তাঁদের প্রথম আলাপ আন্দোলনের মঞ্চে
Shaoli Mitra

Shaoli Mitra death: পঁচিশ বছরের একটি মেয়ে এসে সকলের নজর কেড়ে নিল

দর্শক দেখলেন ‘নাথবতী অনাথবৎ’ নাটকের মঞ্চায়ন। শাঁওলী মিত্রের রচনায় ও একক অভিনয়ে এ নাটক বাংলা থিয়েটারে এক মাইলস্টোন হয়ে আছে।

Advertisement

জয় গোস্বামী

শেষ আপডেট: ১৮ জানুয়ারি ২০২২ ০৫:২৩
Share:

শাঁওলী মিত্র।

এক সময়ে মঞ্চে দাঁড়িয়ে অভিনয় করার শারীরিক শক্তি চলে গেল শাঁওলী মিত্রের। অথচ বালিকাবয়স থেকেই শাঁওলী মিত্র স্টেজে অভিনয় করতে করতে বয়ঃপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। ‘ডাকঘর’ নামক রবীন্দ্রনাটক যখন বহুরূপী নাট্যগোষ্ঠীর দ্বারা প্রথম মঞ্চস্থ হয়, তখন বালিকা শাঁওলী করেছিলেন ‘অমল’-এর চরিত্র। আমি সে অভিনয় দেখিনি। কিন্তু বহুরূপীর প্রবীণ অভিনেতা দেবতোষ ঘোষ, যিনি কোভিডে ২০২১ সালে প্রয়াত হয়েছেন, তাঁর মুখে শুনেছি গোটা নাটক জুড়ে ‘অমল’ চরিত্রের দীর্ঘ সব সংলাপ, কেমন মর্মগ্রাহী নিপুণতায় ফুটিয়ে তুলতেন শাঁওলী, তাঁর ওই অতটুকু বয়সে। অর্থাৎ বাল্যকাল থেকেই শাঁওলী মিত্রের অভিনয়-প্রতিভা সকলকেই মুগ্ধ করে এসেছে। ১৯৭১ সালে বাদল সরকার রচিত ও শম্ভু মিত্র নির্দেশিত ‘পাগলা ঘোড়া’ নাটকে শাঁওলী মিত্র নিজের অভিনয় দ্বারা এই সত্য প্রতিষ্ঠিত করেন যে, বাংলা রঙ্গমঞ্চে এক তরুণী, প্রতিভাময়ী অভিনেত্রী এসে পড়েছেন। এই নাটকেও দেবতোষ ঘোষ ও শাঁওলী মিত্র দু’জনের উজ্জ্বল অভিনয় আজও পুরনো দর্শকদের মনে আছে। সেই সব দর্শকের একজন আমি। এর পরের বছর, ১৯৭২ সালের ১ মে, বহুরূপী-র পঁচিশ বছর পূর্তি উপলক্ষে শম্ভু মিত্র নির্দেশিত আর এক রবীন্দ্রনাটক ‘রাজা’র অভিনয় হয়। তৃপ্তি মিত্র করেছিলেন রানি ‘সুদর্শনা’র চরিত্র, শাঁওলী হয়েছিলেন ‘সুরঙ্গমা’। সুদর্শনা-সুরঙ্গমার এই জোট বাঁধা অভিনয় এবং বহুরূপী-র অনন্য টিমওয়ার্ক সে দিন প্রযোজনাটিকে কত উচ্চমাত্রায় নিয়ে গিয়েছিল, তার প্রমাণ পাওয়া যায় একটি লেখায়। লেখাটির রচয়িতা ছিলেন সন্তোষকুমার ঘোষ। আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত এ নাটক বিষয়ে তাঁর রচনার শিরোনাম ছিল: ‘এক নদীতে দু’বার স্নান’। দু’বার কেন? কারণ তার আট বছর আগে ’৬৪ সালে বহুরূপীর এই প্রযোজনা দেখেছিলেন সন্তোষকুমার। এ বার সুদর্শনার সঙ্গে সুরঙ্গমারও প্রশংসায় অকৃপণ হয়ে উঠল সন্তোষবাবুর কলম। সুরঙ্গমার কণ্ঠে যে গানগুলি নাটকে ব্যবহৃত হয়, সে সব গানের পরিবেশন ছিল অত্যন্ত সুরঋদ্ধ। তখন শাঁওলী মিত্রের বয়স মাত্র পঁচিশ। পরে, যখন তাঁর সঙ্গে আলাপ হল, তখন দেখেছিলাম ওই সময়ে সুচিত্রা মিত্রের কাছে গান শিখতেন শাঁওলী। মনে রাখতে হবে, সে সময়ে বাংলা থিয়েটারে তৃপ্তি মিত্র তো বটেই, শোভা সেন, কেতকী দত্ত, মায়া ঘোষ, কেয়া চক্রবর্তী... এঁরা দাপটের সঙ্গে কাজ করে চলেছেন। সেখানে পঁচিশ বছরের একটি মেয়ে এসে সকলের নজর কেড়ে নিল।

Advertisement

তার পর বদল ঘটল যুগের। শম্ভু-তৃপ্তি-শাঁওলী কেউই আর রইলেন না বহুরূপী নাট্যদলে। এই সময়ে কলকাতার কয়েকটি নাট্যগোষ্ঠীর সদস্যরা একত্র হয়ে গঠন করলেন এক রেপার্টরি থিয়েটার। সেখানে মঞ্চস্থ হল ‘গ্যালিলিওর জীবন’ নামক নাটক, যাঁর লেখক বের্টোল্ট ব্রেখট। শম্ভু মিত্র অবতীর্ণ হলেন গ্যালিলিওর চরিত্রে। গ্যালিলিওর কন্যা ভার্জিনিয়ার চরিত্রটি করলেন শাঁওলী। এই ভার্জিনিয়ার জীবনে দুর্ভাগ্য নেমে এল তার পিতারই কারণে। ভার্জিনিয়ার হবু স্বামী, গ্যালিলিওর ছাত্র লুদোভিকোকে গ্যালিলিও অপমান করলেন। ক্রুদ্ধ যুবকটি তার প্রেমিকাকে ছেড়ে চলে গেল। যখন ভার্জিনিয়া তার বিয়ের পোশাকটি পরিধান করে মঞ্চে এসেছে সে সময়ে শুনল এই দুঃসংবাদ। মূর্ছিতা হয়ে পড়ল ভার্জিনিয়া।

গ্যালিলিও যখন শেষ বয়সে ভগ্নহৃদয়ে গৃহবন্দি হয়ে প্রহরী-নিয়ন্ত্রিত জীবন কাটাচ্ছে, তখন ভার্জিনিয়ার হাতেই তার পিতার দেখাশোনার ভার। ভার্জিনিয়ার সঙ্গে গ্যালিলিও অত্যন্ত রুক্ষ ও কঠোর ব্যবহার করে সর্বদা। কন্যা মুখ বুজে থাকে। এ-নাটকে ভার্জিনিয়ার সংলাপ খুব কম। শেষ দৃশ্যে মঞ্চের এক দিক দিয়ে ভার্জিনিয়ার প্রবেশ মাত্রই ঝাঁঝিয়ে ওঠে ক্রুদ্ধ গ্যালিলিও। কটুবাক্য বলে। ভার্জিনিয়া কোনও কথা না বলে ধীরে ধীরে পুরো মঞ্চ পার হয়ে অন্য দিক দিয়ে নিষ্ক্রান্ত হয়। শাঁওলী মিত্র সম্পূর্ণ সংলাপহীন এই দৃশ্যটিতে কেবল মুখের পেশির ভাঙন ও কম্পন ছাড়া আর কিছুই ব্যবহার করেন না— যে ভাঙন কন্যার উদ্‌গত কান্নাকে আটকে রাখে। দর্শক বোঝেন, এখনই ভার্জিনিয়া কান্নায় ভেঙে পড়বে। কিন্তু সে কান্নাকে আটকে রাখেন অভিনেত্রী। এ বড় কঠিন কাজ। একটিও সংলাপ ব্যতীত পুরো মঞ্চ পার হওয়া ও এতটা অনুভবের সঞ্চার দর্শকমনে ঘটানো মোটেই সহজ নয়। শাঁওলী তা পেরেছিলেন।

‘গ্যালিলিওর জীবন’ নাটকে বিভাস চক্রবর্তী (বাঁ দিকে) ও শম্ভু মিত্রের সঙ্গে

এল ১৯৮৩। দর্শক দেখলেন ‘নাথবতী অনাথবৎ’ নাটকের মঞ্চায়ন। শাঁওলী মিত্রের রচনায় ও একক অভিনয়ে এ নাটক বাংলা থিয়েটারে এক মাইলস্টোন হয়ে আছে। মহাভারতের এক-একটি চরিত্র, এক-এক রকম স্বরপ্রয়োগে, এক-এক রকম শরীরভঙ্গিমায়, এক-এক রকম পদক্ষেপে মূর্ত হয়ে উঠতে লাগল শাঁওলী মিত্রের তুলনারহিত অভিনয়-ক্ষমতায়। প্রত্যেক শো তখন হাউসফুল যাচ্ছে। ১৯৮৯ সালে এল মহাভারত নিয়ে আরও এক নাটক— ‘কথা অমৃতসমান’। এই নাটকও লিখলেন শাঁওলী মিত্র নিজেই। অভিনয়ও করলেন একা। দু’টি নাটক একত্র হয়ে গ্রন্থ রূপে প্রকাশ পাওয়ার পরে এই বইয়ের জন্য আনন্দ পুরস্কার প্রদান করা হল শাঁওলী মিত্রকে।

Advertisement

২০০৪ সালে জাঁ পল সার্ত্রের একটি নাটকের অনুবাদ করলেন অর্পিতা ঘোষ। ‘রাজনৈতিক হত্যা’ নামক সেই নাটকে শাঁওলী নিজে অভিনয় করেননি, কিন্তু নির্দেশনার দায়িত্ব নিয়েছিলেন। এই নাটকের প্রযোজনা দর্শকের এবং সমালোচকের প্রশংসা পেয়েছিল।

নন্দীগ্রামে হিংসার প্রতিবাদে মৌন-মিছিলে

এর পর ২০০৭ সালে এল নন্দীগ্রামে গুলিচালনায় ১৪ জন কৃষকের মৃত্যু এবং কৃষকরমণীদের ধর্ষিতা হওয়ার ঘটনা। মহাশ্বেতা দেবীর নেতৃত্বে বাংলার অনেক চিত্রকর, নাট্য ব্যক্তিত্ব, শিক্ষাবিদ সকলে রাস্তায় নামলেন। মিছিলে হাঁটলেন শঙ্খ ঘোষ, অপর্ণা সেন, ঋতুপর্ণ ঘোষ, কৌশিক সেন, শুভাপ্রসন্ন, যোগেন চৌধুরী, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। সেই মিছিলে প্রথম সারিতে হাঁটলেন শাঁওলী মিত্রও। অন্য দিক থেকে রাজনৈতিক ভাবে এই ঘটনার প্রতিবাদে উঠে দাঁড়ালেন জননেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনিই যে সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তি, তা হৃদয়ঙ্গম করে পশ্চিমবঙ্গবাসী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতেই তুলে দিলেন রাজ্য শাসনের ভার, নির্বাচনের মাধ্যমে। শাঁওলী মিত্র হলেন পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির সভাপতি। মমতা খুবই শ্রদ্ধা করতেন শাঁওলী মিত্রকে, আন্দোলনের সময় থেকেই।

শারীরিক কারণে তখন তিনি মঞ্চে বসে কেবল পাঠ-অভিনয় করেন। তাঁর একক অভিনয়ের বিখ্যাত নাটক দু’টি তো বটেই, ‘রক্তকরবী’র পাঠ-অভিনয়ও দর্শকের কাছে মূল্যবান হয়ে উঠল। এ সময়ে তিনি গ্রন্থ রচনায় মনোনিবেশ করেছেন। ‘গণনাট্য, নবনাট্য, সৎনাট্য ও শম্ভু মিত্র’, ‘দিদৃক্ষা’ এবং ‘শম্ভু মিত্র রচনাবলী’ প্রকাশ পেল আনন্দ পাবলিশার্স থেকে। অন্য প্রকাশনা থেকে বেরোল তাঁর লেখা শম্ভু মিত্রের জীবনী।

ব্যক্তিগত ভাবে ২০০৭ সালের নন্দীগ্রাম আন্দোলনের সময় থেকেই তাঁর সস্নেহ সাহচর্য পেয়েছি আমৃত্যু। বাংলা আকাদেমির কাজে দেখেছি, সকলকে স্নেহ করার সঙ্গে সঙ্গে বয়সে কনিষ্ঠদেরও তাঁদের কাজের জন্য সম্মান প্রদর্শন করতে তিনি অকুণ্ঠিত ছিলেন। গ্যালিলিওর কন্যা ভার্জিনিয়া তাঁর পিতাকে কিছু চিঠি লিখেছিলেন, তার একটি সঙ্কলন আমার কাছে ছিল, ইংরেজি অনুবাদে। বইটি আমি শাঁওলীদিকে পড়তে দেওয়ায় উনি খুব খুশি হন। শাঁওলী মিত্রকে হারানো আমার কাছে এক নিজস্ব ক্ষতি। অর্পিতা ঘোষের মুখে শুনলাম, মৃত্যু সন্নিকট জেনে কী ভাবে তিনি শান্ত হাতে অক্সিজেন মাস্ক খুলে ফেলেছিলেন। অর্পিতা বাধা দিলে বলেছিলেন, ‘‘আমাকে যেতে দে। আমি যাই।’’ তার পরেই চলে যান তিনি। এই ভাবে সুদৃঢ় সাহসে, মৃত্যুযন্ত্রণাকে বরণ করা, এ কি আমরা, সাধারণ মানুষরা ভাবতে পারি?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন