Entertainment News

পপকর্ন চিবোতে চিবোতে দেখলেও এই ছবির জাত নষ্ট হয় না

গল্পের কাঠামো সহজ সরল হলেও গল্প বলার অভিনব স্টাইল ফুটিয়ে তুলেছেন অনুরাগ। ‘জগ্গা জাসুস’ এই জন্যই দেখতে আরও ভাল লাগে কারণ এই ছবিতে অনুরাগের সিনেমা-বৈদগ্ধতাকে বুঝতে দাঁত দিয়ে নখ খুঁটতে হয় না।

Advertisement

রণজিত্ দে

শেষ আপডেট: ১৬ জুলাই ২০১৭ ১৭:১১
Share:

‘জগ্গা জসুস’-এর একটি দৃশ্যে রণবীর।

ছবি শুরু হব-হব করছে। বাবা তার নিজের খুদেটিকে একবার বুঝিয়ে দিল, “দেখবে ছেলেটির কী বুদ্ধি! পোয়েম করে করে কথা বলে আর ডিকেক্টিভ-এর মতো সব কেস সলভ করে দেয়...দারুণ বুদ্ধি! খুব মজার ছবি!” খুদেটি ঢক করে মাথা নাড়ে। শুরু হয় ‘জগ্গা জাসুস’।

Advertisement

অনুরাগ বসুকে কলকাতারই এক সাংবাদিক একবার প্রশ্ন করেছিলেন, “আপনি বাংলা ছবি করেন না কেন?” অনুরাগ খুব সহজে বলেছিল, “আমার দর্শকের একটা প্রচণ্ড খিদে আছে। বাংলা ছবি করলে অত দর্শক পাব কোথায় বলুন!” মনে হল ‘জগ্গা জাসুস’ করার সময় অনুরাগের সেই খিদে আরও বেড়েছে। এই ছবিতে অনুরাগ খুদে দর্শকদেরও ছাড়তে চাননি। আট থেকে আশি সবাই এ-ছবির সহজাত দর্শক। এমন ছবি বানানো কিন্তু মোটেই মুখের কথা নয়। খুদেরা মজা পাবে আবার বড়রাও টানটান হয়ে দেখবে এমন ছবি আর ক’জনই বা বানাতে পারেন! কিন্তু অনুরাগ বসু পেরেছেন। ‘জগ্গা জাসুস’ সেই ছবি যা ছবি দেখে খুদেরা যেমন হাততালি দেবে বড়রাও তেমন ভাবাবে।

আরও পড়ুন, বক্স অফিসে কেমন রেজাল্ট করল ‘জগ্গা জসুস’?

Advertisement

ময়নাগুড়ির ছেলে জগ্গা (রণবীর কপূর) ছোটোবেলাতেই মা-বাবাকে হারায়। হাসপাতালেই বড় হতে থাকে সে। একদিন এক অলস দুপুরে ছোট্ট জগ্গা ঝিলের ধারে বসে আছে, হঠাত্ই সে দেখল একটি লোক চলন্ত ট্রেন থেকে পড়ে গেল! তাড়াতাড়ি ছুটে গেল জগ্গা। হাসপাতালে নিয়ে এসে সেবা করল। লোকটির যতই খেয়াল রাখুক না কেন সে, লোকটি কিছুতেই ছোট্ট জগ্গার ভাষা বুঝতে পারে না। পারবে কী করে! ছোট্ট জগ্গা তো মুখে রা-টি কাটে না! কিছু বলতে গেলেই যে তার ঠোঁটের গোড়ায় শব্দগুলো তালগোল পাকিয়ে যায়। ছোট্ট জগ্গা তাই চুপ করেই থাকে। সেই লোকটি তাকে একদিন শেখায়, “শব্দরা যখন তোমার থেকে কথা হয়ে বেরয় না, তখন শব্দরা তোমার থেকে গান হয়ে বেরবে। তুমি সুরে সুরে কথা বল।” ছোট্ট জগ্গার ঠোঁট নড়ল। গানে-গানে ওদের মধ্যে বন্ধুত্ব হল। লোকটিকে আদরে করে জগ্গা ডাকতে শুরু করল টুটিফুটি(শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়)। এই টুটিফুটিই জগ্গার জীবনে সব হয়ে দাঁড়ালো। একদিন টুটিফুটি ছোট্ট জগ্গাকে বোর্ডিং স্কুলে ভর্তি করে দিয়ে চলে গেল। চলে গেল ঠিকই, কিন্তু জগ্গার প্রত্যেক জন্মদিনে টুটিফুটি একটা করে ডিভিডি পাঠাতো। খুব মন দিয়ে জগ্গা দেখতো সেই সব ডিভিডি। কত রকমের জিনিস ওইসব ডিভিডিতে তাকে শেখাতো তার টুটিফুটি। এই ভাবেই বড়ো হচ্ছিল জগ্গা। বড়ো হয়ে জগ্গা হয়ে উঠল সত্যান্বেষী। সবাই চোখের সামনে দেখল একটি মেয়ে আত্মহত্যা করল, কেবল জগ্গা বলল, “এটা সুইসাইড নয়, মার্ডার।” জগ্গা পাক্কা ডিডেক্টিভের মতো তা প্রমাণও করে দিল। একদিন সে খবর পেল তার টুটিফুটি আর বেঁচে নেই! কিন্তু তা কী করে সম্ভব! দু’দিন আগেই তো টুটিফুটি তাকে ফোন করেছিল! তবে কি এটা কোনো চক্রান্ত? জগ্গা খুঁজতে বেরোয় তার টুটিফুটিকে। শেষমেশ কি খুঁজে পায় জগ্গা তার টুটিফুটিকে?

‘জগ্গা জসুস’-এর একটি দৃশ্যে রণবীর।

গল্পের কাঠামো সহজ সরল হলেও গল্প বলার অভিনব স্টাইল ফুটিয়ে তুলেছেন অনুরাগ। ‘জগ্গা জাসুস’ এই জন্যই দেখতে আরও ভাল লাগে কারণ এই ছবিতে অনুরাগের সিনেমা-বৈদগ্ধতাকে বুঝতে দাঁত দিয়ে নখ খুঁটতে হয় না। বরং পপকর্ন আর কোল্ড ড্রিংক্স গলায় ঢালতে ঢালতে ওঁর সহজাত সিনেমা বোধনকে উপভোগ করা যায়। পুরো ছবিটাকে গানে গানে বেঁধেছেন অনুরাগ। সুর-তাল-লয় এর ছান্দিক উপস্থাপনায় এবং ইমেজ-লাবণ্যে অনুরাগ এমন এক রূপকথার আবহ তৈরি করেছেন যে জগ্গার পা চিতায় টানলে বা কপালে বন্দুক ঠেকালেও অনায়াসে পপকর্ন চিবানো যায়! টেনশনে হাড় হিম হয়ে যায় না। চার্লি চ্যাপলিনকে বিপদে পড়তে দেখলে কি আমাদের হাত-পা সিঁটিয়ে যায়? বা গুপী-বাঘাকে বাঘের মুখের সামনে দেখলে কি আমরা চোখ বন্ধ করে ফেলি? অথবা চার্লির দুঃখে আমরা কি কখনও চোখ মুছেছি? অথবা গুপী-বাঘাকে গাধার পিঠে চড়তে দেখে কি চোখের জল ফেলেছি? জগ্গার থেত্রেও তাই হয়েছে। একটানা গল্প এই ছবিতে বলা হয়নি। পরিচালক গল্প ভেঙেছেন। সিনেম্যাটিক নৈপুন্যতায় টাইম-স্পেস নিয়ে খেলা করেছেন। এমন খেলা খুব কম ছবিতেই দেখতে পাওয়া যায়। আর এখানেই ‘জগ্গা জাসুস’ তার নিজের চারপাশে একটা লক্ষ্মণরেখা টেনে দিয়েছে।

আরও পড়ুন, ‘জগ্গা জসুস’ বনাম ‘শব’, জিতবে কে? কী বলছে গুগল?

কুর্নিশ অনুরাগকে। আপাত আদ্যন্ত হাল্কা, মুচমুচে, নরম ছবির বুকে পুঁতে দিয়েছে গভীর-গহন ভাবনার বীজ। তাই এই ছবি শুধু তোতলা জগ্গার নানারকম কীর্তিকলাপের ছবি নয়। বা শুধু বাবা-ছেলের (জগ্গা ওর টুটিফুটিকে বাবা বলেই মেনে নিয়েছে) সম্পর্কের ক্ষুদ্র পরিসরে আটকে থাকার ছবিও নয়। বরং সেই বেড়াজাল টপকে এক বৃহত্তর আঙ্গিকে পৌঁছে গিয়েছে এই ছবি। ছবির শুরুতেই আমরা দেখি পুরুলিয়ার মাটিতে কারা যেন প্লেন থেকে বাক্স বাক্স বন্দুক ফেলে দিয়ে গেল! আর ছবি শেষ হচ্ছে জগ্গা অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে বন্দুকভর্তি বাক্স পালটে সেখানে রেখে দিচ্ছে কেক-পেস্ট্রির বাক্স। প্লেন থেকে ভরা ভরা সেই কেক-পেস্ট্রির বাক্স ফেলা হচ্ছে পৃথিবীর বুকে। বাচ্চারা ধেয়ে আসছে সেইসব কেক-পেস্ট্রি নিতে! তাদের মুখে কী অনাবিল আনন্দ!

‘জগ্গা জসুস’-এর একটি দৃশ্যে ক্যাটরিনা।

শেষেও একটা চমক রেখেছেন অনুরাগ। সেটা কী বলছি না। তবে শেষমেশ খুবই বাস্তবমুখী। জগ্গা ধরা পড়েছে বন্দুকবাজ সর্দার-এর কাছে। সে কি ছাড়া পাবে? এই উত্তর অনুরাগ কেন গোটা পৃথিবীর জানা নেই। আর এখানেই জগ্গা জাসুস আজকের দিনে দাঁড়িয়ে একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছবি হয়ে উঠল।

এই ছবির আর-এক সম্পদ রণবীর কপূর। যত দিন যাচ্ছে তত রণবীর ধারালো হয়ে উঠছেন। ওঁকে আর আজকাল আলাদা করে অভিনয় করতে হয় না। শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়, রজতাভ দত্ত, ক্যাটরিনা কইফ সকলেই বেশ ভাল। আলাদা করে বলতে হয় কোরিওগ্রাফার শমক দাভার-এর কথা। এই ছবির প্রাণভোমরা প্রীতমের মিউজিক। আর রবি বর্মনের ক্যামেরা তো সারা ক্ষণ আদর করে গেছে প্রতিটা ফ্রেম।

ছবিতে বেশ কিছু পশু পাখি রেখেছেন অনুরাগ। ওরা যেন আমাদের মানে মানুষের এই কীর্তিকলাপ অবাক চোখে দেখছে! হল থেকে বেরিয়ে মনে হল অনেক দর্শক ও কি ওইভাবেই অবাক চোখে অনুরাগের কীর্তিকলাপ দেখে গেলেন!! এই রিভিউটা তাদের জন্য।

ছবি: ইউটিভি মোশন পিকচার্সের এর ইউটিউব পেজের সৌজন্যে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন