ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল
২০১৩ সালের নভেম্বর মাস। তখন আমার ‘কাদম্বরী’ ছবির শ্যুটিং চলছে। হঠাৎ অনিবার্য কারণে শ্যুটিং বন্ধ হয়ে গেল। ইউনিটের সবার ভীষণ মন খারাপ। আমি কঙ্কনাকে বললাম, লেট’স গো আউট ফর ডিনার। মন খারাপ করে বসে থেকে লাভ নেই। মনে আছে, সেই সন্ধেবেলা পার্ক হোটেলের রেস্তোরাঁয় বসেই নানান আড্ডা হতে হতে কঙ্কনা আমাকে বলে, ও একটা ছবি ডিরেক্ট করার কথা ভাবছে। গল্পটাও আমায় বলে। পরিষ্কার মনে আছে সেই তাক লাগানো গল্পটা। ডার্ক মিস্ট্রি, থ্রিলার মেশানো এক রোমহর্ষক কাহিনি। ওর চিরাচরিত বিনয়ী স্বভাবে তার পর বলল, ‘‘জানি না আদৌ সেটা কোনও দিন করে উঠতে পারব কি না।’’
গত সপ্তাহে টরন্টো ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভাল— যা কিনা বিশ্বের অন্যতম সেরা ফিল্ম ফেস্টিভাল — তাদের সিলেকশন রেজাল্ট ঘোষণা করেছে। তাতে কঙ্কনার সেই ছবি — ‘ডেথ ইন দ্য গঞ্জ’। কান, বার্লিন, ভেনিস, টরন্টোতে বাঙালি পরিচালকদের ছবি আজকাল আর যায় না বললেই চলে। গত কয়েক বছরের মধ্যে আদিত্য বিক্রম সেনগুপ্তর ‘আসা যাওয়ার মাঝে’র পর এ বার কঙ্কনার ছবি। মাস্টার্স সিলেকশনে বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর ‘টোপ’ সিনেমাটা। যা বিশ্বের তাবড় তাবড় ফিল্ম মেকারদের মধ্যে আসন কেড়ে নিয়েছে। যাক, কঙ্কনার ছবি সিলেক্টেড শুনে কী যে গর্ব হল তা আর বলার নয়। কেননা আমি খানিকটা হলেও ওর মুখে শুনেছি, গত তিন বছর কী অক্লান্ত পরিশ্রম করে আঁকড়ে ধরে রেখেছিল ওর ভিশন।
অনেক সময় পরিচালকদের মধ্যে একটা ঔদ্ধত্য দেখতে পাই। তারা নিজেদের স্ক্রিপ্ট নিয়ে বড় বেশি সন্তুষ্ট থাকে। কঙ্কনাকে দেখেছি প্রথম ড্রাফ্ট লেখার পর এনএফডিসি-র স্ক্রিপ্ট ল্যাবে এক বাধ্য ছাত্রীর মতন পর পর সেশন অ্যাটেন্ড করে। সে যে অপর্ণা সেনের মেয়ে, বা ভারতীয় চলচ্চিত্র জগতে এক দিকপাল অভিনেত্রী, তা যেন ওর মাথাতেই নেই। কঙ্কনার প্রথম ছবি বানানোর নিষ্ঠা এবং পরিশ্রম শেখার মতন। সেটা ওর এক মস্ত বড় স্ট্রেংথ। কিছু দিন আগে মুম্বইতে একটা প্রাইভেট স্ক্রিনিং হয় ছবিটার। তাতে মুম্বইয়ের বিদগ্ধ ফিল্মমেকাররা প্রশংসায় পঞ্চমুখ। রামগোপাল বর্মা তো কঙ্কনার ছবি নিয়ে ট্যুইট করে ‘৩৬ চৌরঙ্গি লেন’-এর সঙ্গে তুলনা করেছেন, যা অভাবনীয়।
আমি সেদিন কঙ্কনাকে এই সব হওয়ার পর ফোনে জিজ্ঞেস করি, কেমন অনুভূতি হচ্ছে? একটু হেসে বলল, ‘‘আমি আসলে এখন ভীষণ ভাবে ছবিটা শেষ করা নিয়ে ব্যস্ত। তাই এত যে হইচই হচ্ছে শুনছি, সেটা এখনও সিঙ্ক ইন করেনি।’’
অপর্ণা সেনের যাত্রা শুরু একটা ইংরেজি ছবি দিয়ে, কঙ্কনারও। রিনাদি (অপর্ণা সেন) তার পর একের পর এক পাথ ব্রেকিং ছবি করতে থাকেন। ‘পরমা’, ‘সতী’, ‘যুগান্ত’, ‘পারমিতার একদিন’... কোনটা ছেড়ে কোনটার কথা বলব। অবশ্যই ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে তিনি হয়ে উঠলেন অন্যতম শ্রেষ্ঠ পরিচালক। কেন জানি না ভীষণ আশা করে আছি, পরিচালক হিসেবে কঙ্কনারও এ রকম একটা কেরিয়ার যেন হয় — সেটা ওর প্রাপ্য।
উপরের কথাগুলো একটা সলিড বেসিস থেকে বলছি। কঙ্কনার সঙ্গে কাজ করে সেটা যেন বেশ অনুভব করতে পারি। অভিনেত্রী হিসেবে ওর যে দক্ষতা তা আর নতুন করে বলার কিছু নেই। দু’টো ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড, বেশ কিছু আন্তর্জাতিক অ্যাওয়ার্ড ছাড়াও সারা দেশের সিনেমা জগৎ একবাক্যে একমত— কঙ্কনার মতো অভিনয়-দক্ষতা বিরল। ওর সঙ্গে কাজ করে বুঝতে পারি ওর ডেডিকেশন।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, মিঠুন চক্রবর্তীর মতো দিকপাল অভিনেতাদের সঙ্গে কাজ করে আমার নিজের ধারণা, একজন জাত অভিনেতার মধ্যে ইন্টেলেক্ট এবং ইন্সটিংক্টের সঠিক মিশ্রণই তার অভিনয়কে অন্য জায়গায় নিয়ে যায়। কঙ্কনা হচ্ছে তার এপিটোম। মনে আছে ‘কাদম্বরী’র শুটিংয়ের সময়ই আমার সিনেমাটোগ্রাফার বরুণ মুখোপাধ্যায়, যিনি শাবানা, স্মিতা, নাসিরউদ্দিন, কমল হাসনের সঙ্গে কাজ করেছেন, প্রথম দিন একটা ক্লোজ শট নেওয়ার পর আমার কাছে এসে বলেন, ‘‘সুমন, আই হ্যাভ ওয়ার্কড উইথ স্মিতা, শাবানা। শি ইজ অব দ্য সেম ক্লাস। আনবিলিভেবল।’’ কঙ্কনার অভিনয়ের কথা বলার কারণ, মানুষ হিসেবেও ওর মধ্যে এই লক্ষণটা ভীষণভাবে আমার চোখে পড়ে। এবং সেটা পরিচালকের রোলে ওকে ভীষণভাবে সাহায্য করবে, তা অনস্বীকার্য। যাঁরা ‘ডেথ ইন দ্য গঞ্জ’য়ের ট্রেলরটা দেখেছেন, তাঁদের সেটা চোখে পড়তে বাধ্য।
‘ডেথ ইন দ্য গঞ্জ’-এর দৃশ্য।
কঙ্কনার কেরিয়ারের শুরু ওর অভিনয় দিয়ে এবং এখন অভিনয়ের পাশাপাশি ওর পরিচালক হয়ে ওঠা। ঠিক যেন মা অপর্ণা সেনের মতো। ওকে জিজ্ঞেস করি, ডিরেকশন দেবে এটা কি কখনও প্ল্যান ছিল? বলল, ‘‘একেবারেই না। অ্যাক্টিং করব সে রকম প্ল্যানও তো ছিল না কোনও দিন। অনেক দিন আগে আমার বাবার মুখে এই গল্পটা শুনি। তার পর থেকে এটা আমাকে হন্ট করত। আস্তে আস্তে ভাবলাম এটাকে লিখে রাখি। দেন সুন থিংস ফেল ইনটু প্লেস। ওয়ান থিং লেড টু দ্য আদার, অ্যান্ড আই অ্যাম হিয়ার অলমোস্ট ডান উইথ মাই ফার্স্ট ফিল্ম। টরন্টোতে স্ক্রিনিংয়ের পর বোধহয় আসল অনুভূতিটা হবে।’’
কঙ্কনা ওর মায়ের ছত্রছায়া থেকে বেরিয়ে নিজের অভিনয় জগতে এক স্বতন্ত্র পথ খুলে নিয়েছে। সন্দেহ নেই যে, পরিচালক হিসেবেও সেটা ও করে উঠবে কেন না অনেক দিকেই ও রিনাদির থেকে আলাদা। আর সেটা ওর ছবিতে প্রতিফলিত হতে বাধ্য। অভিনেতা কঙ্কনা যে অপর্ণা সেনের থেকে আরও পরিপূর্ণ — সে কথা রিনাদি নিজেও অনেক ইন্টারভিউতে বলেছেন। পরিচালক হিসেবেও সেই তুলনা উঠতে বাধ্য। ভবিষ্যৎ দিতে পারবে তার উত্তর।
আগে ওর বিনয়ী স্বভাবের কথা বলেছি বলে, শেষ করি সেটা দিয়েই। সিনেমার গ্ল্যামার জগতে যেখানে পরস্পরের পিঠ চাপড়ানো, একে অপরের প্রশংসায় পঞ্চমুখ... এত দলাদলি, এত পলিটিক্স, সেখানে বোধহয় এই একজনকেই দেখেছি সে সবের দূরে থাকতে। নিজের কাজই সবথেকে বড় পি আর — এটাই ওর দর্শন। এবং তার মধ্যে কোনও ভণিতা নেই। সুতরাং এই লেখাটা পড়ে ও যে ভীষণ লজ্জিত হয়ে পড়ছে তা বেশ বুঝতেই পারছি।