Soumitra Chatterjee

তাঁর কবিতা কৃষ্ণনগরের গোধূলি, মানবিকতার ইস্তাহার

কবিতা তাঁর কাছে টাইমপাস নয়। অস্তিত্বের পাসওয়ার্ড। অনুজ কবি লিখলেন কবি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে।সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে যাঁরা পর্দায় দেখেছেন শুধু, তাঁরা জানেন না যে, তিনি সাদা পৃষ্ঠাতেও পরমান্ন পূজারী।

Advertisement

সুবোধ সরকার

শেষ আপডেট: ১৫ নভেম্বর ২০২০ ১৪:১৫
Share:

তিনি সাদা পৃষ্ঠাতেও পরমান্ন পূজারী। ফাইল চিত্র।

লন্ডনের গোধূলি আর কলকাতার গোধূলি এক রকম নয়। প্রতিটা শহরের একটা আলাদা গোধূলি আছে। প্রত্যেক কবির গোধূলি আলাদা আলাদা। ‘লাইক আ পেশেন্ট ইথারাইজড আপন আ টেবল’ বললে যে গোধূলির রূপ ভেসে ওঠে, তার সঙ্গে জীবনানন্দের বিদিশার কোনও মিল নেই। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের স্বেচ্ছাচারী কল্লোলের সঙ্গে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের গোধূলির কোনও মিল নেই। নেই বলেই কবিতা অনেক রকম। আর কবিতা অনেক রকম বলেই কবিতা আজও রাজদ্বারে, কুটিরে ও হাইরাইজে বেঁচে আছে।

Advertisement

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে যাঁরা পর্দায় দেখেছেন শুধু, তাঁরা জানেন না যে, তিনি সাদা পৃষ্ঠাতেও পরমান্ন পূজারী। ‘অশনিসঙ্কেত’-এর বামুন যতটা নিষ্ঠাভরে মাছ রান্না করছিল, ততটা মমত্ব দিয়ে তিনি কবিতা লিখে এসেছেন সারা জীবন। ৮০০ পৃষ্ঠার উপর তাঁর কবিতা (কবিতাসমগ্র, আনন্দ পাবলিশার্স)। সে খুব সহজ কথা নয়। শ্যুটের সময় দুটো টেকের মাঝখানে যে সময় কুড়িয়ে পাওয়া যায়, তিনি সেই কুড়িয়ে পাওয়া সময়ের কবি নন। হলে তিনি ৮০০ পাতা লিখতে পারতেন না। নিজেকে সিরিয়াসলি না নিলে কেউ ৮০০ পাতা লিখতে পারে না। কবিতা তাঁর কাছে টাইমপাস নয়। অস্তিত্বের পাসওয়ার্ড।

Advertisement

নিজের জন্য একটা রোমান্টিক জামা ছিল তাঁর। জামাটি তিনি অন্য কারও থেকে ধার করেননি। সত্যজিতের ‘তিনকন্যা’য় ‘সমাপ্তি’র অমূল্য।

কবিতার জগতে তিনি প্রবেশ করেছিলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ঝুলোঝুলিতে। সুনীল-শক্তির ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়েও তিনি একটি ‘অকৃত্তিবাসীয়’ পটভূমি তৈরি করে নিয়েছিলেন প্রথম থেকে। নিজের জন্য একটা রোমান্টিক জামা ছিল তাঁর। জামাটি তিনি অন্য কারও থেকে ধার করেননি। পাঁচের দশক বাংলা কবিতার জন্য একটা আগুন ঝরানো দশক। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় সেই আগুনকে ঠান্ডা করে জলঝর্নার পাশে রাখতে পেরেছিলেন।

আরও পড়ুন: মঞ্চের সৌমিত্র ছিলেন থিয়েটারের বড়দাদা, বরাবর বিস্মিত করেছেন

কবি হিসাবে সৌমিত্রদাকে আমি বহু মঞ্চে পেয়েছি। তার মানে হল এই যে, তিনি তাঁর নিজের লেখা কবিতা পাঠ করে শুনিয়েছেন। দুটো জায়গায় আমার দু’রকমের অভিজ্ঞতা হয়েছিল। প্রথম জায়গাটা হল টাকি। ইছামতীর ধারে। সেখানে একটা অতিথি নিবাস আছে। ভারী সুন্দর। সন্ধেবেলায় আমরা পৌঁছে গেলাম। পরের দিন সকালে অনুষ্ঠান। সৌমিত্রদাকে বললাম, এই বার আপনার নতুন কবিতা শুনব। আমাকে আসার পথেই জানিয়েছিলেন একটি খাতা রয়েছে তাঁর সঙ্গে। সব নতুন কবিতা। তাঁর সেই বিখ্যাত কণ্ঠকে কম বিখ্যাত করে, ডিগ্ল্যামারাইজ করে পড়ে শোনাতে লাগলেন নিজের কবিতা। একটার পর একটা। আমি মুগ্ধ হয়ে শুনে চলেছি তাঁর কবিতা। হঠাৎ দরজায় ঠক-ঠক। সৌমিত্রদা তাকিয়ে দেখলেন, একজন দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি এক বিশিষ্ট মন্ত্রীর সচিব। তিনি বললেন, ‘‘মন্ত্রী নীচে অপেক্ষা করছেন আপনার সঙ্গে দেখা করবেন বলে।’’ সৌমিত্রদা বললেন, ‘‘শুনুন, আমি এখন একটা খুব জরুরি কাজে ব্যস্ত আছি। আমি এখন কারও সঙ্গে দেখা করতে পারব না। আমাকে ক্ষমা করবেন।’’

৮০০ পৃষ্ঠার উপর তাঁর কবিতাসমগ্র। সে খুব সহজ কথা নয়।

সে দিন পুরো খাতা থেকে একটা একটা করে সব কবিতা শুনিয়েছিলেন। আমি জীবনে কখনও কোনও কবির মুখ থেকে একটা গোটা খাতা কবিতা শুনিনি।

আরও পড়ুন: ফেলুদা করতে গিয়ে সৌমিত্রবাবুকে অনুসরণ করেছি, অনুকরণ করিনি

দ্বিতীয় যে ঘটনাটা মনে আছে, সেটা আমেরিকার। সে বার বঙ্গ সম্মেলন বসেছিল নিউ ইয়র্ক শহরে। সৌমিত্রদা এসেছেন তারকা হিসেবে নাটক নিয়ে। একটা রবিবারের সকালে ছিল আমাদের কবিতা পাঠ। সৌমিত্রদাকে আমাদের বন্ধু গৌতম দত্ত বিশেষ অনুরোধ করে মঞ্চে নিয়ে এলেন কবিতা পড়াতে। সৌমিত্রদাকে দেখে বহু মানুষ ঢুকে পড়লেন হল ঘরে। অত সকালে হল ভরে গেল। আমি বেশ কয়েকটা কবিতা পড়লাম। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লেখা কবিতা। কিন্তু হঠাৎ দেখলাম কয়েক জন লোক চিৎকার করছে আমার বিরুদ্ধে। দু’একজন মঞ্চের দিকে ছুটে আসছে আমাকে মারবে বলে। কী করব বুঝতে পারলাম না। সৌমিত্রদা আমাকে নিয়ে মঞ্চের পিছন দিয়ে বেরিয়ে এসে রাস্তায় দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরালেন। আমাকেও দিলেন। সে বার সৌমিত্রদা আমাকে না বাঁচালে হয়তো বড় কোনও ঘটনার দিকে বাঁক নিত বিষয়টা। সে দিন সৌমিত্রদার আর কবিতা পড়া হয়নি।

পাঁচের দশক বাংলা কবিতার জন্য একটা আগুন ঝরানো দশক। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় সেই আগুনকে ঠান্ডা করে জলঝর্নার পাশে রাখতে পেরেছিলেন।

তিনি কখনও বলেননি, বাংলা কবিতাকে পাল্টে দেবেন। তিনি কোনও স্যুররিয়ালিস্ট মুভমেন্ট করেননি বাংলা কবিতায়। তিনি বাংলা কবিতার ঝুঁটি ধরে টান মারেননি। তিনি একটা পাহাড়ি ঝোরার মতো উপর থেকে তর তর করে নীচে নেমে এসেছেন। তাঁর গায়ে অনেক গুল্ম, অনেক ফার্ন, অনেক সবুজ। ঝোরার ধারে পা নামিয়ে বসে থাকতে বেশ লাগে। এমন কবিকে না পেলে সমকাল বৃথা হয়ে যায়। কোনও মতবাদকে সমর্থন করার জন্য তিনি কবিতা লেখেননি। তাঁর কবিতা কখনও ইস্তাহার হয়ে উঠতে চায়নি। তবে আমি বলব, তাঁর কবিতা আসলে মানবিকতার ইস্তাহার। সৌমিত্রদার কৃষ্ণনগরে জন্ম বলে নয়, আমি নিজে কৃষ্ণনগরের ছেলে হয়ে দিনের পর দিন বিকেল কী করে গোধূলি হয়ে ওঠে তার ইস্তাহার পাঠ করেছি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতায়। বাংলা কবিতাকে তিনি সমকালে স্থাপন করেও এক ভবিষ্যৎ নক্ষত্রের দিকে ঢেলে দিয়েছেন।

আরও পড়ুন: উত্তমকুমার হয়ে ওঠেননি, কিন্তু বেলাশেষে তিনি সৌমিত্র

শুনতে পাই তিনি বলে চলেছেন— ‘‘কতগুলো ভীরু বারুদকে আমি/ প্রচণ্ড রেগে গিয়ে ঘেন্নায়/ বোমা আর পাইপগান দিয়ে/ ভীষণ চমকে দিয়েছিলাম।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন