review

Jhora Palok Review: রক্তাপ্লুত ট্রাম থেমে গেল, ‘ঝরা পালক’-এ কতখানি জীবনানন্দ হয়ে উঠলেন ব্রাত্য?

কেমন হল সায়ন্তন মুখোপাধ্যায়ের ছবি ‘ঝরা পালক’? কবি জীবনানন্দ দাশ ও তাঁর স্ত্রীর ভূমিকায় কতটা মানিয়ে গেলেন ব্রাত্য বসু এবং জয়া আহসান?

Advertisement

বিভাস রায়চৌধুরী

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৬ জুন ২০২২ ১১:৩৯
Share:

মুক্তি পেল ‘ঝরা পালক’

‘ঝরা পালক’ অদ্ভুত এক ছবি। মনকে প্রশ্নমুখর করে। আচ্ছন্ন‌ও করে। বলা হচ্ছে, ছবিটি জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে। কিন্তু দেখতে বসে মনে হয়েছে, ছবিটি সমাজকে নিয়ে। জীবনানন্দের সমকালীন কলকাতার কবি-সম্পাদক সমাজকে নিয়ে। এক‌ই সঙ্গে ছবিটি সেই সমাজকে নিয়ে‌ও, নগরের মধ্যবিত্ত সংসার যে সমাজের অধীন; যে সমাজ অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের মতোই যশ চায়, প্রতিপত্তি চায়; মৃদু আদর্শ পালনের মহত্ত্ব চায়। বরিশালের জীবনানন্দ কলকাতায় বেমানান ছিলেন। যখন কলকাতায় থেকেছেন, নিজের ‘মুদ্রাদোষে’ কেবল‌ই একা হয়ে গিয়েছেন একটি মরিয়া, উচ্চাকাঙ্ক্ষী সমাজে।

Advertisement

এই জীবনানন্দকে নিয়ে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে চেয়েছেন সায়ন্তন মুখোপাধ্যায়। জীবনানন্দ দাশের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ঝরা পালক’-এর নামে ছবির নাম। বাংলায় এই প্রথম জীবনানন্দ বিষয়ে কোন‌ও ছবি হল। তবে ছবির অন্য নাম হতে পারত। ‘ঝরা পালক’ কাব্যগ্রন্থে জীবনানন্দ তাঁর নিজস্ব ভাষা ও চেতনা নিয়ে আসেননি।

‘ঝরা পালক’ ছবির কাহিনি সরল পথে চলেনি। কাহিনির কূটাভাস আছে। শুধু কমলা রঙের রোদ নয়, আর‌ও নানা আলো আছে। কবি জীবনানন্দকে নিয়ে নতুন প্রজন্মের ছবি বানানোর আবছা উপকাহিনির পাশে তরুণ জীবনানন্দের কবি হ‌ওয়ার স্বপ্ন এবং নিন্দিত-উৎপীড়িত মধ্যবয়সি জীবনানন্দের বিষাদ ঢেউয়ের মতো এসেছে-গিয়েছে। ছবিতে যেন কোন‌ও অভিনয় নেই। শুধু ‘হয়ে ওঠা’ আছে। তরুণ জীবনানন্দের ভূমিকায় রাহুল চলনসই। কিন্তু অন্তর থেকে নিঃশব্দে ‘হয়ে ওঠা’ কাকে বলে, এই ছবিতে জীবনানন্দের ভূমিকায় তা দেখিয়ে দিয়েছেন ব্রাত্য বসু। সম্পাদক, সমালোচকদের কাছে বারবার বিদ্রূপ শুনে ব্রাত্য যে শান্ত, বেদনাময়, দূর-বিলীন দৃষ্টি তুলে এনেছেন চোখে, তা এক কবিতাসাধকের। যিনি উপহাসকে আক্রমণ করেন না, নিজেকে যুগোপযোগী জনপ্রিয় করে তুলতে সচেষ্ট হন না। কারণ সত্যকে অনুভব করাই তাঁর বিষয়।

Advertisement

বহুনিন্দিত ‘ক্যাম্পে’ কবিতা নিয়ে উপহাস এই ছবিতে আছে। ভাবতে অবাক লাগে, বিরাট মাপের মানুষেরা সে দিন বোঝেননি শিকারীর নিয়তি নিয়ে এই সব পংক্তি— ‘যাহাদের দোনলার মুখে আজ হরিণেরা মরে যায়/ হরিণের মাংস হাড় স্বাদ তৃপ্তি নিয়ে এল যাহাদের ডিশে/ তাহারাও তোমার মতন,—/ ক্যাম্পের বিছানায় শুয়ে থেকে শুকাতেছে তাদের‌ও হৃদয়/ কথা ভেবে— কথা ভেবে— ভেবে।/ …বসন্তের জ্যোৎস্নায় অই মৃত মৃগদের মতো/ আমরা সবাই।’ এলিট সাহিত্য-ব্যক্তিত্বরা এই কবিতা সে দিন বোঝেননি? এই কবিতা নিয়ে তাঁরা যা-যা বলেছেন, সেটাই তো আজ উপহাসের বিষয়। তাই কি মৃদুভাষী মানুষটি সময়ে-সময়ে সারা গা কাঁপিয়ে হাসতেন? এই ছবিতে এক বার সেই মোক্ষম হাসি হেসেছেন ব্রাত্য। সেই হাসিতে উড়ে গিয়েছে কলকাতার ঘাতক ট্রাম, মহাজনদের উজ্জ্বল পাণ্ডুলিপি, নাক-উঁচু ক্ষমতার জোর।

আর এক জন এই ছবি জুড়ে আছেন। তিনি জয়া আহসান। বহুস্তরীয় এই ছবিতে পরিচালক জয়াকে নানা রূপে ব্যবহার করেছেন। প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি উত্তীর্ণ। কখন‌ও সম্মোহক নারী। কখনও সংসার-জ্ঞানহীন কবির আটপৌরে স্ত্রী। নারীত্বের শতজল ঝর্নার ধ্বনি হয়ে বয়ে গিয়েছেন জয়া এই ছবিতে, অভিনয় করেননি।

এই ছবিতে অভিনয় করেছেন শুধু সজনীকান্ত দাস, প্রেমেন্দ্র মিত্র, বুদ্ধদেব বসু, সুধীন্দ্রনাথ দত্তরা। দেবশঙ্কর হালদার, কৌশিক সেন, বিপ্লব বন্দ্যোপাধ্যায়রা পরিচালকের ইচ্ছে অনুযায়ী গমগম করেছেন। সেই প্রবল কবিশিকারের আস্ফালনের বিপরীতে গড়ে উঠেছে চেতন-অবচেতনের খেলায় বিপর্যস্ত এক কবি ও কলকাতা। এবং অমোঘ ট্রাম! আর এক কবি বিনয় মজুমদারের অনুসরণে বলা যায়, থেমে যাওয়া ‘রক্তাপ্লুত ট্রাম’।

হ্যাঁ, ‘ঝরা পালক’ ছবিতে কলকাতার জীবনানন্দ‌ই আছেন। ‘মাল্যবান’-এর জীবনানন্দ আছেন। ‘রূপসী বাংলা’-র জীবনানন্দ এখানে অনুপস্থিত। বরিশালের জীবনানন্দ এখানে অনুপস্থিত।

কলকাতা ও জীবনানন্দ অবলম্বনে ‘ঝরা পালক’-এর ক্যানভাসে গড়ে উঠেছে সময়ের কোলাজ। সমস্ত সংলাপ শেষ হলে এক স্তব্ধতা। শিল্প কী? কবিতা মানুষের ঠিক কোন জায়গাটিতে? স্তব্ধতাই বলে— ‘যেখানে মনীষী তার মোম নিয়ে বসে আছে রাত্রির ভেতরে…’। সেই স্তব্ধতার কথাই বলেছেন সায়ন্তন, স্তব্ধতাকেই বুনেছেন ব্রাত্য, জয়া ও অন্যান্য কুশীলব।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন