পেলের সেই ছোটবেলার বাড়ি
ঠিক ছিল বিশ্বকাপের আগেই রিলিজ করে যাবে সিনেমাটা। পেলের বায়োপিক। নামও পেলে। পরিকল্পনা অনুযায়ী গত বছরই ব্রাজিলের মাটিতে শ্যুটিং শেষ করে ফেলেছিলেন প্রোডিউসররা। কিন্তু পোস্ট প্রোডাকশন পার্ট শেষ না-হওয়ায় আর রিলিজ হল না ‘পেলে’। সিনেমার চিত্রনাট্য আর পরিচালনা জেফ আর মাইকেল জিমবালিস্টের। হলিউডের এই দুই পরিচালকই এর আগে বলিউডকে নিয়ে সিনেমা বানিয়েছিলেন। ‘দ্য গ্রেটেস্ট লাভ স্টোরি এভার টোল্ড’। আর এবার যখন ব্রাজিলের মাটিতে বিশ্বকাপ ফুটবল, তখনই এ দেশের ফুটবলের সবচেয়ে সফল ফুটবলারকে নিয়ে করতে চেয়েছিলেন আস্ত একটা সিনেমা।
সাও পাওলোর একটা প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে কী করে একটা ছেলে মাত্র ১৭ বছর বয়সেই খেলে ফেলল বিশ্বকাপ, দেশকে প্রথম বিশ্বকাপ জয়ের স্বাদ দিল, সেটাই সিনেমার গল্প। মূলত দু’টো বয়সে পেলেকে ধরা হয়েছে। ১০ থেকে ১৩ বছর অবধি কিশোর পেলের অভিনয় করেছেন লিওনার্দো কাট্রালা। আর ১৩ থেকে ১৭-র পেলের অভিনয়ে কেভিন পাওলার। আর ১৭তেই তো সুইডেন। ফুটবল দুনিয়া দেখল ব্রাজিলের কালো, সুঠাম, হরিণের মতো তীক্ষ্ম এক ফুটবলারকে। এডসন অ্যারিন্টো ডো নাসিমেন্টো। সবার পেলে।
১৯৫৮ বিশ্বকাপের ছবি যদি কোনও দিন ভিডিয়ো কিংবা ইউটিউবে কোনও দিন দেখেন, দেখবেন চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর কান্নায় ভেঙে পড়েছেন পেলে। ১৭ বছর, কী বা বয়েস। অথচ তাঁকে নিয়ে উন্মাদনা, মাতামাতি। আর আবেগে সতীর্থদের কাঁধে ভেঙে পড়েছে ১৭-র ছেলেটা। জেফ জিমবালিস্ট নিশ্চয়ই এখানেই শেষ করবেন তাঁর সিনেমার ক্লাইম্যাক্সের পর্বটার। সত্যি, উত্তরণের এত ভাল মুহূর্ত আর থাকতে পারে! অন্তত এমন একজন কিশোরের যাঁর ছোটবেলা কেটেছে বুট পালিশ করে।
স্যান্টোসের মিউজিয়ামে পেলের ক্লাবের সঙ্গে প্রথম চুক্তিপত্রটা রাখা আছে। ৮ এপ্রিল ১৯৫৭। কাঁপা কাঁপা হাতে একজন সই করেছে। এডসন অ্যারিন্টো ডো নাসিমেন্টো। পেলে তখনও এভাবে পেলে হয়নি। কিছু বন্ধু পেলে বলে ডাকত। খেলতেন বাউরু অ্যাথলেটিক ক্লাবের জুনিয়র টিমে। সেখান থেকে পেলেকে পছন্দ করে নিয়ে আসেন প্রাক্তন ব্রাজিলিয়ান ফুটবলার ব্রিটো। নিয়ে আসেন স্যান্টোসে। তারপর বাকিটা তো ইতিহাস। এবং সিনেমাও।
পেলের প্রথম স্কুল
সাও পাওলো বাহাফুন্ডা বাসস্টপ থেকে যখন বাউরুর বাসে চাপলাম, তখন রাত ১১টা ৫০। বাউরুর শেষ বাস ওটাই। ভোরের আলো ফোটার আগেই বাস পৌছে গেল বাউরু। একটা অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছিল শহরটায় পা দিয়ে। যতই পরবর্তী কালে স্যান্টোসে কাটান, এই শহরের মাটি, জল, অক্সিজেনই তো পেলে তৈরি করেছে। কোথাও একটা রোমাঞ্চ যেন ছুঁয়ে যাচ্ছিল গায়ে। অবশেষে পেলের পাড়ায় আমি। সত্যিকারের পাড়ায়।
পেলের ছোটবেলার শহর আর আজকের বাউরুর মধ্যে মিল খুঁজে পাওয়া কঠিন। পেলের নিজের লেখায় পড়েছিলাম। বাউরু যাওয়ার আগে পেলের জীবনের প্রথম বান্ধবী নিউজার একটা সাক্ষাত্কারও পড়েছিলাম। নিউজা বাউরু ছেড়ে যাননি। এই শহরেই থাকেন। সাক্ষাত্কারটায় বলেছিলেন, পেলে স্যান্টোস যাওয়ার আগে তাঁকে একটা ছবি দিয়ে যান। বলেন রেখে দিতে। ছবির সঙ্গে নিউজাও থেকে যান বাউরুতে। এখনও পেলেকে দেখলে চোখে জল আসে তাঁর। নিউজা থাকতেন পেলের বাড়ির পাশেই। রাস্তার নাম রুয়া সেচে সেটেমব্রো। মোজার মধ্যেই কাগজ ঢুকিয়ে বল বানিয়ে খেলতেন পেলে। পেলের জীবনের প্রথম ক্লাবের নামও রাস্তার নামে। রেলের গুদাম থেকে বাদাম চুরি করে তা দিয়ে বল কেনার টাকা জোগাড়ের চেষ্টা হয়। পেলের সায় ছিল না। মিশন সাকসেসফুলও হয়নি।
বাবা ফুটবলার হলেও মায়ের সায় ছিল না পেলের ফুটবলার হওয়ায়। চার বছর বয়সে পেলে বাউরু আসেন। বাবার ফুটবলের জন্যই এ শহরে আসা। এটা তাঁদের মামাবাড়ি। ওই বাড়িতে স্থানীয় প্রশাসন একটা মিউজিয়ামও বানিয়ে রেখেছে। কিন্তু বাউরুর বাড়িটা পোড়ো বাড়ির মতো হয়ে আছে। ক’মাস আগে আগুন লেগে অবস্থা আরও খারাপ। ঝরা পাতা জমে আছে সিঁড়িতে। পেলেরা বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার পর আর সংস্কার হয়নি।
বাউরুতে চলে এসেছিলেন বাবা ডনডিনহো শুধু ফুটবল খেলে রোজগারের তাগিদে। ভাল ফুটবলার ছিলেন ডনডিনহো। সুযোগ পেয়েছিলেন অ্যাটলেটিকো মিনেইরাতে খেলার। বেলো হরিজন্তের যে ক্লাবে এখন রোনাল্ডিনহো খেলেন। কিন্তু প্রথম ম্যাচে চোট পেয়েই ট্রেস ক্যারোবেস ফিরতে হয় তাঁকে। পরে বাউরু অ্যাথলেটিকো থেকে অফার পেয়ে চলে যান বাউরু। পেলের বয়স তখন চার। প্রথমবার রেলে চড়ার অভিজ্ঞতা এখনও স্মৃতিতে ওঁর। বাউরুতে ফুটবল খেলে স্থানীয় হাসপাতালে চাকরি পেয়েছিলেন ডনডিনহো। হেল্পারের। তাই সংসারে নিত্যঅশান্তি লেগেই থাকত পেলেদের পরিবারে। ফুটবলই যে তাঁদের দারিদ্রের একমাত্র কারণ, বিশ্বাস করতেন ডোনা সেলেস্টে। ছেলে ‘ডিকো’কে তাই ফুটবল খেলতে যেতে দিতে প্রবল আপত্তি ছিল তাঁর পরিবারের। এই আর্থিক দুরবস্থার মোকাবিলা করতেই পেলেকে সাত বছর বয়সে যেতে হয় জুতো পালিশ করতে। মামা জর্জ এনে দিয়েছিলেন জুতো পালিশের ক্রিম, ব্রাশ আর একটা বাক্স। জুতো পালিশের পয়সা মাকে দিতেন পেলে। সকালে এই কাজের পর বিকেলে মিলত ফুটবল খেলার ছাড়পত্র। কিংবা বাবার সঙ্গে তাঁর ক্লাবের ম্যাচ দেখতে যাওয়ার অনুমতি।
পেলে জুতো পালিশ করতে যেতেন নরয়েস্টে স্টেশনে। বাউরু আসলে ছিল একটা রেলওয়ে শহর। সোরাকাবানা, পাউলিস্তা আর নরয়েস্টে এই তিনটে রেলপথ যেত বাউরুর উপর দিয়ে। পেলে চলে যেতেন নরয়েস্টে স্টেশনে। দুপুরে একটা ট্রেন ঢুকত। যাত্রীরা অনেকে ডনডিনহোর ছেলে হিসেবে পেলেকে চিনতেন। কিছুটা সুবিধে হত পেলের। তাঁর স্মৃতির এই স্টেশনটা অবশ্য এখন পুরোপুরি বন্ধ। নরয়েস্টে লাইন উঠে গিয়েছে। আসলে ব্রাজিলে রেলপথ বিষয়টাই প্রায় উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। সবটাই সড়ক পরিবহণ। তাই কালের নিয়মে উঠে গিয়েছে নরয়েস্টে রেলওয়েজ। বন্ধ বাউরুর নরয়েস্টে স্টেশন। তবে চোখ বন্ধ করে টাইমমেশিনে চেপে যদি ফিরে যেতে পারেন পঞ্চাশ দশকের কোনও একটা দুপুরে, শুনতে পাবেন স্টিম ইঞ্জিনের শব্দ, মানুষের কোলাহল। আর দেখবেন জুতো পালিশের বাক্স হাতে বছর সাতেকের একটা ছেলে খদ্দেরের অপেক্ষায়। পালিশ করে পয়সা পেলে মায়ের হাতে তুলে দিতে পারবে। সংসারের চাকা চলবে। তার ফুটবল চলবে। নয়তো সব শেষ। একটা অদ্ভুত মনখারাপ ঘিরে ছিল বাউরুর ওই স্টেশনটার সামনে। সামনে ছোট বুলেভার্ডে কয়েকজন ছেলে আড্ডা মারছিল। তারা এই ইতিহাসটা নিয়ে বিন্দুমাত্র ওয়াকিবহাল নয়। পেলে একটা সময় বাউরুতে থাকতেন, শুধু সেটা শুনেছে।
তবে আরও হতাশ হলাম পেলের প্রথম স্কুল আর্নেস্ট মন্টে স্কুলে গিয়ে। প্রায় তিন বছর এই স্কুলে পড়েছিলেন পেলে। কিন্তু স্কুল কোনও দিনই উপভোগ করেননি। বিশেষ করে শাস্তি দেওয়ার পদ্ধতি। তিন বছর পর স্কুল ছাড়েন। পেলের জীবনের একমাত্র স্কুল এটাই। ১৯৫৮-তে প্রথম বার বিশ্বকাপ জিতে ফেরার পর সাও পাওলো থেকে নিয়ে আসা হয়েছিল বাউরুতেই। চার দিকে লেখা হয়েছিল ‘বয় ফ্রম বাউরু’। শহরের মেয়র পেলেকে একটা গাড়ি দিয়েছিলেন। পেলের জীবনের প্রথম গাড়ি। পেলেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল নরয়েস্টে স্টেশনে, এই স্কুলে। কিন্তু পেলের স্মৃতিকে বিন্দুমাত্র বাঁচিয়ে রাখা হয়নি এখানে। স্কুলে ঢুকতেই একটা প্রেয়ার হল। বাইরে নোটিস বোর্ডে ছোট একটা ছবি। ছোট্ট পেলে, স্কুলে পড়ার সময়। ব্যস্, এটুকুই! আর কিছু নেই। বাউরু অ্যাথলেটিক্স ক্লাব ১৯৬০-য়ে বন্ধ হয়ে যায়। পেলে স্যান্টোসে চলে যাবার দু’তিন বছরের মধ্যেই। যেখানে বাউরুর স্টেডিয়াম ছিল, সেখানে এখন একটা বিরাট শপিং মল। তবে দেওয়ালে বাউরু অ্যাথলেটিক ক্লাবের গেটের ছবি, পেলের ছবি এখনও সাজানো। নরয়েস্টে ক্লাব, স্টেডিয়াম এখনও আগের মতোই। এখানে বাবার খেলা দেখতে চলে আসতেন পেলে। নিজেও খেলেছেন বেশ কিছু ম্যাচ। ওইটুকুই। পেলেকে আলাদা করে মনে রাখেনি নরয়েস্টেও।
তা হলে কি নিজের সেরা সন্তানকে ভুলেই গেল বাউরু? এ দেশে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের তালিকায় এক নম্বরে এখনও তিনিই। ফোর্বস গত বছর এই পাওয়ার লিস্ট তৈরি করেছিল। পেলে একে, পাওলো কোয়েলহো দুইয়ে, আর তিনে নেইমার। অথচ সেদিন সুইডেন থেকে ফেরার পর এই রাস্তায়, গলিতে গলিতে আদরে, আলিঙ্গনে, উষ্ণতায় ভরিয়ে দেওয়া ঘরের ছেলেকে এ ভাবে ভুলে গেল কেন বাউরু? কোন অভিমানে? কীসের অভিমান? যে অভিমান নিয়ে জাপানি বৃদ্ধা নিউজা এখনও সে দিনের ছবি সাজিয়ে বসে আছেন, সেই একই অভিমান? না কি অন্য কিছু। আমার ট্যাক্সি ড্রাইভার অ্যাঞ্জেলো বলছিলেন, “স্যান্টোসে গিয়ে পেলে ভুলে গিয়েছিলেন বাউরুকে। আর বাউরুও তাই পেলেকে।”
তবে এই মান-অভিমানের জন্য ইতিহাসের বোধহয় বড্ড ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। পেলের বাড়ি, পেলের প্রথম ফুটবল পায়ে ছুটে যাবার রাস্তা, প্রথম মাঠ, প্রথম স্কুল কোথাও পেলে নেই! তা-ও আবার ব্রাজিলে। ইতিহাস কিন্তু কাঁদছে...