Web Series

মনস্তাত্ত্বিক থ্রিলারের টান তৈরি হল না, 'মোহমায়া' ধরে রাখলেন স্বস্তিকাই

শক্তিশালী কাস্টিং সত্ত্বেও মনস্তাত্বিক থ্রিলার হিসাবে এই সিরিজ কতটা সফল, কতটাই বা প্রত্যাশা পূরণ করতে পারল, সে বিষয়ে বেশ সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে।

Advertisement

ইন্দ্রদত্তা বসু

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৬ মার্চ ২০২১ ১৭:০৭
Share:

'মোহমায়া' ওয়েব সিরিজের দৃশ্যে নবাগত বিপুল পাত্র এবং স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়।

কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায় ও অনন্যা চট্টোপাধ্যায় জুটি দীর্ঘ ১২ বছর পরে আবার একসঙ্গে এলেন যে সিরিজের সুবাদে, সেই সিরিজ থেকে যে প্রত্যাশার মাত্রা যথেষ্ট বেশিই থাকবে, এ তো বলাই বাহুল্য। কমলেশ্বর পরিচালিত হইচইয়ের নতুন সিরিজ 'মোহমায়া'য় অনন্যার পাশাপাশি আছেন আরেক তাবড় অভিনেত্রী স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়ও। এমন শক্তিশালী কাস্টিং সত্ত্বেও মনস্তাত্বিক থ্রিলার হিসাবে এই সিরিজ কতটা সফল, কতটাই বা প্রত্যাশা পূরণ করতে পারল, সে বিষয়ে বেশ সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে।

৫টি এপিসোডের এই সিরিজ মূলত এক বনেদি পরিবারের গল্প। ছোট ছেলে মিকি, মেয়ে মিঠি আর স্বামীকে (সুজন মুখোপাধ্যায়) নিয়ে অরুণার (স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়) ছোট্ট ছিমছাম সংসার। বড় ছেলে নিমো চাকরি সূত্রে বহুদিন বেঙ্গালুরু। এখন মিকিও কানাডা যাওয়ায় সেই শূন্যস্থান পূরণ করতে পেয়িং গেস্ট হিসেবে মিকির স্কুলের বন্ধু ঋষি (বিপুল পাত্র) থাকতে আসার পর থেকেই বিভিন্ন অস্বাভাবিকতা দেখা দেয়। অন্য দিকে প্রবাসে চলে যাওয়া ২ ছেলের শূন্যস্থানে অরুণার মাতৃত্বের প্রবল সংকট ও নিরাপত্তাহীনতায় স্বস্তির প্রলেপ দেয় ঋষির উপস্থিতি। ফলত, বাড়িতে এই নতুন ব্যক্তির আগমনের পরে ঘটমান অস্বাভাবিকতার কিছুই চোখে পড়ে না পুত্রসম ঋষির স্নেহে অন্ধ অরুণার। একই সঙ্গে মাতৃহারা ঋষিও তার মা মায়ার (অনন্যা চট্টোপাধ্যায়) স্থানে বসায় অরুণাকে। এই পরিপূরক সম্পর্ক স্থাপনের সমান্তরালে চলতে থাকে মায়ের অতৃপ্ত আত্মার সঙ্গে ঋষির কথোপকথন, যা মূলত কাজ করছে এক ভৌতিক উপাদান হিসাবে।

প্রথম থেকেই 'মোহমায়া'য় এক ভৌতিক আবহ ও রহস্য সৃষ্টির চেষ্টা রয়েছে, কিন্তু এই রহস্য ভীষণ রকম আরোপিত মনে হয়। চিত্রনাট্যে এত ফাঁক থেকে গেছে যে সাইকোলজিকাল থ্রিলার হিসেবে ন্যূনতম সাসপেন্সটুকুও দানা বাঁধেনি, ফলে গল্প এগতে গিয়ে বার বার হোঁচট খেয়েছে। সেই ফাঁক পূরণ করার চেষ্টা করা হয়েছে অতিনাটকীয় অভিনয়ে, চড়া মাত্রায় এডিটিংয়ে এবং কখনো ভৌতিক আবহসঙ্গীত সৃষ্টির মাধ্যমে। কিন্তু স্বাভাবিক ভাবেই, চিত্রনাট্যের যে মূলগত ফাঁক তা ঢাকা পড়েনি জোড়াতালিতে, বর‌ং তা আরও প্রকট হয়েছে। মনস্তাত্বিক দিকটাও মূলত উঠে এসেছে ক্যামেরার কিছু অস্বাভাবিক অ্যাঙ্গেল ও ফিশ আই এফেক্টের মাধ্যমে। কিন্তু অতিরিক্ত মাত্রায় ফ্ল্যাশব্যাক বার বার ছেদ করে গল্পের ধারা, এবং তা দর্শককে ক্লান্ত করতে বাধ্য।


Advertisement

এমন অনেক ফাঁকফোকর অবশ্য ঢেকে দিয়েছেন স্বাস্তিকা মুখোপাধ্যায়। দীর্ঘদিন ধরে সংসার সামলাতে সামলাতে ক্লান্ত ও খিটখিটে হয়ে যাওয়া এক মধ্যবয়সি গৃহবধূ অরুণার চরিত্রে তিনি স্বভাবসিদ্ধ ঢঙেই অনবদ্য। মাতৃসত্তার উদ্বেগের টানাপড়েন এমন নিখুঁত ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি যে তাঁর ডাকসাইটে অভিনয়ের পাশে ম্লান লাগে ঋষির ভূমিকায় নবাগত বিপুল পাত্রকে। বাবার মতো হয়ে ওঠার এক অস্বাভাবিক ভয় ঋষিকে এমন ভাবে গ্রাস করে যে নিজের মধ্যে বা মিকির বাবার মধ্যেও সে তার বাবার পৈশাচিক উল্লাসের প্রতিচ্ছবি দেখতে পায়। এক দিকে এই ভয়ের প্রভাব এবং অন্য দিকে মৃত মায়ের উপস্থিতিতে ঋষি বেশ জটিল এক চরিত্র। বিপুলের অনভিজ্ঞতার ফলে এমন এক বহুস্তরীয় চরিত্রের অভিনয় ভীষণ একমাত্রিক। সুজন মুখোপাধ্যায় অরুণার স্বামীর চরিত্রে যথাযথ। দুঃখের বিষয় এতদিন পরে পর্দায় ফিরলেও অনন্যা চট্টোপাধ্যায়ের মতো প্রতিভা প্রকাশের সঠিক জায়গা পেল না এই দুর্বল চিত্রনাট্যে।

কিছু কিছু দৃশ্য আলাদা করে চোখে পড়ার মতো অতিনাটকীয় করা হয়েছে এবং অপ্রয়োজনীয় ভাবে বার বার ফ্ল্যাশব্যাকে দেখানো হয়েছে। তেমন একটি দৃশ্য হল, মিঠির সিঁড়ি থেকে পড়ে যাওয়ার দৃশ্য। এ ছাড়া মায়ার স্বামীর ছেড়ে যাওয়ার দৃশ্যও অতিমাত্রায় নাটকীয় করা হয়েছে। বাতি নিভে যাওয়া, আলতা পরা পায়ের সাথে রুমঝুম শব্দ ইত্যাদি প্রচলিত ট্রোপের মাধ্যমে একটা ভৌতিক গা ছমছমে পরিবেশ তৈরির চেষ্টা করা হলেও তা ব্যর্থ। এ সবের মধ্যে মা-ছেলের মধ্যে এক অদ্ভুত যৌন সুড়সুড়ি দিয়ে এক ইডিপাল পরিসর তৈরি করার চেষ্টা, যা আরও প্রকট হয় অরুণা-ঋষির সম্পর্কে, সিরিজের উপাদানগুলিকে আরো বিক্ষিপ্ত করে দেয়। মাইনর অ্যারেঞ্জমেন্টে সিরিজের ভৌতিক আবহসঙ্গীতের সঙ্গে 'তোমায় নতুন করে পাব বলে' গানটি খাপ খাওয়াতে গিয়ে গানের মাধুর্য নষ্ট হয়েছে, তবে অমিত-ঈশানের সঙ্গীত পরিচালনাতেই বেহালা ও তানপুরা সহযোগে 'যা হারিয়ে যায়' গানের ব্যবহার বেশ স্বস্তি দেয়, আরাম দেয় কানে। রং ও আলোর ব্যবহারও বেশ উল্লেখযোগ্য এই সিরিজে।


অরুণা এবং মায়া, এই ২ গৃহবধূর বন্দিদশা বহু বার সমান্তরালে চলতে চলতে মিলে যায় একে অপরের সঙ্গে, প্রতীকী হয়ে ওঠে সাংসারিক নারীর চিরন্তন হাত পা বাঁধা অবস্থা। এই ২ নারীর চরিত্র অবশ্যই পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে এক মোক্ষম প্রতিরোধ, এবং এই কারণে সিরিজটি অবশ্যই তাৎপর্যপূর্ণ। তবে থ্রিলার হিসাবে এর সাফল্য নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। মৃত বিড়াল হাতে মায়ার গান গাওয়ার দৃশ্য বা ঋষির অদ্ভুত চাহনি মাঝে মাঝেই গা ছমছমে পরিবেশ তৈরি করলেও তার প্রভাব সাময়িক। দুর্বল চিত্রনাট্য ও সংলাপ, এবং অতিনাটকীয়তা মোহমায়াকে একটা টানটান থ্রিলার হতে দিল না শেষ পর্যন্ত, অন্তত প্রথম সিজনে। শেষ এপিসোডে আগামী সিজন থেকে বেশ কিছু দৃশ্য রাখা হয়েছে, যা মুক্তি পাবে জুনে। তাই 'মোহমায়া' সামগ্রিক সিরিজ হিসেবে কতটা সফল, তা জানতে আপাতত জুনের অপেক্ষা।

Advertisement

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন