ফেসবুকে ছবি আর ভিডিয়ো দিয়ে নাম করা যায় না

যদিও তিনি মনে করেন জিন্স পরে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়া যায়। রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা-র মুখোমুখি স্রবন্তী বন্দ্যোপাধ্যায়যদিও তিনি মনে করেন জিন্স পরে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়া যায়। রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা-র মুখোমুখি স্রবন্তী বন্দ্যোপাধ্যায়

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৪ অক্টোবর ২০১৬ ০০:৩৩
Share:

ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল

আজ হঠাৎ যদি শান্তিনিকেতনের রাস্তায় কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় আর সুচিত্রা মিত্রকে একসঙ্গে দেখেন, কাকে আগে প্রণাম করবেন?

Advertisement

এ আবার কী ধরনের প্রশ্ন!

Advertisement

বলুন না...

দু’জনকেই প্রণাম করব।

আগে কাকে?

আমি মোহরদির (কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়) ছাত্রী। মোহরদিকেও প্রণাম করব, সুচিত্রাদিকেও। দু’জনেই শ্রদ্ধার। শুনুন, একটা কথা বলি।

মোহরদি আর সুচিত্রাদি দু’জন কিন্তু খুব বন্ধু ছিলেন। আমি কাছ থেকে দেখেছি বলে জানি দু’জন দু’জনকে অসম্ভব শ্রদ্ধা করতেন। আমার মনে আছে মোহরদি স্বদেশ পর্যায়ের গান শেখাবার সময় বলতেন, ‘‘‘ও আমার দেশের মাটি’, ‘সার্থক জনম আমার’ এই ধরনের গান সুচিত্রার গলাতেই মানায়।’’ মোহরদি কখনও ‘কৃষ্ণকলি’ গাইতে চাইতেন না। বলতেন, ‘‘এই গানটা সুচিত্রার ব্যক্তিত্বের সঙ্গে যায়।’’ অনেক সময় মজা করে মোহরদিকে বলতে শুনেছি, ‘‘আমাদের একসঙ্গে অনুষ্ঠান, সুচিত্রা কেমন গট গট করে মঞ্চে উঠে গেল। আর আমি আস্তে আস্তে চলেছি।’’ সুচিত্রাদিকে এতটাই শ্রদ্ধা করতেন দেখে মোহরদির প্রতি শ্রদ্ধা আমার দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছিল।

মোহরদি তো আমার গুরু। শুধু তো গান শেখা নয়। রবীন্দ্রনাথ আর তাঁর জীবনদর্শন, যা নিয়ে আজ বেঁচে আছি, তার সবটাই মোহরদির কাছ থেকে পাওয়া।

রবীন্দ্রনাথের জীবনদর্শন আজকের দিনে চলে?

এখনও রবীন্দ্রনাথ সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক। তিনিই প্রথম বিশ্ব-নাগরিকের কথা বলেছিলেন। এই ফেসবুক, টুইটারের দিনে এখন তো আমরা তাই। তবে একটা কথা বলি, বিশ্ব-নাগরিকের মধ্যেই এত সন্ত্রাস, গোলাগুলি, যন্ত্রণা, রক্ত... এটা খুব দুঃখের।

বাংলাদেশেও তো এত হানাহানি। একজন শিল্পী হিসেবে...

(উত্তেজিত) শিল্পীর কথা ছাড়ুন, মানুষ হিসেবে চোখের সামনে এই ক্রুয়েলটি দেখা যায় না। নিজের মত স্বাধীনভাবে প্রকাশ করা যাবে না? উগ্র জাতীয়তাবাদ এমন জায়গায় চলে গেছে যে আমরা মানুষকে মানুষ ভাবি না। কে হিন্দু, কে মুসলিম, কে খ্রিস্টান — ভাবছি। তবে আমি হতাশার কথা বলব না। এর মধ্যেই কাজ করে যেতে হবে।

আপনি কী কাজ করছেন?

শান্তিনিকেতনের মতো একটা পরিবেশ তৈরি করতে চেয়েছিলাম। স্বপ্ন ছিল। সেটাই পূর্ণ হতে চলেছে। ‘রবীন্দ্রসৃজন কলা বিশ্ববিদ্যালয়’ তৈরি করছি আমরা। ২০১৭-য় খুলবে। বাংলাদেশ সরকারের অনুমতি পেয়েছি। এটা গাজিপুরে, ঢাকা থেকে দেড়-দু’ঘণ্টার ড্রাইভ। ঘন জঙ্গল ঘেরা এলাকায় এই বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি হচ্ছে। আপাতত ল্যাঙ্গোয়েজ সায়েন্স, পারফর্মিং আর্টস, বিজনেস স্টাডিজ প়়ড়ানো হবে। তবে একটা কথা বলি, পারফর্মিং আর্টিস্টদের পায়ের নীচের মাটি তৈরি করা কিন্তু সহজ নয়। ধৈর্য, ঠান্ডা মাথা লাগে। লেগে থাকতে হয়। এই বড় উদ্যোগে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান সঙ্গে আছেন। কলামন্দিরে ৬ নভেম্বর আমার একক অনুষ্ঠান। তার প্রস্তুতিও চলছে। নিজেকে কাজের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চাই।

ছড়িয়ে যে দেবেন, ফেসবুক তো করেন না, টুইটারেও নেই...

মেল দেখি মাঝে মাঝে। অন্য কিছুর সময় নেই। ইচ্ছেও নেই। আসলে কম্পিউটারে সহজ হতে পারি না। তবে একটা কথা বলি — ফেসবুকে ছবি দিয়ে, ভিডিয়ো দিয়ে গানে নাম করা যায় না। সাফল্যের কোনও শর্টকাট নেই। কোয়ালিটি থাকতে হবে, তবে সে উঠবে। আমি একটু পুরনোপন্থী। প্রযুক্তির কারণে দুই দেশের শিল্পীদের মধ্যে আদানপ্রদান বেড়েছে। এটা অবশ্য মানি।

আর শান্তিনিকেতন?

শান্তিনিকেতনে বহু দিন যাই না। ইচ্ছে করে না। খোলা মাঠের খেলা আর নেই। চারিদিকে পাঁচিল ঘেরা। কেমন একটা বদ্ধ বদ্ধ ভাব। আগে যে শান্তিটা পেতাম, এখন আর পাই না।

আপনি চান সব এক থাকুক, কিছু বদলাবে না? গান নিয়ে নতুন কিছু ভাবছেন?

গানের মধ্যে রোজই নতুন কিছু পাই। ‘প্রতিদিনের ধুলায় ধুলায় জাগে তাঁর বাণী...’ আলাদা কিছু করে চমকাতে চাই না। গিমিকে বিশ্বাস করি না।

রবীন্দ্রনাথের গানে নতুন সুর দেওয়া হল।

আমার কিছু বলার নেই।

চল্লিশ বছর ধরে গান গাইছেন। একটা দায়িত্বের জায়গা থেকে তো বলা যায় যে রবীন্দ্রনাথের গানে সুর দেওয়া যায় কি না?

আমি মনে করি, দেওয়া যায় না। এটা আমার ব্যক্তিগত মত। তা হলে তো রবীন্দ্রনাথ হয়ে যেতে হয়। আর রবীন্দ্রনাথের যে গানে সুর পাওয়া যায় না, অথচ রাগ বা তাল লেখা আছে, সেই গানের সুরগুলো হারিয়ে গেছে। তা হলে এটা পরিষ্কার যে রবীন্দ্রনাথ ওই গানেও সুর করেছিলেন, ফলে সুর দেওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না! অন্য কেউ যদি কিছু করে থাকে সেটা তাঁর দায়িত্ব।

কিন্তু অনেক আগেই শান্তিদেব ঘোষ, দেবব্রত বিশ্বাস, তো সুর দিয়েছেন...

আপনি যাঁদের নাম নিলেন তাঁরা সকলেই প্রণম্য। আমি এটুকুই বলব।

রবীন্দ্রনাথের গানে তা হলে কোনও বদল আপনার পছন্দ নয়?

ভুল কথা। হোক না বদল। ইউটিউবে সে দিন শুনলাম, কয়েকটি বাচ্চা ছেলেমেয়ে একটা মেডলি করেছে। কী চমৎকার হয়েছে। নতুন প্রজন্মের একটা দল গিটারের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের গান গাইছে। কোথাও ধাক্কা খায়নি। এরা গানটা বুঝে করেছে, আমি এটাই চাই। গানটা মন ছুঁয়ে গেলেই হল। কী করে গাইলাম, কী পোশাক পরে গাইলাম সেটা নিয়েও আমি মাথা ঘামাই না।

কী রকম?

কেউ জিন্স পরে যদি রবীন্দ্রনাথের গান গায়, গাইবে। গানটা যদি শ্রোতাদের ভাল লাগে সেটাই আসল কথা। আরে, অমিয়া ঠাকুর আগে যেমন ফুলহাতা ব্লাউজ ব্রোচ পরে গান গাইতেন আমিও কি এখন সে ভাবে সেজে গাই?

কলকাতায় অনেকে রেজওয়ানার মতো করে গান করেন। ভাবেন, তা হলেই বিখ্যাত হওয়া যায়...

(অবাক হয়ে) তাই নাকি? শেখার পর্যায়ে এটা চলতে পারে। কিন্তু পারফর্ম করলে নিজস্বতা না এলে বেশি দূর যাওয়া যায় না।

কাদের গান শোনেন?

মোহরদি, নীলিমা সেন আর রাজেশ্বরী দত্ত।

বলা হয়ে থাকে কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় নাকি গানের ক্ষেত্রে নাকের ব্যবহার করতেন...

শুনুন, প্রত্যেকের নিজস্ব স্টাইল আছে। এখানে ঠিক-ভুল বলে কিছু হয় না। তবে একটা কথা আমার বলার আছে, আজকাল দেখি সবাই সব গান গায়। এতে কিন্তু কিছু এস্টাবলিশড হয় না। রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়েই ফোক গাইতে লাগলাম, এতে কিন্তু ঝটকা লাগে, কানে লাগে... তবে নতুনরা এখন প্ল্যাটফর্ম পাচ্ছেন না। মিউজিক চ্যানেল নেই, রেডিয়োতে শুধুই সিনেমার গান বাজে। তাই এরা কোথায় গাইবে? এটা একটা কঠিন প্রশ্ন!

নতুনদের গান শোনেন?

টিভিতেই শুনি। অনুপম রায়ের নাম শুনেছি। গান এখনও শোনা হয়নি। রবীন্দ্রনাথের গানে জয়তী চক্রবর্তী, শ্রেয়া গুহঠাকুরতা-র গান বেশ ভাল লাগে। শমীক পাল, শৌনক চট্টোপাধ্যায় — এরাও ভাল গাইছে। আর অগ্নিভ, শ্রীকান্ত, লোপা, ওদের সঙ্গে তো খুবই ওঠা বসা। আর প্লিজ কিছু জিজ্ঞেস করবেন না। রিহার্সালে যাব।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন