গঙ্গা-পদ্মার মৈত্রীই ভরসা ছায়াছবিতে

ভাষাদিবসের পটভূমিতে পাঁচ দশক আগের স্মৃতি যেন আছড়ে পড়ছে। ঢাকার বলাকা বা মধুমিতা-র পর্দায় রেজ্জাক-করবীদের থেকে জনপ্রিয়তায় কম যেতেন না এপারের উত্তম-সুচিত্রা, সৌমিত্র-মাধবীরা। ’৬৫-র ভারত-পাক যুদ্ধের পরে সেই সুতো ছিঁড়ে যায়।

Advertisement

ঋজু বসু

শেষ আপডেট: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০২:৪৬
Share:

যৌথ প্রযোজনায় তৈরি এই ছবি।

ভাষাদিবসের পটভূমিতে পাঁচ দশক আগের স্মৃতি যেন আছড়ে পড়ছে। ঢাকার বলাকা বা মধুমিতা-র পর্দায় রেজ্জাক-করবীদের থেকে জনপ্রিয়তায় কম যেতেন না এপারের উত্তম-সুচিত্রা, সৌমিত্র-মাধবীরা। ’৬৫-র ভারত-পাক যুদ্ধের পরে সেই সুতো ছিঁড়ে যায়।

Advertisement

বহু বছর বাদে আবার সৌমিত্রর অপেক্ষায় একুশ শতকের বাংলাদেশ। বসুন্ধরা সিনেপ্লেক্সে প্রিমিয়ার হয়ে গিয়েছে। আগামী শুক্রবার ওপারে মুক্তি ‘বেলাশেষে’র। একই দিনে এ পারে আসবে বাংলাদেশের ‘ছুঁয়ে দিলে মন’। এ বছর টালিগঞ্জের আরও ছ’টি ছবির ঢাকা যাওয়ার কথা। লাইনে রয়েছে ‘নাটকের মতো’, ‘বাস্তুশাপ’, ‘কাদম্বরী’..। ও পারের কিছু জনপ্রিয় এবং ভিন্ন স্বাদের ছবিও দেখার সুযোগ পাবে এ পারের বাঙালি।

ঢাকার প্রবীণ প্রযোজক হবিবুর রহমান খানের মনে পড়ে যাচ্ছে ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ তৈরির দিনগুলো। এখন ‘পদ্মানদীর মাঝি’, ‘মনের মানুষ’-এর পরে তিনি ‘শঙ্খচিল’-এর অপেক্ষায়। গৌতম ঘোষের পরিচালনায় যৌথ প্রযোজনার ছবিটি মুক্তি পাবে পয়লা বৈশাখ। ঢাকায় সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত যৌথ প্রযোজনা ‘হিরো ৪২০’ পশ্চিমবঙ্গে হপ্তাখানেক আগেই আলো দেখেছে।

Advertisement

গত দু’তিন বছরে নয়-নয় করে গোটা দশেক বাংলা ছবি মুক্তি পেয়েছে দু’বাংলায়। সব ক’টিই যৌথ প্রযোজনা। ‘আমি শুধু চেয়েছি তোমায়’-এর মতো সবই যে হিট করেছে, তা নয়। দু’দেশে একযোগে ছবি মুক্তি নিয়ে কিছু জট এখনও রয়েছে। তবু গোটা ছয়েক যৌথ প্রযোজনার সঙ্গে জড়িত ধানুকা-গোষ্ঠীর মতে, দুই বাংলায় ছবি হিট করানোর ফর্মুলা বার করতে পারলে ইন্ডাস্ট্রির পোয়াবারো।

মনমোহন সিংহ জমানার শেষ দিক থেকেই ‘সফ্‌ট পাওয়ার’ হিসেবে চলচ্চিত্রের প্রসারে উদ্যোগী হয়েছে দিল্লি। চলতি জমানাতেও মোদী-হাসিনার বৈঠকে ঢুকে পড়েছিল চলচ্চিত্র প্রসঙ্গ। ঢাকায় নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত হর্ষবর্ধন সিংলার আশ্বাস, ‘‘দু’দেশে সিনেমার জানলা খোলা রাখতে দিল্লির আন্তরিকতায় খাদ নেই।’’

বাংলাদেশের তথ্য-সম্প্রচার মন্ত্রী হাসানুল হক ইনুও হাত বাড়িয়ে রেখেছেন। বছর তিনেক আগেই কলকাতায় ফিকি-র সম্মেলনে তিনি এ দেশের ছবি বিশেষত টালিগঞ্জকে আমন্ত্রণ জানিয়ে যান। পরবর্তীতে টালিগঞ্জ ও বলিউড তাঁর কাছে দরবার করে এসেছে। প্রসেনজিত বলেন, এটা তাঁর জীবনের স্বপ্ন। ইনুসাহেবেরও মত, জট কাটলে কলকাতা ও ঢাকা— দু’দিকের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিই উপকৃত হবে। বাজার বাড়ানোই একমাত্র পথ।

এ পারে ছবির বাজেট এক কোটি, সওয়া কোটি ছাড়ালেই দুশ্চিন্তায় রাতের ঘুম মাটি হয় প্রযোজকের। ফেলু-ব্যোমকেশ বাদ দিলে হিট ছবি হাতে গোনা। রাজ্যে মেরে-কেটে ২০-২৫টি মাল্টিপ্লেক্স (মহারাষ্ট্র বা অন্ধ্রপ্রদেশে সংখ্যাটা ১০০-র কাছাকাছি)। হলের সংখ্যা কমতে কমতে ৩৫০। অন্ধ্রে হলের সংখ্যা এর দশ গুণ। ফলে তেলুগু বা মরাঠি ছবি যেখানে ২৫ কোটির শৃঙ্গ ছোঁয়ার কথা ভাবতে পারে, বাংলা ছবির ব্যবসা তিন-চার কোটি ছুঁলেই লটারি জেতার সামিল। ও-পারের দশা আরও করুণ। ১২৮৫টা হল ছিল। কমতে কমতে ৩০০-য় ঠেকেছে। ছবির বাজেট ৮০ লক্ষ ছাড়ালেই প্রযোজক প্রমাদ গোনেন। সুপারস্টার শাকিব খানের ছবি ছাড়া বাংলাদেশে দু’আড়াই কোটির বেশি ব্যবসা অভাবনীয়।

যুগলবন্দির দখিনা বাতাসে কিছু প্রশ্নও অবশ্য খচখচ করছে। ‘‘পরস্পরের জন্য জানলা খুলে দেওয়ার পথে কিছু বাধা রয়েছে,’’ বলছেন বাংলাদেশে ছবির প্রদর্শকদের সমিতির সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট সুদীপ্ত কুমার দাস। যেমন, • যৌথ প্রযোজনার ক্ষেত্রে সমান সুযোগ পাওয়া নিয়ে ঢাকার ইন্ডাস্ট্রিতে শিল্পী-কলাকুশলীদের ক্ষোভ আছে। • ঢাকায় ফিল্ম রিলিজে আমলাতান্ত্রিক গেরো প্রবল। সেন্সর বোর্ড ছাড়াও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের ছাড়পত্র লাগে। ফাইলবন্দি ছবির ভাগ্য টেবিলে পড়ে থাকে। • বাংলাদেশের ছবি মুক্তির সময় কলকাতায় ততটা সহযোগিতা মেলে না বলে অভিযোগ।

ঢাকার এও আশঙ্কা, ছবির মান ও প্রযুক্তিতে এগিয়ে থাকা টালিগঞ্জ বাংলাদেশে ঢুকলে গোটা ইন্ডাস্ট্রির দখল নেবে। ঢাকার ছবি এ পারে কল্কে পাবে কি না, তা নিয়েও রয়েছে সংশয়। গত বছরের একটি যৌথ প্রযোজনা ‘ব্ল্যাক’ নিয়ে বিতণ্ডা কলকাতা হাইকোর্টে গড়িয়েছিল। ঢাকার প্রযোজক কামাল মহম্মদ কিবরিয়া লিপুর মতে, ‘‘একসঙ্গে দুই বাংলায় ছবি রিলিজ করা না-গেলে পাইরেসির দৌলতে ব্যবসা মার খাবে।’’ বেশ কিছু যৌথ উদ্যোগের রূপকার প্রযোজক নাসিরুদ্দিন দিলুর কথায়, ‘‘ঢাকার তারকারা তুলনায় তত পরিচিত নন কলকাতায়। এটা একটু খামতি।’’ কোনও কোনও প্রযোজক-পরিবেশক বাংলাদেশের ছবির প্রতি বিরূপ আচরণ করেন বলেও অভিযোগ।

গৌতম ঘোষের মতো অনেকে কিন্তু বরাবর বলে আসছেন, ঢাকার ছবিকে এ পারে গুরুত্ব দিলে আখেরে লাভ টালিগঞ্জেরও। ফিল্ম পরিবেশক অরিজিৎ দত্ত মনে করেন, বাংলাদেশের ছবির ভাল সম্ভাবনা আছে গ্রামবাংলায়। আবার দুই বাংলায় ছবি প্রচার-প্রসারে যুক্ত শুভজিৎ রায় আশাবাদী, ঠিকঠাক প্রচার হলে বাংলাদেশে অন্য ধারার ছবি এ পারের শহুরে দর্শকদেরও ভাল লাগবে।

(তথ্য সহায়তা: অগ্নি রায়)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন