করিব করিব সিঙ্গল ছবিতে ইরফান ও পার্বতী। ছবি: টুইটারের সৌজন্যে।
ছবি: করিব করিব সিঙ্গল
পরিচালনা: তনুজা চন্দ্রা
অভিনয়: ইরফান খান, পার্বতী, বৃজেন্দ্র কালা, নেহা ধুপিয়া, ঈশা শারভানি, সিদ্ধার্থ মেনন এবং লিউক কেনি।
সত্যি বলতে ছবির ট্রেলার দেখে কেন জানিনা মনে হয়েছিল ছবিটা খুব একটা ইন্টারেস্টিং হবেনা। পরিচালক তনুজা চন্দ্রার শেষ কয়েকটা ছবি দেখার অভিজ্ঞতাও খুব একটা ভাল ছিলনা। মনে হয়েছিল মহিলার হয়তো নতুন করে আর কিছু বলার নেই। ভেবেছিলাম সাত সকালে উঠে ফার্স্ট শো’য়ে ছবি দেখতে গিয়ে ঠাণ্ডা ঘরে বসে আবার শহুরে ফেমিনিজমের বাণী শুনতে হবে। যে বাণীতে হয়তো আভিজাত্য আছে কিন্তু হৃদয় নেই। ক্লাসরুম লেকচার হয়তো আছে কিন্তু সিনেমার ইউনিকনেস নেই। কিন্তু সকাল সকাল নিজের যাবতীয় ভবিষ্যৎ বাক্যগুলিকে ভুল প্রমাণিত হতে দেখে বেশ আনন্দই হল। এভাবে বোকা বনে যাওয়ায় একটা আলাদা তৃপ্তি আছে। এই ছবিতে কোনও ভারী ভারী তত্ত্ব নেই। সো কলড নারীবাদ নেই। আছে মহিলাদের দৃষ্টিকোণ থেকে জগৎ সংসারকে দেখার এবং ছবির মাধ্যমে জগৎকে সেটা দেখানোর একটা সুন্দর, স্মার্ট ও সৎ প্রচেষ্টা।
ছবির টাইটেল কার্ড শুরু হয় জয়া শশীধরণ (পার্বতী) নামক মধ্য তিরিশের এক বিধবা মহিলার রোজকার দিনলিপি দিয়ে। যেখানে খুবই ছোট ছোট মুহূর্ত তৈরি করে দেখানো হয়েছে যে কী ভাবে তিনি একইসঙ্গে একা থাকার স্বাধীনতা উপভোগ করছেন আবার একইসঙ্গে একাকীত্বের যন্ত্রণা ভোগ করছেন। শুরুর এই দৃশ্যই দর্শকদের বুঝিয়ে দেয় যে এই ছবি কিছু নতুন কথা বলতে এসেছে। প্রবল আধুনিক শহুরে জীবনযাপন বা গ্যাদগ্যাদে দুঃখের চিরন্তন প্রথার বাইরে অন্য কিছু দেখাতে এসেছে। এরপর একটা সময় ‘অব তক সিঙ্গল’ নামক একটা ডেটিং অ্যাপসের মাধ্যমে জয়ার সঙ্গে পরিচয় হয় যোগী (ইরফান খান) নামক চল্লিশোর্ধ্ব একজন সিঙ্গল পুরুষের। সে একজন কবি, কিন্তু তার জীবনযাপন কিছুটা রহস্যময়। সে যে কী করে, কোথা থেকে এসেছে তার কোনও ধারণা পাওয়া যায়না। যা বোঝা যায় তা হল তিনি হচ্ছেন একপ্রথাবিরোধী, রসিক পাগল মানুষ। তার জীবনকে দেখা বা উপভোগ করার মধ্যে একটা আলাদা মাধুর্য আছে। এরপর তারা দু’জন একসঙ্গে একটা অ্যাডভেঞ্চারাস ট্রিপে বেরিয়ে পড়ে। যে ট্রিপে তারা তাদের অতীত ও বর্তমান টাইম জোনের মধ্যে একইসঙ্গে বিচরণ করতে থাকে। শুনতে কঠিন শোনালেও ব্যপারটা কিন্তু খুবই রিফ্রেশিং। এক মিনিটের জন্যও ছবিটি আপনাকে বোর করেনা। প্রতি মুহূর্তই হয়ে ওঠে ছোট ছোট সুখ-দুঃখ ভরা জীবনের সেলিব্রেশন।
আরও পড়ুন, মুভি রিভিউ: ছবিটা ব্ল্যাক কমেডি আর দর্শকদের জীবনে গভীর ট্র্যাজেডি
ছবিটা অবশ্যই প্রেমের ছবি। কিন্তু প্রেমের এক নতুন বর্ণে, গন্ধে, ছন্দে, গীতিতে হৃদয়কে দোলা দেয়। ছবিটা সম্পর্কের স্বাধীনতার কথা বলে। আবার কখনও কখনও আমাদের সম্পর্কগুলো যখন একঘেয়ে হয়ে যায় তখন জীবন কোন পথে চলতে চায় ছবিটা তার কথাও বলে। একসময় যখন কারও সঙ্গে একা হতে মন চায় সেখানে যে স্বাধীনতা রয়েছে তাকেও ছবিটা ছুঁয়ে যায়। সম্পর্কের এই স্তরগুলো মেয়েরা যতটা ভাল ফিল করতে পারে ছেলেরা ততটা ভাল ফিল করতে বা বুঝতে পারেনা। ফলে একজন মহিলা ফিল্ম মেকারের চোখ দিয়ে এগুলো দেখার তৃপ্তিই আলাদা। ছবির এই ছোট ছোট ফেমিনাইন টাচগুলো বহুদিন পর রুপোলী পর্দায় দেখে ঘুম চোখে সকাল নটার শোতে ছবি দেখতে যাওয়ার ক্লান্তিটা নিমেষের মধ্যে দূর হয়ে গেল। সারাদিন কাজকর্ম করে গভীর রাতের শোতে দেখতে গেলেও আশা করি আপনাদের ক্লান্তি একইভাবে কেটে যাবে। মহিলাসঙ্গ সবসময়েই ক্লান্তি দূর করায়। এখানে তো সোনায় সোহাগা। একই সঙ্গে পরিচালক তনুজা চন্দ্রা আর অভিনেত্রী পার্বতী দু’ঘণ্টা ধরে আপনাকে সঙ্গ দেবে। ছবিটা শেষ হওয়ার পরেও মনে একটা সুন্দর রেশ থেকে যায়। বাড়ি ফিরে দিনগত পাপক্ষয়ে ডুবে যাওয়ার পরেও ছবিটা আপনার সঙ্গ ছাড়ে না। অবচেতনে থেকে যায়।
আরও পড়ুন, মুভি রিভিউ: ঘুরে দাঁড়ানোর উড়ান ধরলেন দেব
রসিকজনেরা বলে যে প্রাক্তন প্রেমিক-প্রেমিকারা নাকি মননে বড় হয়, সঙ্গ দেয়। বাস্তব অবশ্য সেরকম হয়না। সকলেই একটা সময় পর মুভ অন করে যায়। নতুন জীবনের সঙ্গে মানিয়ে নেয়। কিন্তু হালকা একটা রেশ তো থেকেই যায়। কোনও নতুন সঙ্গী, কোনও নতুন সম্পর্ক, কোনও নতুন দেশ, কোনও নতুন কাল সেই রেশ সম্পূর্ণ ভাবে ভুলিয়ে দিতে পারেনা। শত কাজের মাঝেও যাঁরা এসব নিয়ে ভাবেন তাঁরা ছবিটা দেখুন। রসিক জনেরা আরও বলে যে নতুন প্রেমে পড়লে মেয়েরা নাকি ডিজাইনার ব্রা কেনে আর ছেলেরা ভাল করে সাবান মেখে স্নান করে। কেন করে, জিজ্ঞেস করলে রসিকজনেরা উত্তর দেয়না। বলে,‘অত জানার কী দরকার? বেশি জানলে চাপ আছে।’যাঁরা এরূপ প্রেমের গন্ধে থাকতে ভালবাসেন তাঁরাও ছবিটা দেখুন। যাঁরা কাছাকাছি থেকেও সিঙ্গল থাকার মজাটা জানেন। বেশি কাছে যেতে গিয়ে কেসটা কেঁচিয়ে ফেলার ব্যপারে বিশেষ আগ্রহী হন না। যাঁরা প্রেমে লটকে থাকার অনুভূতিটা উপভোগ করতে জানেন তাঁরা ছবিটা দেখুন। এই প্রেম হচ্ছে-হবে, এই জিনিসটাই আসলে মজার। এতেই যাবতীয় এক্সাইটমেন্ট লুকিয়ে আছে, কিউরিসিটি আছে, থ্রিল আছে, অ্যাডভেঞ্চার আছে, প্রতিবার নিজেকে টিন এজার মনে হওয়ার খেলা আছে। প্রেমটা হয়ে গেলেই আদতে ব্যপারটা গ্যাদ্গ্যাদে হয়ে যাওয়ার চান্স থাকে। চুমু খেয়ে ফেললে কেসটা জটিল হয়ে যায়। আর বিয়ে করে ফেললে তো পুরো গন কেস। যাঁরা এই খেলার মর্ম বোঝেন তাঁরা ছবিটা অবশ্যই দেখুন। যাঁরা অত শত জটিল ব্যাপার বোঝেন না তাঁরাও দেখুন। নতুন জিনিস জানতে দোষ কী?
আরও পড়ুন, মুভি রিভিউ: নিউটন, এই ছবি শেষ হয়, ফুরিয়ে যায় না
আপনাদের হয়তো এটা ভেবে আশ্চর্য লাগছে যে এত কথা বলে ফেললাম অথচ ইরফান খানের অভিনয় নিয়ে একটা কথাও বললাম না। আসলে বলার মতো ভাষা বা বিশেষণ খুঁজে পাচ্ছিলাম না। এখনও পাচ্ছিনা। ক’দিন আগে ‘ডুব’ ছবিতে ইরফানকে দেখেছিলাম ভেঙেচুরে যাওয়া অসহায় একজন মধ্যবয়স্ক পুরুষের রূপে। আর আজকে দেখলাম চল্লিশ ঊর্ধ্ব একজন রসিক প্রেমিকের রূপে। আহা, কি প্রেমিক! দিল খুশ হো গ্যয়া। অভিনয়ে এত ভ্যারাইটি আনতে মনে হয়না আর কেউ পাড়বে। জানি, একদিন ইরফানকে রিটায়ার করতে হবে। সকলকেই করতে হয়। কিন্তু যেদিন ও রিটায়ার করবে সেদিন হয়তো পৃথিবী থেকে একধরনের অভিনয় ঘরানা সম্পূর্ণ লুপ্ত হয়ে যাবে। তবে আপাতত সেরকম কিছু হচ্ছেনা। আপাতত ‘করিব করিব সিঙ্গল’ দেখুন আর তরতাজা হয়ে যান।
পুনশ্চ: হল থেকে বেরিয়ে দু’জন মহিলার কথা কানে এলো। বয়সে ছোট জন অপরজনকে বলছিল,‘বেশি বয়সের প্রেমের একটা আলাদা মজা আছে। ট্রাই কর।’আমার মুখ দিয়ে জাস্ট বেরিয়ে যাচ্ছিল,‘আরে পাগল, প্রেমের আবার কোনও বয়েস আছে নাকি?’বললাম না, কারণ বাড়ি ফিরে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রিভিউ লেখার প্রেশার ছিল!