মান্নাদা প্রথমে কয়েকটা স্পট জাম্প দিলেন। তার পর খানিকটা সময় হাল্কা জগিং করে নিলেন। না, এ ঘটনা মান্নাদার কিশোর বয়সে গোবর গোহের আখরায় নয়। স্থান মুম্বইয়ের রাজকমল স্টুডিও। তরুণ মজুমদারের ছবির গানের রেকর্ডিং। সুরকার হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। গাইছেন মান্না দে। মুম্বইয়ের সকাল। শরীরের জড়তা তখনও কাটেনি। শরীর গরম না হলে গলা গরম হবে কী করে? তাই গানের রিহার্সালের আগে এমন অনুশীলন। রেকর্ডিং স্টুডিওতে এমন দৃশ্য সম্ভবত কেউ কোনও দিন দেখেনি। তাই তরুণ মজুমদার, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় সমেত সমস্ত ইউনিট এই অভূতপূর্ব ঘটনার সাক্ষী হয়ে রইল। তরুণবাবুর ছবিতে বেশ কয়েকটি গান গেয়েছেন মান্নাদা। ফুলেশ্বরী, গণদেবতা, দাদার কীর্তি, আগমন। প্রতিটি ছবির সুরকার হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। বাংলা ছবির এক সফল জুটি। তরুণ মজুমদারের ২৫টি ছবিতে একটানা ২৫ বছর ধরে সংগীত পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেছেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। ভারতীয় ছবিতে এর দ্বিতীয় উদাহরণ আছে কি না জানি না। তরুণবাবুর প্রায় সব ছবির প্রধান গায়কও ছিলেন হেমন্তবাবু স্বয়ং। একবার কথাপ্রসঙ্গে তরুণবাবু বলেছিলেন, ‘‘হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠের স্ক্রিন প্রেজেন্স অসাধারণ। পর্দা জুড়ে সেই কণ্ঠের উপস্থিতি।’’ পাশাপাশি কিছু গানের জন্য মান্না দে’র প্রয়োজন হয়েছে। এই সিদ্ধান্ত যে শুধু তরুণবাবুই নিতেন তা নয়, এ ব্যাপারে হেমন্তবাবুরও সমান আগ্রহ ছিল। হেমন্ত-মান্নার সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে একটা বিষয় ভীষণ ভাবে আকৃষ্ট করে তরুণবাবুকে। দুজনের সম্পর্ক। হেমন্তবাবু যখনই ফোনে বলেছেন, ‘‘একটা গান গেয়ে দিতে হবে’’—শত ব্যস্ততার মধ্যেও মান্নাদা কখনও ‘না’ বলেননি। এই প্রসঙ্গে তরুণবাবুর একটা অভিজ্ঞতার কথা বলা যাক। কলকাতায় মান্না দে’র অনুষ্ঠান। কিন্তু মান্নাদা’র গলার অবস্থা খুবই খারাপ। গাইবেন কী, গলা দিয়ে স্বরই বার হচ্ছে না। উদ্যোক্তাদের তো মাথায় হাত! এত শর্ট নোটিসে যে অনুষ্ঠান ক্যানসেল করাও যাবে না। প্রচুর আর্থিক ক্ষতি। তা ছাড়া অনুষ্ঠানে যদি মান্না দে-ই না আসেন, তবে তো ভাঙচুর আরম্ভ হয়ে য়াবে! মান্নাদাও খুব চিন্তায় পড়ে গেছেন। ভেবেও কোনও কূলকিনারা পাওয়া যাচ্ছে না। এমন সময় উপস্থিত হলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এবং তিনিই উদ্ধারকর্তা হয়ে দাঁড়িয়ে, উদ্যোক্তাদের বলেন— ‘‘মান্নাবাবুর পক্ষে তো এ ভাবে গাওয়া সম্ভব নয়। সে ক্ষেত্রে আমি যদি ওঁর বদলে যাই, তা হলে কি কাজ হবে? অবশ্যই যদি মান্নাবাবু অনুমতি দেন, তবেই।’’ আয়োজকরা তো মেঘ না চাইতেই জল পেয়ে গেলেন। মান্না দে ছাড়া সারা বাংলাদেশে একজন শিল্পীই আছেন—হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, একবাক্যে যাঁকে সব ধরনের শ্রোতাই গ্রহণ করবেন! হেমন্তবাবুর প্রস্তাব শুনে মান্নাদা শুধু পরম কৃতজ্ঞ চিত্তে বললেন, ‘‘প্লিজ!’’ তরুণ মজুমদারের কথায়, ‘‘আজকের এই ব্রুটাল প্রতিযোগিতার যুগে এমন সহৃদয় সহযোগিতার কথা ভাবাই যায় না।’’ অথচ তখনও কিনা প্রতিযোগিতার ব্যাপারটা ছিলই। কিন্তু সে প্রতিযোগিতা ছিল নিজেকে আরও বেশি উন্নত করার জন্য। এ কারণে সামগ্রিক ভাবে সংগীতের মানটা উন্নীত হয়েছে। একটা ঘটনা মনে পড়ছে। বছর আটেক আগে সায়েন্স সিটিতে মান্নাদা-সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের সেই ঐতিহাসিক অনুষ্ঠান। কলকাতার প্রায় সব শিল্পীই এসেছেন দুই কিংবদন্তি শিল্পীর গান শোনার জন্য। প্রথমে গাইছেন সন্ধ্যাদি। অনেক দিন পরে অনুষ্ঠানে গাইছেন। একটা গান শেষ হচ্ছে আর দর্শকরা উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ছেন। মান্নাদা গ্রিনরুমে। বললেন, ‘‘আমাকে তো ওরা প্রায়ই শোনে। আজকে সবাই কিন্তু সন্ধ্যাদির গান শুনতে এসেছে।’’ বুঝলাম, মনে মনে মান্নাদা’র প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে। সত্যিই তাই। বোঝা গেল, যখন মান্নাদা’র অনুষ্ঠান শুরু হল। যাতায়াতের পক্ষে সায়েন্স সিটি তখন আরও অসুবিধাজনক। না আছে মেট্রো, না আছে ট্রেন, বাসও একটু রাত হলেই আর পাওয়া যায় না। রাত ৯টার পরে দর্শকদের আর ধরে রাখা যায় না। মান্নাদা এমনিতেই স্টেজ পেলেন একটু দেরিতে। শ্রোতারা তখনও সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গানে আবিষ্ট হয়ে আছে। মান্নাদা আস্তে আস্তে সুরের মায়াজাল বিস্তার করতে শুরু করলেন। তার পর কখন পেরিয়ে গেল রাত ৯টার নির্ধারিত সময়। মান্নাদা একের পর এক গান গেয়ে চলেছেন। অনুষ্ঠান শেষ হল রাত প্রায় সাড়ে দশটায়। দর্শক-শ্রোতার মন কানায় কানায় পূর্ণ। একে কি প্রতিযোগিতা বলবেন? দু’জনে তো দ্বৈত সংগীতও গাইলেন। এ জন্যই তাঁরা কিংবদন্তি হন। তাঁদের সংগীত বেঁচে থাকে একের পর এক জেনারেশনে। সংস্কৃতি সমৃদ্ধ হয়। মুগ্ধ হয় মানুষের মন।
সবারই একটা কৌতূহল। এই যে এত ভাষায় মান্নাদা গান করেছেন—সব সময়েই সঠিক উচ্চারণে। এ- বিষয়ে হৈমন্তী শুক্লার একটা দুর্দান্ত অভিজ্ঞতার কথা বলি। মান্নাদা এক সুরকারের কাছ থেকে তখন একটি গুজরাতি গান শিখছেন। সহজ সুর। মান্নাদা’র কাছে জল-ভাত। শর্ট নোটেশনে সুরটা লিখে রাখবেন। তার পর ইম্প্রোভাইজেশনের চিন্তাভাবনা। কিন্তু মান্নাদা সেই গুজরাতি সুরকারের কাছ থেকে বারবার গানটা শুনছেন। গুজরাতি গানেও মান্নাদা এক ভীষণ জনপ্রিয় শিল্পী। ১৯৪৭-এ ‘ভক্ত সুরদাস’ ছবিতে ‘ও ভক্তিমার্গ না’ গান দিয়ে প্লে-ব্যাক শুরু। তার পর ৫০টিরও বেশি গুজরাতি ছবিতে দারুণ দারুণ সব গান গেয়েছেন। যাই হোক, মান্নাদা’র গান শোনা শেষ হতে অবশেষে ওই বারবার গান শোনার রহস্যটি উন্মোচিত হল। হৈমন্তীদির বিস্ময় দেখে মান্নাদা বললেন, ‘‘দ্যাখো, যে-ভাষাতেই গান করি না কেন, সেই ভাষাটাকে শেখার চেষ্টা করি। কিন্তু ভাষা জানা এক জিনিস আর উচ্চারণটা সঠিক ভাবে করা অন্য জিনিস। এ জন্য আমি নানা ধরনের টেকনিক অ্যাপ্লাই করি।’’ হৈমন্তীদি এ বার সুযোগ পেয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘কিন্তু মান্নাদা, আপনি সুরকারের থেকে অত বার ধরে গানটা শুনছিলেন কেন? আমি তো জানিই, সুরটা তুলতে আপনার অত সময় লাগার কথা নয়।’’ মান্নাদা এ কথা শুনে হো-হো করে হাসতে লাগলেন, ‘‘আমি তো ওর গুজরাতি উচ্চারণটাই শুধু লক্ষ করছিলাম। এটা ওর মাদার টাং। তাই সুরের সঙ্গে কথাগুলো কী ভাবে বলছে সেটাই বোঝার চেষ্টা করছিলাম। যতটা কাছাকাছি যেতে পারব, গানটাও তত বেশি পারফেক্ট হবে।’’ সত্যিই থ’ হয়ে যাওয়ার মতো ঘটনা। আর এ জন্যই বার বার মনে হয়, ব্যতিক্রমী হতে গেলে ইনোভেটিভ ট্যালেন্ট-ও থাকা দরকার।
হৈমন্তীদির কিছু কথা যখন বলছি, তখন আর একটা মজার কথা বলি। মান্নাদা যে কী হিউমারাস ছিলেন! হৈমন্তীদি গেছেন কলকাতায় মান্নাদার বাড়িতে। মান্নাদা মাঝেমধ্যে এক-আধটা পান খান। হৈমন্তীদি ওঁর ড্রাইভারকে ডাকলেন পান আনার জন্য। শুনে মান্নাদা সেই ড্রাইভারকে বললেন, ‘‘আমার জন্য আপনি ‘প্রাণ’ আনবেন, ভাল কথা। একটু আলাপ করা যাক। আপনার নামটা কি ভাই?’’ ভদ্রলোক বিনীত ভাবে বললেন, ‘‘বৈদ্য দে।’’ মান্নাদা আঁতকে উঠে বললেন, ‘‘সে কী! আপনার পদবিও ‘দে’? জানেন তো, যাদের পদবি ‘দে’, তাদের সবাই টুপি পরায়! এ জন্যই তো আমাকে যাতে কেউ টুপি পরাতে না পারে, তাই আগেভাগে নিজেই আমি টুপি পরে নিয়েছি।’’
মান্নাদা’র অনেক দিকের মধ্যে একটা হল—তিনি সহকর্মীদের সমস্ত দিকটাই দেখেন। সহকর্মী বলতে বলছি তাঁর গীতিকার, সুরকার, বাদ্যযন্ত্রী এবং অন্যান্যদের কথা। অনিল বাগচীর সুরে মান্নাদা অসাধারণ সব গান গেয়েছেন। এর মধ্যে ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’র গান তো আজ ইতিহাস। এই ছবিতে গেয়েছিলেন অনিলবাবুর ছেলে অধীর বাগচীও। তখন নিতান্তই কিশোর। বয়স মাত্র সতেরো। পরবর্তী কালে অধীর বাগচীর সুরে মান্নাদাও অনেক ছবিতে গেয়েছেন। গানগুলো আজও একই রকম জনপ্রিয়। ‘সমাধান’ ছবির ‘যখন ভাবি গানকে আমার বাঈজি করে’ অথবা ‘দুই পুরুষ’ ছবির ‘আমি সুখী, কত সুখী’ ও ‘বেহাগ যদি না হয় রাজি’ অধীরবাবুর সুরে ও মান্নাদা’র গলায় আজও ভাল লাগে শুনতে। নচিকেতা ঘোষ-সুপর্ণকান্তি ঘোষের মতোই অনিল বাগচী-অধীর বাগচী, দু’পুরুষ সার্থক ভাবে সুর করেছেন মান্নাদা’র জন্য। ‘সমাধান’, ‘বড় ভাই’, ‘দুই পুরুষ’, ‘বনপলাশীর পদাবলী’—অধীরের সুরে নিয়মিত গাইতেন মান্নাদা। অধীরবাবু যখন মান্নাদাকে গান ‘তোলাচ্ছেন’, মান্নাদা একদিন ওঁকে বললেন, ‘‘তুমি এত ভাল গান করো। অথচ নিজের গানের কোনও বেসিক রেকর্ড নেই কেন তোমার?’’ মান্নাদার তখন দম ফেলার ফুরসত নেই, এত ব্যস্ত। তবুও পুত্রসম শিল্পীর জন্যও কত খেয়াল! তখনই পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়কে দিয়ে দুটি গান লেখালেন—‘চাঁদ বিনা সারাদিন’ এবং ‘যখনই গানের মুখ মনে আসে না, তোমার মুখটা মনে করি’। সুর করলেন মান্নাদা নিজে। এইচএমভি থেকে প্রকাশিত হল সেই রেকর্ড। এক নবীন শিল্পীমনের একটি অপূর্ণ আশা পূর্ণ করে দিলেন মান্নাদা!
বলছিলাম: দু’পুরুষ সুর করছেন, গাইছেন মান্নাদা। আর তাঁর গান শুনছেন কয়েক পুরুষ। একবার মুম্বইয়ের শিল্পীদের নিয়ে কথা হচ্ছে। কথায় কথায় উঠল গায়ক শানের কথা। মান্নাদা বললেন, ‘‘ইয়েস, হি কামস ফ্রম আ ভেরি রিচ মিউজিক্যাল ফ্যামিলি। জহর মুখোপাধ্যায় কত সব অসাধারণ গান রচনা করেছেন!’’ আমি একটু কিন্তু কিন্তু করে বললাম, ‘‘দাদা, শানের বাবার নাম তো মানস মুখোপাধ্যায়।’’ মান্নাদা গম্ভীর ভাবে বললেন, ‘‘জানি। কিন্তু আমি সেই মানসের বাবা জহর মুখোপাধ্যায়ের কথা বলছিলাম।’’