কানের লাল গালিচায় (বাঁ দিকে) সিমি গারেওয়াল। ওয়েস অ্যান্ডারসন, শর্মিলা ঠাকুর এবং অগ্নি দত্ত (ডান দিকে)। ছবি: সংগৃহীত।
প্রথম বার কান চলচ্চিত্রোৎসবে প্রদর্শিত হচ্ছে সত্যজিৎ রায়ের ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’। মুক্তির ৫৫ বছর পর বড় পর্দায়, সময়ের গায়ে লাগা ধুলো ঝেড়ে নতুন আলোয় ঝকঝকে হয়ে উঠেছে সে ছবি। সোমবার সন্ধ্যায় (ভারতীয় সময় রাত প্রায় ১০ টা ১৫ মিনিট) ফ্রান্সের কান শহরে আয়োজিত আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের জমজমাট প্রাঙ্গনে হেঁটে এলেন ছবির দুই মুখ্য চরিত্রের অভিনেত্রী— শর্মিলা ঠাকুর ও সিমি গারেওয়াল। লাল গালিচা ঝলমল করে উঠল শর্মিলার সোনালি পাড় সবুজ রেশমি শাড়ির ছটায়, সাদা পোশাকে স্নিগ্ধতা ছড়ালেন সত্যজিতের ‘দুলি’ সিমি। সঙ্গী হলেন সত্যজিৎ অনুরাগী আমেরিকান পরিচালক ওয়েস অ্যান্ডারসন। আন্তর্জাতিক দর্শকের সামনে তৈরি হল এক নতুন ইতিহাস।
১৯৭০ সালে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের উপন্যাস অবলম্বনে ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ মুক্তি পেয়েছিল। যদিও মূল কাহিনিকে খানিক নিজের মতো করে তুলেছিলেন সত্যজিৎ। নগরকেন্দ্রিক চার যুবকের মনের ভিতরে ঘাপটি মেরে থাকা সাদা আর কালো চিন্তাপ্রবাহ ১১৫ মিনিট নড়াচড়া করে বেড়িয়েছিল পালামৌয়ের জঙ্গলে। সবুজ নয়, সে জঙ্গল তখন প্রবল গ্রীষ্মে জ্বলন্ত। তবু, স্নিগ্ধ। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়, রবি ঘোষ আর শমিত ভঞ্জের বিপরীতে সেই স্নিগ্ধতারই তিনটি রূপ যেন তুলে ধরেছিলেন শর্মিলা ঠাকুর, কাবেরী বসু এবং সিমি গারেওয়াল। এই ছবি ২০তম বার্লিন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা চলচ্চিত্রের জন্য গোল্ডেন বিয়ারের পুরস্কারে মনোনীত হয়েছিল।
এ ছবি তৈরি হয়েছিল প্রিয়া ফিল্মসের অসীম দত্ত, নেপাল দত্তের প্রযোজনায়। তাই এ ছবির প্রিন্ট সংরক্ষিত ছিল প্রিয়ার তরফে পূর্ণিমা দত্তের কাছেই। ওয়েস অ্যান্ডারসন এবং সন্দীপ রায়ের উদ্যোগে ফিল্ম হেরিটেজ ফাউন্ডেশন, জানুস ফিল্মস, দ্য ক্রাইটেরিয়ন কালেকশনের সহযোগিতায় ল ইম্যাজিন রিট্রোভাটা-তে দ্য ফিল্ম ফাউন্ডেশনের ওয়ার্ল্ড সিনেমা প্রজেক্ট-এ ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ ছবিটি পুনরুদ্ধার করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে আর্থিক ভার বহন করেছে গোল্ডেন গ্লোব ফাউন্ডেশন।
এর আগেই সন্দীপ আনন্দবাজার ডট কমকে জানিয়েছিলেন, শুধু ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ই নয়। এই বিশেষ উদ্যোগে পূর্ণিমা দত্তের কাছে সংরক্ষিত আরও দু’টি ছবি ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ এবং ‘গুপি গাইন বাঘা বাইন’-কেও একে একে পুনরুদ্ধার করা হবে।
সোমবার সন্ধ্যায় কান চলচ্চিত্রোৎসবের লাল গালিচায় সাদা পোশাকে এসেছিলেন সিমি গারেওয়াল— সত্যজিতের ‘দুলি’। পর্দায়ও সাদা শাড়ি আর রূপদস্তার গয়নায় সেজেছিলেন সাঁওতালি মেয়ে। লাল কার্পেটে তাঁর পাশেই ছিলেন আর এক নায়িকা ‘অপর্ণা’, শর্মিলা ঠাকুর। এ দিনের অনুষ্ঠান মঞ্চে ছবিটি উপস্থাপন করবেন ওয়েস অ্যান্ডারসন। সারা বিশ্ব তাঁকে চেনে সত্যজিৎ অনুরাগী হিসাবে। তাঁর বিখ্যাত ছবি ‘দি দার্জিলিং লিমিটেড’-এ বার বার ধরা পড়েছে সেই অনুপ্রেরণা। দৃশ্য নির্মাণ থেকে আবহ অ্যান্ডারসন তুলে এনেছেন ‘চারুলতা’, ‘তিনকন্যা’ বা ‘জয়বাবা ফেলুনাথ’কে। ঘটনাচক্রে ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’র সঙ্গেও এক আশ্চর্য যোগ রয়েছে অ্যান্ডারসনের। সত্যজিৎ যে বছর সদলবলে পালামৌয়ের জঙ্গলে শুটিং করছেন, সেই ১৯৬৯ সালেই জন্ম আমেরিকান পরিচালকের। আরও অদ্ভুত বিষয় হল তাঁর জন্ম তারিখ ১ মে, সত্যজিতের ঠিক আগের দিন।
তবে এই প্রথম নয়। আন্তর্জাতিক পর্দায় আগেও প্রদর্শিত হয়েছে ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’। প্যারিস বা নিউ ইয়র্কের ভি়ড়ে ঠাসা প্রেক্ষাগৃহে দর্শক মুগ্ধ হয়েছেন ধূসর অরণ্যের মাঝখানে মানুষের টানাপড়েনে। বছর খানেক আগে সংবাদ মাধ্যমে শর্মিলা ঠাকুর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেছিলেন, “এই ছবি দেউলিয়া হয়ে যাওয়া শহুরে শ্রেণির বিষণ্ণতাকে চিহ্নিত করেছে। নাগরিক জীবন প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়, আমাদের নৈতিকতায় ঠুলি পরিয়ে দেয়— এই বিচ্ছিন্নতার ধারণাটি বোধ হয় আমাদের দেশের থেকেও পশ্চিমের দর্শক ভাল বুঝেছিলেন। প্যারিস এবং নিউ ইয়র্কে বহু মানুষ দেখেছেন। ওঁরা রবিদার কাজে মুগ্ধ ছিলেন। যতবার তাঁকে পর্দায় দেখা গিয়েছে, দর্শকেরা ফেটে পড়েছেন আনন্দে।”