Soumitra Chatterjee

অনন্ত নক্ষত্রবীথি তুমি, অন্ধকারে

গত এক মাস সোশ্যাল মিডিয়া খুললেই অবিরত চোখে পড়েছে তাঁর সুস্থতা কামনায় ছেয়ে যাওয়া দেওয়াল। শেষ কবে এক জন মানুষের, এক জন বাঙালির অসুস্থতায় তামাম সম্প্রদায় এমন আন্তরিক ভাবে উদ্বেল হয়েছিল, মনে পড়ে না।

Advertisement

শ্রীজাত

শেষ আপডেট: ১৬ নভেম্বর ২০২০ ১৮:২৭
Share:

ফাইল ছবি। নিজস্ব চিত্র.

সত্যিকারের আইকন পেতে একটা জাতির অনেক দিন লেগে যায়। এমন এক ব্যক্তিত্ব, যিনি আদর্শ, যিনি উদাহরণ, যিনি প্রভাবশালী, যিনি অনুসরণযোগ্য, যিনি নক্ষত্র, অথচ যিনি স্পর্শাতীত নন। এই সমস্ত গুণ এক জন মানুষের মধ্যে দেখতে পেলে তবেই তাঁকে আইকন বলে মেনে নেওয়া, আইডল বলে স্বীকৃতি দেওয়া, না হলে নয়। জাতি হিসেবে বাঙালির বড় সৌভাগ্য যে, এমন ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ ব্যক্তিত্ব সে বড় কম পায়নি। কিন্তু দুর্ভাগ্য এই যে, সেই প্রাপ্তির ভাঁড়ার শূন্য হয়ে আসছে দ্রুত। যে-ভান্ডারের শেষতম উজ্জ্বলতা নিয়ে চলে গেলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। এ কথা বলতে দ্বিধা নেই যে, জৌলুস আর মেধার এমন সংমিশ্রণ, তারকা ও মানুষের এমন সহাবস্থান, জনপ্রিয় ও প্রিয় জনের এমন মেলবন্ধন বাঙালি এর আগে পায়নি।

Advertisement

গত এক মাস সোশ্যাল মিডিয়া খুললেই অবিরত চোখে পড়েছে তাঁর সুস্থতা কামনায় ছেয়ে যাওয়া দেওয়াল। শেষ কবে এক জন মানুষের, এক জন বাঙালির অসুস্থতায় তামাম সম্প্রদায় এমন আন্তরিক ভাবে উদ্বেল হয়েছিল, মনে পড়ে না। তাঁর ছবিতে, তাঁর মুখের অলঙ্করণে সকলে ভরিয়ে তুলছিলেন নিজেদের পাতা, দিনের মধ্যে দশ-বারো বার তাঁর স্বাস্থ্যের পরিস্থিতি নিয়ে কৌতূহল প্রকাশ পাচ্ছিল, অসহায়ের মতো প্রার্থনায় কে জানে কোন অজানার দিকে নিজেদের আর্তি ভাসিয়ে দিচ্ছিল একটা গোটা জাতি। ভালবাসার এই আশ্চর্য বিস্তার খুব কম মানুষের জন্য আসে পৃথিবীতে। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় সেই ভালবাসা পাওয়ার মতোই ব্যক্তিত্ব ছিলেন।

আর এইখানেই চোখে পড়ছিল একটি বিষয়। আমিও যখন ভারী হয়ে আসা মনখারাপের মধ্যে নেহাত অভ্যাসবশে পার হয়ে চলছিলাম সোশ্যাল মিডিয়ার পর্দা, আর দেখতে পাচ্ছিলাম তাঁর জন্য শুভেচ্ছায় উপচে ওঠা দেওয়াল, তাঁর নামটা কিন্তু দেখছিলাম না কোথাও তেমন। হ্যাঁ, হেলথ বুলেটিন আসছিল ঘণ্টায় ঘণ্টায় তাঁর নামে, এ ছাড়া এত যে প্রার্থনা আর শুভেচ্ছাবার্তা, প্রায় কোথাওই তাঁর নিজের নাম ছিল না। ছিল তাঁর চরিত্রদের নাম। এ বড় অদ্ভুত। অজস্র মানুষ চাইছিলেন ‘উদয়ন পণ্ডিত’ সুস্থ হয়ে উঠুন, অগণিত লোকের আশা, চারুলতা-র ‘অমল’ যেন দ্রুত বাড়ি ফেরেন, বহু জনের প্রার্থনা বাঙালির ‘অপু’ যেন অপরাজিত থাকেন চিরকাল, অনেকের চাহিদা ‘ফেলুদা’-কে সল্ভ করতেই হবে এবারের কেস, আবার বহু মানুষ যেন বা পাড়ে দাঁড়িয়ে ‘খিদ্দা’-কে চেঁচিয়ে বলছিলেন ‘ফাইট!’

Advertisement

আরও পড়ুন: সৌমিত্রকাকুকে মডেলের মতো বসিয়ে ছবি এঁকেছিলেন বাবা

মিথ্যে বলব না, এ সব দেখে গোড়ার দিকে একটু অস্বস্তিই হচ্ছিল। এক জন মানুষ, যিনি সারা জীবন নানা শাখায় নিজেকে নিয়োজিত করেছেন, তাঁর সঙ্কটে আমরা তাঁর অভিনীত চরিত্রদের সাজিয়ে নিয়ে শুভেচ্ছা পাঠাব কেন? কেন তাঁর মুখের প্রবাদ হয়ে যাওয়া অজস্র সংলাপ উল্লেখ করে আমরা বলতে চাইব তাঁর কথা? ব্যপ্ত জীবনের ফসল হিসেবে কেবল এই ক’টি রুপোলি পর্দার চরিত্র, এই কি তবে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের পরিচয়, আমাদের কাছে? এ-কথা মনে হচ্ছিল প্রথম প্রথম। পরে বুঝলাম, আমারই ভুল হচ্ছে। মানুষ যখন পুরোপুরি আবেগের বশে নিজেকে ব্যক্ত করে, তখন তার ভালবাসার চেয়ে সত্যি কিছু হয় না। আর এই সমস্ত চরিত্র আজ বাঙালির ভালবাসার শিখরে।

কেবল তা-ই নয়, খোদ সৌমিত্রকেই ছাড়িয়ে এই সব চরিত্র হয়ে উঠেছে বাঙালির আইকন, তার পরিত্রাতা, তার জীবনদেবতা। এক জন অভিনেতার জন্য এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি বোধ হয় আর কিছুই হতে পারে না যে, তাঁর মাধ্যমে প্রস্ফুটিত এক একটি চরিত্রকে বাঙালি তার ঘরের লোক বলে জেনেছে, পাশের মানুষ বলে চিনেছে। মানুষ সৌমিত্র তো দূরের, তাঁর নাগাল পাওয়া সকলের পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু বহু বহু মানুষকে জীবনের নানা বিপন্নতায়, অসহায়তায় স্থৈর্য দিয়েছে সৌমিত্র-অভিনীত এই সব চরিত্র। কখনও উদয়ন পণ্ডিত কাউকে দেখিয়েছেন নৈতিকতার পথ, কখনও খিদ্দা কাউকে শিখিয়েছেন অপরাজয়ের মন্ত্র, আবার কখনও ফেলুদা কাউকে দিয়েছেন সাহসের টোটকা। আমরা যাঁরা সাহিত্যনির্ভর সম্প্রদায়ের মানুষ, যাঁরা চলচ্চিত্রপ্রেমী জাত, তাঁদের কাছে এই সব চরিত্র বড় বেশি জীবন্ত। আর সেই সমস্ত উড্ডীন ঘুড়ির সুতো শেষ হয় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের হাতে। এ বড় আশ্চর্য সমাপতন।

আরও পড়ুন: চরিত্র বদল ঘটেছে, কিন্তু অধ্যবসায় একই

ছবির বাইরেও কত শিল্পপ্রবাহে নিজেকে মেলে দিয়েছেন তিনি, সে পর্যালোচনা চলতেই থাকবে। কবি, আবৃত্তিকার, নাট্যকার, নির্দেশক, শিক্ষক, সম্পাদক, কত শিরোপায় সাজিয়েছেন নিজেকে, এ বিস্ময়ও আমাদের যাওয়ার নয়। যাওয়ার কেবল মানুষ। এই রকম সময়ে এঁদের মানুষ হিসেবে ভাবতেই কষ্ট হয় আমাদের। তিনি তো জীবনের চাইতে বড়, তবে জীবন কেন শেষ হবে তাঁর? কেন চলবে না শ্বাস-প্রশ্বাসের আবহমান খেলা? এমন বলতে ইচ্ছে করে। তার পর মনে পড়ে জীবনানন্দের সেই অমোঘ পঙ্‌ক্তি, ‘‘মানুষের মৃত্যু হলে তবুও মানব থেকে যায়’’। মানব সৌমিত্রের সফর শুরু হল এই। যার কোনও শেষ নেই কোথাও।

মনে আছে, ছোটবেলায় পাঠ্য বইয়ে একটা কথা পড়ে ভারী অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। সেই অবাক ভাব কাটতে সময়ও লেগেছিল বহু দিন। সত্যি বলতে কী, কাটেওনি পুরোপুরি। রাতের আকাশের দিকে তাকালে আমরা যে অনেক অনেক তারাকে ঝলমলিয়ে উঠতে দেখতে পাই, তাদের অনেকেরই জীবন ফুরিয়ে গিয়েছে বহু বছর আগে। এতই দূরে আমাদের থেকে যে, তাদের কারও কারও আলো আমাদের এই গ্রহে এসে পৌঁছতে লেগে যায় কয়েক হাজার বছর। তাই, নিভে যাওয়ার মুহূর্তে তার শরীর থেকে যে আলো বিচ্ছুরিত হয়েছে, সে আরও কয়েক হাজার বছর নেবে, পৃথিবীতে এসে পড়তে। ভাবলে অবাকই লাগে, হয়তো এমন অনেক মৃত তারাদের আলোতেই আজও সেজে ওঠে আমাদের গ্রহের রাতের আকাশ। তাদের মৃত্যুর পরও তাদের আলো ছুটতে থাকে মহাকাশের দীর্ঘ রাস্তা পেরিয়ে। সেই প্রথম বুঝতে পারি, মৃত্যু মানেই অনস্তিত্ব নয়, মৃত্যু মানেই অনুপস্থিতি নয়। অন্তত নক্ষত্রদের ক্ষেত্রে তো নয়ই। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় তেমনই এক নক্ষত্র, যিনি মঞ্চ থেকে, পর্দা থেকে, সাহিত্য থেকে সশরীর সরে গেলেও, তাঁর আলো এসে আমাদের কাছে পৌঁছবে আরও অগণন বছর ধরে। তাঁর প্রিয় কবি জীবনানন্দকেই আরও এক বার উদ্ধৃত করে বলা যায়, ‘‘অনন্ত নক্ষত্রবীথি তুমি, অন্ধকারে’’। হ্যাঁ, আজকের এই শোক পেরোতে সময় আমাদের লাগবে ঠিকই, কিন্তু সেই দূরাগত আলোর জন্যই আমরা এক দিন বিস্মৃত হব যে, তিনি নেই। কেননা যত দিন বাংলা ভাষা ও তার সংস্কৃতির কোনও অস্তিত্ব থাকবে কোথাও, তাঁর আলো এসে পৌঁছতে থাকবে আমাদের প্রত্যেকের জীবনে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন