Kacher Manush Dure Thuiya Review

মাপা সংলাপে, উচ্ছল প্রেমের সংযত ছবি, ‘কাছের মানুষ দূরে থুইয়া’ দেখল আনন্দবাজার অনলাইন

বদলে যাওয়া সমাজব্যবস্থা, অর্থনীতির দুনিয়ায় সেই জন্যই খুব প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে ‘কাছের মানুষ দূরে থুইয়া’ ছবিটি। এখন দূরের হাতছানি কাছের। আর কাছের ঘনত্বই অনেক দূরের।

Advertisement

সংযুক্তা বসু

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৭ এপ্রিল ২০২৪ ১৪:৫০
Share:

‘কাছের মানুষ দূরে থুইয়া’ ছবির একটি দৃশ্যে প্রীতম হাসান এবং তাসনিয়া ফারিণ। ছবি: সংগৃহীত।

বৃন্দাবনে রাই-কানুর প্রেম শেষ হয়ে গেল একদিন। মথুরায় গিয়ে প্রেমিক কৃষ্ণ বাঁশি ছেড়ে অসি ধরলেন। বিরহিনী রাধা একাকিনী পড়ে রইলেন কুঞ্জবনে। দেখা না হলেও দুই দেশে থাকা দুই প্রেমিক-প্রেমিকার প্রেম অমর হয়ে রইল যুগে-যুগান্তরে।

Advertisement

লোকায়ত কাহিনির প্রেম দূরত্বে থাকলেও অমর হতে পারে। কিন্তু বাস্তবের মানব-মানবীর প্রেম কি দূরত্বে বসবাস করলে একই রকম গভীর থাকে? স্থায়ী হয়? দীর্ঘ অদর্শনে কি তৈরি হয় না সংশয়, সন্দেহ, কিংবা আরও অনেক জটিলতা? এই সব দুরূহ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতেই বাংলাদেশের পরিচালক শিহাব শাহীন বানিয়ে ফেলেছেন ওয়েব ছবি ‘কাছের মানুষ দূরে থুইয়া’।

রাজশাহীর ছেলে ফারহান (প্রীতম হাসান) কম্পিউটার সায়েন্সের ছাত্র হিসেবে সফল হলেও তার জীবন শিকড়হীন। কারণ, সে অনাথ। অতীত অন্ধকার। আপন বলতে কেউ নেই। সেই অন্ধকার পথে চলতে চলতেই তার সঙ্গে দেখা হয়ে যায় নায়িকা শারমিনের (তাসনিয়া ফারিণ)। শারমিন পেশায় উঠতি ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট ব্যবসায়ী। বেশ মজাদার ভাবে এই ‘বয় মিট্‌স গার্ল’ পর্বটিকে সাজিয়েছেন পরিচালক। যোগ হয়েছে সূক্ষ্ম হাস্যরস, রসিকতা। ছোট ছোট সংলাপ, নীরবতা, চোখে চোখে কথা আর মুখে কিছু না বলা। এই ভাবেই ওরা একে অপরের কাছে এসে পড়ে। ওদের নতুন নতুন রোম্যান্সের প্রেক্ষাপটে আসে পদ্মা নদী, আসে দিগন্তবিস্তৃত সবুজ মাঠ। নদীর পারে একলা গাছের পাশে একটি রোম্যান্টিক বেঞ্চ। প্রায় স্বর্গীয় সিনেমাটোগ্রাফি।

Advertisement

ছবির একটি দৃশ্যে প্রীতম হাসান ও তাসনিয়া ফারিণ। ছবি: সংগৃহীত।

কিন্তু কাহিনির মোড় ঘুরে যায়, যখন ফারহানের মতো চালচুলোহীন পাত্রকে শারমিনের জীবনসঙ্গী হিসেবে মেনে নিতে পারে না তার অভিভাবকেরা। নিজেকে প্রমাণ করতে ফারহান পাড়ি দেয় সিডনিতে। উচ্চশিক্ষার জন্য।

শুরু হয় ফারহান-শারমিনের ‘লং ডিস্ট্যান্স রিলেশনশিপ’। আজকের দিনে নতুন কিছু নয় দূরত্বের সম্পর্ক। উচ্চশিক্ষা বা উঁচু দরের জীবিকার তাগিদে বহু স্বামী-স্ত্রী, প্রেমিক-প্রেমিকাকেই দুই আলাদা শহরে বা দুই আলাদা দেশে বাধ্য হয়ে থাকতে হয়। সম্পর্কের সম্বল হয় শুধু মাঝেমাঝে ফোন বা ল্যাপটপের জানলায় দেখা হওয়া। এই দূরত্বের জন্য কখনও বা সম্পর্কে ভুল বোঝাবুঝি এসেও পড়ে। বদলে যাওয়া সমাজব্যবস্থা, অর্থনীতির দুনিয়ায় সেই জন্যই খুব প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে ‘কাছের মানুষ দূরে থুইয়া’ ছবিটি। এখন দূরের হাতছানি কাছের। আর কাছের ঘনত্বই অনেক দূরের।

বাংলাদেশ এবং সিডনির মনোরম লোকেশনে শুটিং গল্পকে উচ্চমাত্রা দিয়েছে। লোকেশনগুলি যেন চরিত্রগুলির মানসিক অবস্থার পরিপূরক। দেশ-বিদেশ মিলিয়ে ভরপুর প্রেমকাহিনি হলেও ঝাঁ-চকচকে বিনোদন বাড়াতে গ্ল্যামারের বাহুল্য নেই। নেই রংচঙে পোশাকের, ঝলমলে সেটের অতিরঞ্জন। সংলাপের আবেগও পরিমিত। এবং রোজকার জীবনের মতো মাটির কাছাকাছি বাস্তব সংলাপ। সংলাপ রচনার বোধ জীবনধর্মী, অকৃত্রিম। এই সহজ সারল্যই ছবির সবচেয়ে বড় আকর্ষণ।

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

নায়ক ফারহানের অভিনয়ের স্তিমিত মাধুর্য মনের ভিতর-ঘরে নাড়া দেয় মৃদু আলোর দীপ্তির মতো। শারমিনের স্বভাবচঞ্চল চরিত্রের পাশাপাশি, কখনও স্থির, কখনও অস্থির, কখনও অভিমানী অভিনয় মুগ্ধ করতে বাধ্য। ‘দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে’ বা ‘হম দিল দে চুকে সনম’ বা ‘কুছ কুছ হোতা হ্যায়’-এর মতো আড়ম্বর আশা করবেন না। কিন্তু যে আনন্দ পাবেন, তার আবেদন ছড়িয়ে পড়বে মনের আনাচকানাচে!

এই ছবির দ্বিতীয় নায়িকা চরিত্রে এই প্রথম পর্দায় এলেন রুপন্তী আকিদ। প্রথম সিনেমায় অভিনয়ের হিসেবে সত্যি চমৎকার তাঁর উপস্থাপনা। এক প্রাণচঞ্চল মেয়ের চরিত্রে খুব ভাল মানিয়েছে তাঁকে। অভিনয়ের মধ্যে মধ্যে বাবার প্রতি ঔদ্ধত্য বেশ যোগ্য ভাবে ফুটিয়েছেন রুপন্তী। বড় ভাল লাগে রুপন্তীর (গল্পে মিলি) অসহায় অথচ ব্যক্তিত্বময় বাবার চরিত্রে শাহীন শেহনওয়াজের ভূমিকা। নায়িকা শারমিন (তাসনিয়া ফারিণ)-এর দাদার স্বল্পদৈর্ঘ্য চরিত্রে স্মরণীয় সমাপ্তি মাশুকের দুই-এক আঁচড়ের পারফরম্যান্সও ভাল। সিডনিতে নায়ক ফারহানের রুমমেট রানাভাইয়ের চরিত্রটি যে হেতু ‘লং ডিস্ট্যান্স রিলেশনশিপ’ নিয়ে অত্যাধুনিক এক জীবনদর্শনের কথা বলে, তাই এই চরিত্রের তুখোড় অভিনেতা শুভজিৎ ভৌমিকের কথা এক বার না উল্লেখ করলেই নয়।

ইমন চৌধুরীর সঙ্গীত পরিচালনা ক্ষণে ক্ষণে ছবিকে সুরমুখর করেছে। সুরের মধ্যে দিয়ে প্রতিটি মুহূর্তকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে চলেছে লিরিকধর্মী ফ্রেমের পর ফ্রেম। ‘মেঘের মেয়ে মেঘবালিকা/ আমার থাকিস তুই’ এবং ‘কাছের মানুষ দূরে থুইয়া’ গান দু’টি ছবি শেষ হওয়ার পরেও মনে মনে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। এমনই সে গানের কথা ও সুরের রেশ।

‘কাছের মানুষ দূরে থুইয়া’-কে একবাক্যে বলা যায় প্রায় ত্রুটিহীন একটি সিনেমা। কখনও বা একটু দীর্ঘ মনে হতে পারে। কিন্তু এই দৈর্ঘ্য ছবির শেষ অবধি যাওয়ার জন্য অমোঘ ছিল। অনিবার্য ছিল। ছবির শেষ বলতে নেই। তবু লোভ সামলানো যায় না…। এতটাই মন ভরিয়ে দেওয়া নায়ক-নায়িকার আবেগময় সংলাপ। প্রেমের শাশ্বত দৃশ্য দেখার জন্য উসখুস না করে যত্ন নিয়ে অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। দীর্ঘ দূরত্বের ভালবাসার আকুতিটা তা না হলে যে দেখাই হবে না! নিঃসন্দেহে বলা যায়, এ এক পরিপূর্ণ কবিতার মতো ছবি। ‘কাছের মানুষ দূরে থুইয়া’ দেখা যাচ্ছে চরকি প্ল্যাটফর্মে ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন