বাপ্পি লাহিড়ীর জন্মদিনে জিতের স্মৃতিচারণ। ছবি: সংগৃহীত।
আজ বাপ্পিদার জন্মদিন। তাই এটা আমার জন্যও খুব বিশেষ দিন। এক অদ্ভুত যোগ ছিল বাপ্পিদার সঙ্গে, যা আজও অনুভব করি। আমাকে খুব ভালবাসতেন। ছোট থেকে ওঁর গান শুনে বহু কিছু শিখেছি। বাপ্পিদাও আমার গান শুনে ফোন করে ওঁর অনুভূতি ভাগ করে নিতেন। আমার ‘মুসকুরানে কি ওয়াজা’ গানটি ওঁর খুব ভাল লেগেছিল। অন্তরার অংশটা পছন্দ হয়েছিল।
এখনও ভাবি, একজন সুরকারের কত বড় পরিধি থাকতে পারে! এক দিকে নাচের গান, আর এক দিকে সুরেলা গান— কত রকমের গান বেঁধেছেন উনি। একই মানুষ ‘ডিস্কো ডান্সার’, ‘ডান্স ডান্স’ ও ‘এ আমার গুরুদক্ষিণা’, ‘তখন তোমার একুশ বছর’-এর মতো গান তৈরি করেছেন। ভাবা যায়?
বাপ্পিদার অন্যতম সৃষ্টি ‘চিরদিনই তুমি যে আমার’। পরে এই একই নামের ছবির সঙ্গীত পরিচালনার দায়িত্ব পাই আমি। সঙ্গে সঙ্গে বাপ্পিদাকে ফোন করে বলেছিলাম, ‘দাদা, তুমি আমাকে আশীর্বাদ কোরো এবং সাহস দিয়ো।’ আসলে ‘চিরদিনই তুমি যে আমার’ এমন একটি গান যা চিরন্তন হয়ে আছে। এখনও বুম্বাদাকে দেখলে ওই গানটাই মনে পড়ে। বাপ্পিদা শুধু বলেছিলেন, ‘তুমি শুধু মন দিয়ে কাজটা কোরো’। এইটুকুই আমার জন্য অনেক ছিল।
‘চিরদিনই তুমি যে আমার’ ছবির ‘বাতাসে গুনগুন’, ‘ঝিরিঝিরি’ এই গানদু’টি বাপ্পিদার খুব ভাল লেগেছিল। বৌদিও (বাপ্পি লাহিড়ীর স্ত্রী চিত্রাণী লাহিড়ী) আমাকে ফোন করে ভাললাগার কথা বলেছিলেন। আমরা একটা পরিবারের মতো। আমাকে আর স্ত্রী চন্দ্রানীকে ডেকে মাছভাত খাইয়েছেন কত বার! এখনও আমরা পরিবারের মতোই।
সম্প্রতি ‘সারেগামাপা’-তে বাপ্পিদাকে উৎসর্গ করে একটা পর্ব হল। আমি বৌদিকে ফোন করে বললাম। সত্যিই চোখে জল এসে যায় এখনও।
বাপ্পিদা এই সঙ্গীতজগতের জন্য অনেক করেছেন। অর্কেস্ট্রা ও ডিস্কো-র যে সাউন্ড তা ওঁর হাত ধরেই আমাদের কাছে এসেছিল। এক দিকে ‘ইয়াদ আ রহা হ্যায়’, আর এক দিকে ‘আজি এ প্রভাতে’র মতো গান বেঁধেছিলেন। এর থেকেই ওঁর ব্যাপ্তিটা বোঝা যায়। আমাকেও সেই পরামর্শই দিয়েছিলেন। ওঁর দেখানো রাস্তা অনুসরণ করেই এক দিকে ‘ভজ গৌরাঙ্গ’ ও আর এক দিকে ‘হমারি অধুরি কহানি’র মতো গান বাঁধার সাহস পেয়েছিলাম।
বাপ্পিদা সুরস্রষ্টা ছিলেন তো বটেই! তালবাদ্যেও কিন্তু ওঁর অগাধ জ্ঞান ছিল। খুব সুন্দর তবলা বাজাতেন। তালজ্ঞান যাঁর ভাল, তাঁর সঙ্গীতসৃষ্টি ভাল হবেই। কণ্ঠশিল্পী হিসাবেও অতুলনীয় ছিলেন বাপ্পিদা। আমার পরিচালনায় বহু শিল্পী গেয়েছেন। কিন্তু রেকর্ডিং মাইকের সামনে বাপ্পিদা গিয়ে দাঁড়াতেই আবহ বদলে যেত। ওঁর কণ্ঠ যেন মুহূর্তে ম্যাজিক করে দিত।
সঙ্গীতের পাশাপাশি মানুষ বাপ্পিদার কথা তো বলতেই হয়। খুব আপন করে নিতে জানতেন। মানুষটাই বড় ভাল। মুম্বইয়ে থাকলেও আদ্যোপান্ত বাঙালি মানুষ ছিলেন। বাড়িতে বাঙালি খাবার হত। খাদ্যরসিক ছিলেন। মাছ বড় প্রিয় ছিল। এটাও ওঁর থেকে পাওয়া একটা শিক্ষা। আমাদের মুম্বইয়ের বাড়িতেও রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনা যায় এবং প্রচুর বই পাওয়া যায়। খাবারের তালিকায় আলু পোস্ত, মাছের ঝোল থাকবেই।
করোনা অতিমারির পরে এক দিন এসেছিলেন আমাদের বাড়িতে। মনে আছে দিনটা। আজকের দিনটা ওঁর পরিবার ও অনুরাগীরা উদ্যাপন করছেন। আমার বিশ্বাস, বাপ্পিদা বেঁচে থাকলে আজও কাজ নিয়েই থাকতেন। গানেই নিমজ্জিত থাকতেন। সবচেয়ে বড় বিষয় বাপ্পিদার চলে যাওয়ার বয়সই হয়নি। আমাদের কাছে তাই ওঁর চলে যাওয়া বড় ক্ষতি। তবে সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয়েছে বৌদির। চিত্রাবৌদি সত্যিই ওঁর ছায়াসঙ্গী ছিলেন। বাপ্পিদা কখন কোথায় পা ফেলবেন, সবটা জানতেন। বৌদির জীবন অনেকটা খালি হয়ে গিয়েছে। প্রতি বছরের মতো এ বারও বৌদির সঙ্গে কথা বলব।