Sona Mahapatra

Sona Mahapatra: সব পুরুষ ধর্ষক নন, তবে তো সব মহিলাকেই নির্যাতিতা বলতে হয়: সোনা মহাপাত্র

‘‘সব সময়ে প্রতিভার উপরে ভরসা রেখেছি। কিন্তু একটা সময়ে গিয়ে বুঝলাম যে কাজ পাওয়াটা কেবল আমার লিঙ্গের উপর নির্ভর করছে’’, অকপট সোনা।

Advertisement

তিস্তা রায় বর্মণ

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২১ ১৮:১১
Share:

আশা করি, আরও বাঙালি সুরকার আমাকে দিয়ে গান গাওয়াবেন, বললেন সোনা।

প্রশ্ন: পুজোয় আপনার গলায় গান শুনতে পাচ্ছি তা হলে…

সোনা:
পুজোর জন্য বিক্রম ঘোষের সুরে গান গেয়েছি আমি। শুনেছি এবং দেখেছি, করোনা থাকুক বা না থাকুক, বাঙালিরা পুজোর সময়ে কোনও কিছুকে পাত্তা দেয় না। সেই রঙিন উৎসবের জন্য গান গেয়ে আমি খুবই উত্তেজিত। বিক্রম ঘোষের দৌলতে এই অ্যালবামে গান গাইতে পেরে আমি ধন্য। মুক্তির অপেক্ষা করছি। আশা করি, আরও বাঙালি সুরকার আমাকে দিয়ে গান গাওয়াবেন (হেসে উঠলেন সোনা)।

প্রশ্ন: রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনেন?

সোনা:
(হেসে) আমি জানি, এই কথাটা বললে বাঙালিরা খুব রেগে যাবেন, কিন্তু রবীন্দ্রসঙ্গীতের ভক্ত নই আমি। বরং নজরুলগীতি বা বাউলগান বেশি পছন্দ। তবে আমার ধারণা, আরও কয়েকটা বছর পরে আমিও হয়তো রবি ঠাকুরের গানের মূল্য বুঝব। এখন একটু একঘেয়ে লাগে। পার্বতী বাউলের কিছু গান শুনে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছি। সামনাসামনি ওঁকে গান গাইতে দেখেছি। তিনি অসামান্য।

প্রশ্ন: ‘শাট আপ সোনা’ তথ্যচিত্রটি দেশবিদেশের চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কার পেয়েছে। অনেক শুভেচ্ছা…

সোনা:
ধন্যবাদ, দু’বছর ধরে এই কাজটির পিছনে পড়ে রয়েছি। আমার মতো এক জন মহিলা শিল্পীর জন্য বলিউড ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ প্রায় নেই বললেই চলে। চার বছর আগে এই কথাটি প্রথম উপলব্ধি করি আমি। আর তখন থেকেই ‘শাট আপ সোনা’-র যাত্রা শুরু।

প্রশ্ন: অর্থাৎ বিভিন্ন ক্ষোভ, বিক্ষোভ থেকেই তথ্যচিত্র বানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন?

সোনা:
এই ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করার জন্য আমার যথেষ্ট প্রতিভা থাকলেও অনেক বেশি খাটতে হচ্ছিল আমায়। এখনও যদিও প্রায় একই পরিস্থিতি। খুব অল্প বদলেছে। বলিউডে কাজ পাওয়ার জন্য বিশেষ কিছু নিয়ম রয়েছে। সেগুলি মেনে চললে তবেই পুরস্কার বিতরণীর অনুষ্ঠানে গান গাওয়ার জন্য ডাক পাবেন। তা ছাড়া নয়। সেগুলি আমার পক্ষে মেনে চলা একটু কঠিন হয়ে যাচ্ছিল। ‘আম্বর সরিয়া’, ‘নয়না’-র মতো হিট গান গাওয়ার পরেও আমি বেশি কাজ পাচ্ছিলাম না। ধীরে ধীরে মানসিক অবসাদ শুরু হয় আমার। মনে হয়, অন্য রকম কিছু করে দেখা যাক। নিজের কাজ করা যাক। কারও প্রস্তাবের জন্য অপেক্ষা করতে হয় না তা হলে।

Advertisement

‘‘কত কত উঠতি মহিলা রয়েছেন, যাঁরা ভাল গান গাইতে পারেন, অথচ কাজ পাচ্ছে না।’’

প্রশ্ন: কিন্তু আর পাঁচ জন সফল মূল ধারার সঙ্গীতশিল্পীদের অনুসরণ করতে চেয়েছিলেন কি আপনি?

সোনা:
(হেসে) না, কোনও দিনও না।

প্রশ্ন: আপনার যা প্রতিভা, তাতে তো আরও অনেক গান গাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সে রকম হল না কেন?

সোনা:
আমি আসলে সব সময়ে প্রতিভার উপরে ভরসা রেখেছি। বিশ্বাস করতাম, প্রতিভা থাকলে কাজ পাওয়া যায়। কিন্তু একটা সময়ে গিয়ে বুঝলাম যে কাজ পাওয়াটা কেবল আমার লিঙ্গের উপর নির্ভর করছে। তখনই আমার বিরক্ত লাগতে থাকে। অবসাদ শুরু হল। এটা কেবল আমার জন্য বলছি না। আমি বরং এখন অনেক স্বচ্ছল। কাজ আছে আমার হাতে। মুম্বইয়ে দোতলা বাড়ি, দামি গাড়ি, সবই আছে আমার কাছে। কিন্তু আরও কত কত উঠতি মহিলা রয়েছেন, যাঁরা ভাল গান গাইতে পারেন, অথচ কাজ পাচ্ছে না। তাঁদের কথা বলছি। গুনতে বসলে অবাক হয়ে যাই, ১০০টি মূল ধারার হিন্দি গানের মধ্যে মাত্র ৮-১০টি গান মহিলাদের গাওয়া। প্রশ্ন করি নিজেকে, এই ইন্ডাস্ট্রিতেই এক সময়ে লতা মঙ্গেশকর এবং আশা ভোঁসলেরা রাজ করতেন? আমার মতে, লিঙ্গের সমান অধিকারের ক্ষেত্রে আমরা আরও পিছিয়ে যাচ্ছি। এখন যেন মহিলা মানেই কেবল সুন্দর মুখ, ব্যস। এ সব ভাবলে খুব রাগ হয় আমার। শুধু পুরুষদের উপরই রাগ হয়, তা নয়। যে মহিলারা নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন (যদিও সেই সংখ্যা খুবই কম), তাঁরাও পিছনে ফিরে দেখেন না। তাঁর পিছনে তো হাজার হাজার মহিলা রয়েছেন, যাঁরা পারেননি। তাঁদের জন্য আওয়াজ তোলেন না কেউ।

‘সোচনা সাকে’ গানটি থেকে অক্ষয় কুমারের দাবির কারণে বাদ পড়েছিলেন সোনা মহাপাত্র।

প্রশ্ন: ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করার সময়ে কোনও কাজ থেকে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়েছে আপনাকে?

সোনা:
অবশ্যই। আমার মনে পড়ে, ‘রইস’-এর জন্য একটি প্রেমের গান বানানো হয়েছিল। সঙ্গীত পরিচালক প্রীতম ডেকেছিলেন আমায়। জানিয়েছিলেন, অরিজিৎ সিংহের সঙ্গে গাইতে হবে। খুবই আনন্দ হয়েছিল আমার। নির্দিষ্ট দিনে স্টুডিয়োয় গেলাম। জানতে পারলাম, মূল গানটি অরিজিতের জন্যই লেখা। মহিলার অংশটি একেবারে শেষে চারটি কি পাঁচটি পংক্তির মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এটা দেখার পর আর সেই গান গাইনি আমি। ‘এয়ার লিফট’-এর ‘সোচনা সাকে’ গানটি বানানো হয়েছিল একক মহিলার জন্য। অমল মালিক আমায় গানটি গাইতে ডাকেন। কিন্তু জানতে পারলাম অক্ষয় কুমার নিজের গলায় সেই গানটি রাখার দাবি জানিয়েছেন। ব্যস, আমি বাদ পড়লাম। তাই প্রীতম বা অমলকে দোষ দিই না আমি। সঙ্গীত পরিচালকের হাতে নেই কিছুই। ছবির প্রযোজক বা বড় তারকারাই এ সিদ্ধান্ত নেন। গোটা পরিস্থিতিটাই এমন। নিয়মগুলি ভাঙা অত সহজ নয়। যদিও এই মুহূর্তে মানুষের কান বদলাচ্ছে বলে মনে হয়। অন্য রকম গানের আবদার আসছে।

Advertisement

‘‘গান গাওয়ার জন্যেও যখন আক্রমণ সহ্য করতে হয় তখন খারাপ লাগে।’’

প্রশ্ন: মূল ধারার গানের জগতে সফল হওয়ার পরেও তো আপনাকে অজস্র কুমন্তব্য শুনতে হয়েছে। কখনও তা পোশাক, কখনও বা প্রতিবাদী মন্তব্যের জন্য…

সোনা:
আমি চেষ্টা করি, খারাপ কথা মনে না রাখতে। বিশেষ করে গানের মতো শিল্পের সঙ্গে যুক্ত থাকলে নেতিবাচকতা আপনা আপনি দূরে সরে যায়। তবে গান গাওয়ার জন্যেও যখন আক্রমণ সহ্য করতে হয় তখন খারাপ লাগে। এক বার ‘সুফি মাদারিয়া ফাউন্ডেশন’-এর সদস্যরা আমাকে আক্রমণ করেছিলেন পোশাকের জন্য। তাঁদের বক্তব্য, সব রকম পোশাক পরে এই গান গাওয়া যায় না। তাঁদের আরও দাবি, মেয়েরা নাকি এই গান গাইতে পারে না। আমি এর উত্তরে বলেছিলাম, আপনারা কেন তবে গাড়ি চড়ে ঘুরে বেড়ান? আদর্শের কথা বলেন তাঁরা। সে ক্ষেত্রে তো তাঁদের মধ্যযুগে বসবাস করা উচিত। এসবই রয়েছে ‘শাট আপ সোনা’-তে। কিন্তু সমস্ত গল্প এবং ঘটনা তুলে ধরতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে আমায়। কোনও টাকা ছিল না, মাথার উপর নামকরা কেউ ছিল না। আমি ভাগ্যবান যে দীপ্তি গুপ্ত এবং আমি ছাড়াও অর্জুন গৌরিসারিয়া এবং রাম সামপথের মতো দু’জন নারীবাদী এই কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। নয়তো এ ভাবে আমরা এই ছবি বানাতে পারতাম না।

প্রশ্ন: ২০১৫ সালে পরিচালক নন্দিতা দাসের একটি মন্তব্য নিয়ে অনেক বিতর্ক হয়। বলেছিলেন, ‘প্রত্যেক পুরুষ সম্ভাব্য ধর্ষক।’ যদিও তিনি পরে এই বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করেছিলেন...

সোনা:
কখনওই মনে করি না যে উনি ঠিক বলেছেন। এই ধরনের কথা বলার জন্য নন্দিতা দাসকে আক্রমণ করা হলে তাতে ভুল দেখি না। প্রত্যেক পুরুষকে যদি সম্ভাব্য ধর্ষক বলি, তা হলে বলতে হবে সমস্ত নারীই তার শিকার। তা তো নয়। প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই খারাপ ভাল মিশিয়ে থাকে। নারী হোক বা পুরুষ।আমাদের সমাজ আসলে ক্ষমতাবান এবং ক্ষমতাহীনদের মধ্যে বিভক্ত। মানছি যে, এই সমাজে পুরুষদের হাতে বেশি ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। তা বলে সব পুরুষ ধর্ষক নন। তবে এমনও হতে পারে যে নন্দিতা দাস হয়তো এ কথাটা বলতে চাননি কিন্তু যে ভাবে বলেছেন তাতে মানুষ ভুল বুঝেছেন।

‘‘রাম আমার থেকে বেঁটে, তাই জন্য ট্রোল করা হয়েছে ওকে।’’

প্রশ্ন: রাম সামপথের সঙ্গে সংসার করার ক্ষেত্রে কোনও রকম পুরুষতন্ত্রের কবলে পড়েছেন?

সোনা:
না, আমি খুবই ভাগ্যবান। রাম ভীষণ সচেতন এক জন মানুষ। সে বরং বিশ্বের সমস্ত খারাপ পুরুষের পাপের দায়ভার নিয়ে বসে। আমার চিন্তা হয় ওর জন্য। ওর মধ্যে অহং নেই বলেই মানুষের কুমন্তব্য কানে নেয় না। রাম আমার থেকে বেঁটে, তাই জন্য ট্রোল করা হয়েছে ওকে। কিন্তু ও কোনও দিন এ সব নিয়ে মাথা ঘামায়নি। শুধু কাজ নিয়ে ভাবে রাম। সঙ্গীত নিয়ে সময় কাটে ওর।

প্রশ্ন: অনু মালিকের বিরুদ্ধে মিটু অভিযোগ তুলেছিলেন। তার পরেও তাঁকে ‘ইন্ডিয়ান আইডল’-এর বিচারকের আসনে নিয়ে আসা হয়…

সোনা
: জানেন আমি ৪৮ জন মহিলার সঙ্গে একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে আছি, তাঁরা প্রত্যেকেই নির্যাতিতা। তাঁদের যাঁরা নির্যাতন করেছেন, সেই তালিকার শীর্ষে রয়েছেন গায়ক কৈলাস খের এবং সুরকার অনু মালিক। আজও সেই মহিলারা লড়াই করে চলেছেন। ‘ইন্ডিয়ান আইডল’-এ ফের বিচারকের পদে অনু মালিককে নিয়ে আসার পর আমি মেনে নিতে পারিনি। আমি আওয়াজ তুলেছি। প্রতিবাদ জানিয়েছি। কিন্তু তাতেও কোনও লাভ হয়নি। সেই মানুষটিকে কেউ তাঁর জায়গা থেকে টলাতে পারেনি। কেউ এগিয়ে আসেনি, আমার কাঁধে কাঁধ মেলায়নি। অনু মালিকের বিরুদ্ধে আমি যে প্রচার চালাচ্ছিলাম, সেটা বন্ধ করে দেওয়ার জন্য নানা প্রস্তাব আসতে থাকে আমার কাছে। তাও সে সব পাত্তা দিইনি। অনু মালিকের কারণে মানসিক অবসাদে আমার শরীরের ওজন বেড়ে গিয়েছিল। গোটা দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়ে ফেলেছিলাম। পরে মনে হল, এই লড়াই তো আমার একার নয়। গোটা ভারতের লড়াই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন