বেহাল পরিকাঠামো, ভুগছে রূপকলা কেন্দ্র

Advertisement

মধুরিমা দত্ত

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৬ মার্চ ২০১৬ ০০:০৯
Share:

হাতে কলমে কাজ শিখতে প্রয়োজন আধুনিক কম্পিউটার। তা নেই। কম্পিউটারে নির্বিঘ্নে কাজের জন্য প্রয়োজন অত্যাধুনিক সফ্‌টওয়্যার, প্রোজেক্টর। তা-ও নেই। কম্পিউটার ঠিক রাখতে প্রয়োজন অ্যান্টিভাইরাস প্রযুক্তি। সে সবও নেই। এমনকী, নেই গ্রন্থাগারিকও। এই নেই রাজ্যটি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্য সংস্কৃতি মন্ত্রকের আওতায় থাকা রূপকলা কেন্দ্র।

Advertisement

অন্য দিকে, কেন্দ্রীয় সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রকের আওতায় থাকা সত্যজিত্ রায় ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউট (এসআরএফটিআই)। সেখানে ‘রয়েছে’-এর তালিকায়— নিয়মিত কর্মশালা, সম্পাদনার জন্য উন্নত মানের সফ্‌টওয়্যার, আলো ও শব্দক্ষেপণের অত্যাধুনিক মানের যন্ত্র, বিশ্বমানের ক্যামেরা বহাল। এবং এই সব ব্যবহারের জন্য পড়ুয়াদের রয়েছে অবাধ ছাড়পত্র।

দু’টি ঘটনা এ রাজ্যেরই দুই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের।

Advertisement

যদিও রূপকলা কেন্দ্রের ওয়েবসাইটে চোখ রাখলে মেলে হরেক প্রতিশ্রুতি। অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে মুড়ে থাকার উল্লেখ ওয়েবসাইটে থাকলেও পড়ুয়াদের অভিযোগ প্রযুক্তির অভাবে পঠনপাঠনই কার্যত শিকেয় উঠেছে। বিশেষ করে অ্যানিমেশন বিভাগে হাতেকলমে শিখতে গিয়ে সমস্যায় পড়তে হয়। অন্য দিকে, দেশের বাইরে যে প্রযুক্তিতে কাজ শেখানো হয়, এসআরএফটিআই-এ মজুত তার প্রায় সব ক’টিই।

রূপকলা কেন্দ্রের এক ছাত্রী জানান, অ্যানিমেশন এমন বিষয় যাতে প্রতি দু’বছর অন্তরই নতুন নতুন সফ্‌টওয়্যারের মাধ্যমে কাজ শিখতে হয়। ‘‘সব সময়ে আধুনিকতম প্রযুক্তিতে কাজ শেখার কথা, যাতে বৃহত্তর প্রতিযোগিতার বাজারে এগিয়ে থাকতে পারি। কিন্তু আধুনিক তো দূরের কথা, প্রাথমিক চাহিদার যন্ত্রপাতিই নেই।’’ এসআরএফটিআই-এর এক পড়ুয়া বলেন, ‘‘এখানকার মতো উন্নত মানের ক্যামেরা ভারতের খুব কম ফিল্ম স্কুলেই রয়েছে। আমরা নিজে হাতে সে সব যন্ত্রপাতি ব্যবহারও করতে পারি।’’

কিন্তু রাজ্য সরকারের রূপকলা কেন্দ্রের এমন দশা কেন?

১৯৯৫ সালে ভারত এবং ইতালি সরকারের যৌথ উদ্যোগে তৈরি হয় রূপকলা কেন্দ্র। যার অ্যানিমেশন বিভাগের মূল লক্ষ্য ছিল গ্রামোন্নয়নের লক্ষ্যে বিভিন্ন অ্যানিমেটেড চলচ্চিত্র তৈরি করা। কিন্তু পরিকাঠামো এবং প্রযুক্তির অভাবে কার্যত বন্ধ্যা হয়ে পড়েছে কেন্দ্রটি। কেন্দ্রের প্রাক্তন অধিকর্তা সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘রূপকলা কেন্দ্র আসলে দিশাহীনতায় ভুগছে। কোন ধরণের প্রকল্প করলে ভাল হয়, কী ভাবে আরও সময়োপযোগী চলচ্চিত্র তৈরি করা যায় এ নিয়ে কোনও ভাবনাচিন্তাই নেই।’’

কিন্তু একই রাজ্যে দুই প্রতিষ্ঠানে এমন বৈপরীত্য কেন?

রাজ্যের আমলাতন্ত্রের প্রভাব যে রূপকলা কেন্দ্রের অন্দরেও গিয়ে পড়েছে এ নিয়ে এক মত কেন্দ্রের প্রাক্তন কর্তাদের অনেকেই। বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে যে ভাবে আমলাতন্ত্রের মুখাপেক্ষী হতে হয়, তাতে আখেরে ক্ষতি হয় কাজেরই— মনে করছেন শিক্ষকেরাও। অন্য দিকে কেন্দ্রের নিজস্ব নিয়ন্ত্রণে থাকার ফলে সেই সমস্যায় প্রত্যক্ষ ভাবে ভুগতে হয় না এসআরএফটিআই-এর পড়ুয়াদের।

অন্য একটি সমস্যার কথাও তুলে ধরেছেন এক কর্মকর্তা। ‘‘পুনের ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়ায় যে ভাবে ঋত্বিক ঘটক নিজে পড়াতেন রূপকলাতে তেমন দিশা দেখানোর মানুষ কই?’’— প্রশ্ন ওই কর্তার। এক শিক্ষকের প্রশ্ন, ফিল্ম তৈরি শেখার স্বপ্ন নিয়ে আসা পড়ুয়া কেন অপর্যাপ্ত পরিকাঠামোর এক প্রতিষ্ঠানে আসবে? পঠনপাঠনের খরচ রূপকলায় কম, কিন্তু শিক্ষার পরিবেশই যদি না থাকে তা হলে তো আখেরে পিছিয়েই পড়তে হবে এই পড়ুয়াদেরই।

এসআরএফটিআই-এর এক প্রাক্তনী হরিন্দর সিংহ জানান, প্রতিষ্ঠান কখনই প্রতিভা তৈরি করে না, কিন্তু প্রতিভাকে আকার দেওয়া বা ঠিক পথে চালিত করার দায়িত্ব প্রতিষ্ঠানেরই। ‘‘সেই দায়িত্ব এসআরএফটিআই নিপুণ ভাবেই পালন করে। প্রযুক্তিগত, পরিকাঠামোগত কোনও সমস্যাই সেই অর্থে নেই, গ্রন্থাগারও বিশ্বমানের।’’ রূপকলা কেন্দ্রের এক প্রাক্তনী প্রদীপ্ত ভট্টাচার্যের অবশ্য মনে করেন সমস্যা সব প্রতিষ্ঠানে অল্পবিস্তর থেকে থাকে। কিন্তু রূপকলা কেন্দ্র থেকে পড়ে ভাল কাজ করছেন এমন উদাহরণও নেহাত কম নয়। তিনি বলেন, ‘‘আমি রূপকলার প্রথম ব্যাচের পড়ুয়া। তখন যন্ত্রপাতি আরও কম ছিল। কিন্তু এখনও যদি সেই আমলের যন্ত্রপাতি দিয়েই কাজ চালানো হয় তা হলে সত্যিই মুশকিল।’’ তবে দিশাহীনতাই যে বর্তমানে রূপকলা কেন্দ্রের মূল সমস্যা সে নিয়ে একমত তিনিও।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন