Article 370 Review

প্রশ্ন ‘ভগবানের হাত’ নিয়ে

১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপে সেই ম্যাচের পর থেকে আজ পর্যন্ত একটা প্রশ্নই সেই গোলটিকে জনপ্রিয় করে রেখেছে— বল কি মারাদোনার হাতে লেগেছিল?

Advertisement

দেবাশিস চৌধুরী

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ০৮:৩৮
Share:

‘আর্টিকল ৩৭০’ ছবির একটি দৃশ্যে ইয়ামি গৌতম। ছবি : সংগৃহীত।

পায়ে পায়ে বল এগিয়ে যাচ্ছে ইংল্যান্ডের গোলের দিকে। মারাদোনাও দ্রুত ছুটে আসছেন বিপক্ষের পেনাল্টি বক্সে। তার পরে এল সেই হাওয়ায় ভাসানো ‘ভুল ক্লিয়ারেন্স’। সুযোগসন্ধানী আর্জেন্টিনীয় স্ট্রাইকার লাফালেন। লাফালেন ইংল্যান্ডের গোলরক্ষকও। বল কিন্তু জড়িয়ে গেল ব্রিটিশদের জালে।

Advertisement

১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপে সেই ম্যাচের পর থেকে আজ পর্যন্ত একটা প্রশ্নই সেই গোলটিকে জনপ্রিয় করে রেখেছে— বল কি মারাদোনার হাতে লেগেছিল? পরে মহাতারকা বলেছিলেন, এই গোলের পিছনে রয়েছে ‘ভগবানের হাত’। নিজেকেই কি তিনি ঈশ্বর বলতে চেয়েছিলেন?

‘আর্টিকল ৩৭০’ ছবিটি দেখতে দেখতে সেই গোলটির কথা মনে পড়ছিল। এত নিখুঁত ভাবে ছবিতে সরকারের গতি দেখানো হয়েছে, মনে হয় যেন মারাদোনাই সতীর্থদের সঙ্গে পাসের পর পাস খেলে বিপক্ষের গোলের দিকে এগিয়ে চলেছেন। কারা বিপক্ষ? জম্মু ও কাশ্মীরের তৎকালীন রাজনৈতিক দল, যাদের কায়েমি স্বার্থের কথা ছবির দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে ফুটে উঠেছে? নাকি পাকিস্তান, যারা কাশ্মীর নিয়ে গত ৭৫ বছরে একাধিক যুদ্ধ চালিয়েছে? নাকি, জওহরলাল নেহরু এবং তাঁর দল কংগ্রেস? রাখঢাক না করেই যাঁদের কাঠগড়ায় তুলে দিয়েছে এই ছবির চিত্রনাট্য।

Advertisement

আসল মজা ওই চিত্রনাট্যেই। আদিত্য ধরের প্রযোজনা এবং আদিত্য সুহাস জাম্বালের পরিচালনায় তৈরি ‘আর্টিকল ৩৭০’ ছবিটি প্রথমেই নম্বর পাবে তার চিত্রনাট্যের জন্য। দুই আদিত্যের সঙ্গে মিলে চিত্রনাট্য লিখেছেন অর্জুন ধওয়ন। ২ ঘণ্টা ৪০ মিনিটের ছবিটিকে পাঁচটি ‘চ্যাপ্টারে’ ভাগ করেছেন চিত্রনাট্যকারেরা। তাতে গবেষণার ছাপ স্পষ্ট। সেই গবেষণার সবটুকুই যে বাস্তব, এমন নয়। যদিও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী কার্যত এই ছবিটি থেকেই ইতিহাস আহরণ করতে বলেছেন দর্শককে। তবু ‘কাশ্মীর ফাইলস’-এর মতো অতীতের কিছু ছবির অভিজ্ঞতা থেকে ‘আর্টিকল ৩৭০’-এর শুরুতেই প্রযোজক-পরিচালক জানিয়ে দেন, ছবিটিতে গল্পগাথা রয়েছে। মানে, ছবিটি ইতিহাসের তথ্য দিচ্ছে, এমন নয়। এখানেও ব্যতিক্রমী ভাবে বেশ কিছু সময় ধরে এই বিধিসম্মত সতর্কীকরণটি দেখানো হয়েছে।

এর পরে কাহিনি। তার মধ্যে অভিনয়, সিনেম্যাটোগ্রাফি, চরিত্রায়ণ এবং কিছু গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তের দৃশ্যায়ন রয়েছে। আছে কিছু বাস্তব দৃশ্যের ব্যবহারও। শুরুতে অজয় দেবগণের কণ্ঠে দ্রুত একটি ইতিহাস পড়ে যাওয়া হয়েছে। সম্প্রতি ‘প্রোপাগান্ডা মুভি’ বা ‘প্রচারসর্বস্ব সিনেমা’ বলে পরিচিত ছবিগুলিতে এমন ভাবে এক ঝটকায় ইতিহাস পড়ে দেওয়ার ‘প্রথা’ বেশ পরিচিত। ইতিহাসের বহুল প্রচলিত যুক্তি, পাল্টা যুক্তির উপস্থাপনা এখানে থাকে না। নিজের যা বিশ্বাস বা যা প্রচার করা উদ্দেশ্য, তাকে ঘটে যাওয়া ঘটনার ব্যাখ্যায় জানিয়ে দেওয়া হয়। ‘আর্টিকল ৩৭০’-ও আলাদা নয়।

কিন্তু বুনটের দিক থেকে ছবিটি ব্যতিক্রমী। সাড়ে চার বছরের ঘটনাক্রম এখানে দেখানো হয়েছে। সেই কাহিনি যথেষ্ট টানটান। অভিনয়? মূল চরিত্র জ়ুনি হকসরের ভূমিকায় ইয়ামি গৌতম, কেন্দ্রীয় সরকারের অন্যতম সচিব রাজেশ্বরী স্বামীনাথনের ভূমিকায় প্রিয়ামণি, যশ চৌহানের ভূমিকায় বৈভব তত্ত্ববাদী বা সাংবাদিক বৃন্দার ভূমিকায় ইরাবতী হর্ষেরা জমিয়ে দিয়েছেন ছবিটিকে। ইয়ামি গৌতম সম্ভবত জীবনের সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং চরিত্রে অভিনয় করেছেন তাঁর স্বামী আদিত্য ধরের প্রযোজনায়, এবং পুরো নম্বর পেয়েই উতরেছেন।
তবে আসল চমক রাজনৈতিক নেতাদের চরিত্রচিত্রণে। এখানেও আদিত্যরা প্রশংসা পাবেন। প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকায় অরুণ গোবিল, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ভূমিকায় কিরণ কর্মকারের বাছাই ও প্রস্থেটিক্স চমৎকার। দিব্যা শেঠ শাহকে দেখে মেহবুবা মুফতির কথা মনে পড়তে বাধ্য। অরুণ গোবিল বিখ্যাত হয়েছিলেন টেলিভিশন ধারাবাহিকে রাম সেজে। এখানে তাঁকে নরেন্দ্র মোদীর চেহারায় হাজির হতে দেখে কোথাও যেন অবচেতনে একটি সরলরেখা তৈরি হয়ে যায়।

সব ভাল যার... নাহ্, একটা হোঁচট যেন রয়ে যাচ্ছে ছবিটিতে। ৩৭০ ধারা সংবিধান থেকে খুঁড়ে বার করে শিকড় সমেত খারিজ করে দেওয়ার যে প্রক্রিয়া, তার নেপথ্যের গল্পই এই ছবির উপজীব্য। সে সব ঘটনা যেন বড় সরলরেখায় এগোয়। আর সেই পথে আগের সব তত্ত্বকে কত সহজে খারিজ করে দেয় চিত্রনাট্য!

দ্বিতীয় হোঁচট, সত্যের অন্য দিকটি এড়িয়ে যাওয়া। এই ছবিতে কোথাও বলা নেই, এখন লাদাখে জনগণের ক্ষোভে ফেটে পড়ার কথা। পুলওয়ামার ঘটনা দেখানো হলেও নেই তার সঙ্গে যুক্ত হাজারো কঠিন প্রশ্নের কথা, যার জবাব এখনও এড়িয়ে চলেছে সরকার। ছবিতে শুধুই সরকারের সাফল্যের আখ্যান। অনেকটা হলিউডের ‘প্রোপাগান্ডা মুভি’র মতো, যেখানে লাদেনকেও এক সময়ে বিপ্লবী দেখানো হয়েছিল!

তবু, ‘আর্টিকল ৩৭০’ নয় ‘কাশ্মীর ফাইলস’। এখানে সে রাজ্যের আম-মুসলমানকে অত্যাচারিত হিসাবে তুলে ধরা হয়েছে, খলনায়ক করা হয়েছে পাকিস্তানকে। তাই শেষ দৃশ্যে মেঘমুক্ত ডাল হ্রদের ক্লোজ় থেকে লং শট আনন্দ দেয়।

প্রশ্ন একটাই। এত সহজে সবাইকে খারিজ করে দেওয়ার পিছনে কোনও ‘ভগবানের হাত’ নেই তো?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন