল্ট বা অঁতর ফিল্মের আসন পেতে পারে। অন্য দিকে, সংলাপ নির্ভর ফিল্মের থাকতে পারে নিছক বিনোদনের তাগিদ। ‘আড্ডা’ সেই তাগিদে সামিল নয়, বলাই বাহুল্য।

কিন্তু ফিল্মের যে নিজস্ব ভাষাভঙ্গি ও বিভঙ্গ তা যেন বাংলা ফিল্ম থেকে হারিয়েই যাচ্ছে। ‘আড্ডা’ সে কথা আবার মনে করিয়ে দিল। প্রায় সংলাপের গায়ে সংলাপ। নৈঃশব্দ খুঁজতে গেলে হা পিত্যেশ করতে হবে। গুটিকয় সংলাপহীন দৃশ্য যন্ত্রসঙ্গীতে ভরা। একটি লেখার মধ্যে যেমন দুই স্তবকের মধ্যবর্তী স্থান পাঠককে দৃশ্যগত ও মানসিক অবসর দেয় সেই কাজটিই সম্ভবত ফিল্মের ক্ষেত্রে নৈঃশব্দ করে থাকে।

আরও পড়ুন: হাসির ফোয়ারা

আরও একটা বিষয়, সাত বছর পরে তিন বন্ধু যখন ফিরে আসে তাদের লুক একই থাকে। খুব অবাস্তব লাগে। চরিত্রের পেশা ও সাতটি বছর চেহারা ও পোশাকে বদল আনবেই। ফিল্মের সিনেমাটোগ্রাফি চমৎকার। ডিওপি রূপেশ শাজি আদ্যন্ত সচেতন। যদিও হ্যান্ড হেল্ড ফিল দেওয়া শটগুলো কোথাও কোথাও আউট অব ফোকাস। এ ধরনের শটে শার্প ফোকাস মেনটেন করা খুব শক্ত। সময়াভাবে শট টেকিং-এর আগে রিহার্সালের সমস্যা থাকেই। সে কথা মনে রেখেও বলা যায়, অব ফোকাস চোখে পীড়া দেয়।

‘আড্ডা’র অন্য অভিনেতারা হলেন সায়নী ঘোষ, সৌরভ দাস, ইন্দ্রাশিস রায়, প্রান্তিক বন্দ্যোপাধ্যায়, দীপাংশু আচার্য প্রমুখ। মিউজিকে শুভম মৈত্র এবং জয়দীপ বন্দ্যোপাধ্যায়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন