বাঙালিগুলো ফের লন্ডনে

লং হ্যাট পরে সোহো-তে। কখনও উইম্বলডনের বাড়িতে। পাবে ঢুকে বিয়ার আর চিকেন স্টেক। পিকাডেলি সার্কাসে ক্যামেরার পিছনে। লন্ডনে ‘দ্য বংস এগেইন’-এর শ্যুটিং দেখলেন ইন্দ্রনীল রায়লং হ্যাট পরে সোহো-তে। কখনও উইম্বলডনের বাড়িতে। পাবে ঢুকে বিয়ার আর চিকেন স্টেক। পিকাডেলি সার্কাসে ক্যামেরার পিছনে। লন্ডনে ‘দ্য বংস এগেইন’-এর শ্যুটিং দেখলেন ইন্দ্রনীল রায়

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৬ মে ২০১৬ ০০:০৩
Share:

এই ব্রিটেন লন্ডনের নতুন পাকিস্তানি মেয়র সাদিক খানের।

Advertisement

এই ব্রিটেন লেস্টার সিটির দুরন্ত ইপিএল জেতার।

এই ব্রিটেন রোদ্দুরে জ্বলে যাওয়া ব্রিটেন।

Advertisement

এই সবের মধ্যেই কখনও কেন্টে, কখনও ইস্ট বোর্নে এবং কখনও সেন্ট্রাল লন্ডনের পিকাডেলিতে শ্যুটিং করে চলেছেন তিনি। সঙ্গে পার্নো মিত্র আর গৌরব চক্রবর্তী।

সাদিক খান আর লেস্টার -এর মতো মে মাসের ব্রিটেন তাই বেনিয়াপুকুরের অঞ্জন দত্ত’রও।

দশ বছর আগে হিউস্টনে ‘বং কানেকশন’র পর আবার তিনি ‘বং’দের নিয়ে ফিরে আসছেন। ছবির নাম ‘দ্য বংস এগেইন’। প্রযোজক অশোক এবং হিমাংশু ধানুকার এসকে মুভিজ।

সেই শ্যুটিং কভার করতেই কলকাতা থেকে সাত হাজার কিলোমিটার দূরে আসা।

• ব্রিটেনের হায়েস্ট সুইসাইড স্পট

হিথরোতে নেমেই বুঝলাম এই শহরে আপাতত ভরপূর ‘ইংলিশ সামার’। রাত ন’টা অবধি রোদ। ক্রিকেট সিজন শুরু হয়ে গিয়েছে। রাস্তার কাফেগুলোতে উপচে পড়ছে ভিড়। আর গোটা দেশের পাব-এ লেস্টার জেতা ছাড়া আলোচনা পরের মাসের ইউরো কাপ নিয়ে।

পরের দিন ভোর ভোর পৌঁছানো গেল ইস্ট বোর্নে। এক দিকে পাহাড়, অন্য দিকে নীল সমুদ্র। এখান থেকেই বছরের পর বছর সব চেয়ে বেশি সুইসাইড হয় গোটা গ্রেট ব্রিটেনে। পুরো জায়গাটা অসম্ভব মনোরম হলেও গা ছমছমে ভাব চারিদিকে। দেখা হল অঞ্জন দত্ত আর পার্নোর সঙ্গে।

ছবির গল্পের বড় অংশ পার্নো মিত্রকে নিয়ে। যার শ্যুটিং হচ্ছে এদেশে। লন্ডনের রাস্তাঘাট, শহরতলিতে কাউকে যেন হন্যে হয়ে খুঁজছেন পার্নো। ছবিতে যার নাম অলিপ্রিয়া। কাকে খুঁজছেন? কেন খুঁজছেন?

এই খোঁজার জার্নিতে তাঁকে সাহায্য করছেন, বয়ফ্রেন্ড গৌরব চক্রবর্তী এবং একটি বিশেষ চরিত্রে অঞ্জন দত্ত। এর বাইরে কিছু লিখলে কথার খেলাপ হবে।

• ওয়ান ম্যান ব্যান্ড

“অনেকেই এটা ‘বং কানেকশন’য়ের সিকোয়েল ভাবছেন। তা কিন্তু একেবারেই নয়। এটা সম্পূর্ণ অন্য ছবি, অন্য গল্প। ওটা ছিল ২০০৪য়ের বংস-দের গল্প। এটা ২০১৬র”, প্রথম দিনের শ্যুটিংয়ের ফাঁকে লাঞ্চব্রেকে ব্ল্যাক কফি খেতে খেতে বলছিলেন অঞ্জন দত্ত।

এ দেশে এমনি এশিয়ানদের ছড়াছড়ি। তার পর অঞ্জন দত্তকে অনেকেই টালিগঞ্জের শেষ সাহেব বলে থাকেন। ব্রিটেনের রাস্তাঘাটে তাঁকে দেখে কে বলবে তিনি এখানে থাকেন না!

কখনও পাবে ঢুকে বিয়ার খাচ্ছেন তাঁর ডিরেক্টোরিয়াল টিমকে নিয়ে। কখনও লং কোট পরে কারনাবি স্ট্রিটে লাইটার ধরাচ্ছেন হ্যাট পরা মেমের। কখনও উইম্বলডনের এক বাড়িতে ‘ইমাজিন’ গুনগুন করছেন। পুরো ব্যাপারটাই ইংলিশ। পুরো টিম যখন রাতে ফিরে ডাল-ভাত খাচ্ছে, অঞ্জন দত্ত তাঁর সার্ভিস অ্যাপার্টমেন্টে সিনেমাটোগ্রাফার ইন্দ্রনীল মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে রাঁধছেন গ্রিলড চিকেন উইথ ব্ল্যাক বিন সস।

• আর ভয় পাই না অঞ্জনদাকে

রান্না করা শুধু এই ফিল্মেই যে হচ্ছে তা কিন্তু নয়। অঞ্জন-এর সব ফিল্মের শ্যুটিংয়েই এটাই রীতি। ‘রঞ্জনা আমি আর আসব না’ থেকেই পরিচালককে এমনই দেখে আসছেন পার্নো।

‘‘অঞ্জনদার ইউনিট মানেই দারুণ মজা করে শ্যুটিং। একটু অন্যরকমও। আজও কথায় কথায় মনিটর দেখেন না অঞ্জনদা। কখন যে সময় কেটে যায় বুঝতেই পারি না। তবে ‘রঞ্জনা’র সময় আমি অঞ্জনদাকে অসম্ভব ভয় পেতাম। এ বারে ভয়টা অনেক কম। অঞ্জনদার সঙ্গে রিহার্সাল করছি, নিজের মতামতও জানাচ্ছি। ইট’স গ্রেট ফান,’’ রাস্তার উপর বসে মেক আপ করতে করতে বলছিলেন পার্নো।

পার্নো অবশ্য এখানে শ্যুটিংয়ের চাপের জন্য পার্টি করতেই পারছেন না। ‘‘সময় কোথায় শ্যুটিংয়ের ফাঁকে? আমি তো তাই এক্সট্রা দশ দিন থাকছি আমার এক বান্ধবীর বাড়িতে। ইচ্ছে আছে প্রচুর পার্টি করার। ভাল খাবার খাওয়ার। হ্যান্ডসাম ব্রিটিশ ছেলেদের সঙ্গে ফ্লার্ট করার,’’ হাসতে হাসতে বলছিলেন পার্নো।

কিন্তু তাঁর বয়ফ্রেন্ড জানলে? ‘‘বয়ফ্রেন্ডের আমার উপর ফুল কনফিডেন্স আছে। নো চিন্তা,’’ মুখে টিক-ট্যাক ঢালতে ঢালতে জানালেন পার্নো।

এর মধ্যেই অঞ্জনদা এসে পার্নোর সঙ্গে পরের সিনের রিহার্সাল করে গেলেন। তারপরই তাঁর বহু ফিল্মের প্রোডাকশন ম্যানেজার, সঞ্জয় পাঠককে নিয়ে দৌড়োলেন কস্টিউম দেখতে। ড্রেস দেখেই একজনকে বললেন সবার জন্য ডিম সেদ্ধ বানাতে। লন্ডনে অঞ্জন যেন সেই বিখ্যাত গানের মতোই সত্যি সত্যি ‘ওয়ান ম্যান ব্যান্ড’।

ইস্ট বোর্নে অঞ্জন-পার্নো

• কে ভাল অভিনেতা এটা আমি সব চেয়ে ভাল বুঝি

গত বছর ব্যোমকেশ সুপারহিট হওয়ার পর থেকেই অঞ্জন দত্ত আবার ফিরেছেন তাঁর নিজস্ব মেজাজে।

‘‘মাঝখানে আমি একদম ভেঙে পড়েছিলাম। ছবি চলছিল না। আমার বন্ধুদের শরীর খারাপও আমাকে ভীষণ ভাবে নাড়িয়ে দিয়েছিল। তবে সামলে উঠেছি। আর একটা ‘ব্যোমকেশ’ রেডি। ‘হেমন্ত’ অগস্ট মাসে রিলিজ হবে। আর এখন লন্ডনে শ্যুটিং। থিংস আর ফাইনালি গুড,’’ দুপুরে পর্ক চপস খেতে খেতে বলছিলেন অঞ্জন দত্ত।

এ ছবিতে ‘রঞ্জনা’র পর তিনি আবার একটি বড় চরিত্র করাচ্ছেন পার্নোকে দিয়ে।

‘‘পার্নো ইজ এ ভেরি গুড অ্যাকট্রেস। ওর একটা নিজস্ব ভাবনাচিন্তা আছে। আমি ওকে বলেছি টিপিকাল টালিগঞ্জের নায়িকাদের অভিনয়টা এখানে না করতে।

আর ভাল ছবি বানাতে পারি কি না আমি জানি না। কিন্তু কে ভাল অভিনেতা এটা গোটা ইন্ডাস্ট্রিতে বোধ হয় সব চেয়ে ভাল বুঝতে পারি আমি। এটা আমার স্ট্রেংথ। আই ক্যান স্মেল গুড অ্যাকটরস,’’ হাতটাত নেড়ে নিজের ভঙ্গিতে বলেন অঞ্জন।

• বিগবেনের সামনে খিচুড়ি, বেগুন ভাজা

বিদেশে এখন এমনিতেই ভারতীয় ছবির এত বেশি শ্যুটিং হয় যে দেশটা ছাড়া আপনার কোনও কিছুতেই মনে হবে না বিদেশে আছেন। সকালে ব্রেকফাস্টে পাকিস্তানি কেটারার মহম্মদ ভাই তৈরি করে আনছেন আলুর পরোটা, আচার, আর টক দই। সন্ধ্যাবেলা ইউনিট খাচ্ছে ম্যাগি।

লন্ডনের লাইন প্রোডিউসর দুই বঙ্গসন্তান, শ্যামবাজারের সিদ আর সুশান্ত বিগবেনের সামনে ইউনিটকে খাওয়াচ্ছেন খিচুড়ি আর বেগুনভাজা। ‘‘সত্যি কলকাতায় নেই মনে হচ্ছে না। এখানে এমনই ব্যবস্থা। আমি এমনি ভয়ে ভয়ে ছিলাম, কারণ এটা আমার অঞ্জন দত্তের সঙ্গে প্রথম ছবি। অনেক গল্প শুনেছি অঞ্জনদার। কিন্তু এখানে এসে এমন বাঙালি পরিবেশ পেয়ে আমার আর কোনও ভয় নেই।
ফাটিয়ে কাজ করছি। অঞ্জনদা ইজ আ সুপার্ব ডিরেক্টর, দারুণ ইনপুটস দিচ্ছেন,’’ বলছিলেন ‘ফেলুদা’র পুত্র গৌরব চক্রবর্তী।

সবিস্তারে দেখতে ক্লিক করুন

• না রণবীর নেই

এই আড্ডার মধ্যেই অবশ্য আরও একটা অদ্ভুত মুহূর্ত ঘটে গেল কার্নবি স্ট্রিটের মোড়ে। কোর্ট হাউজ লন্ডন হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে সবাই তখন সিগারেট খাচ্ছে। এর মধ্যেই পার্নোই প্রথম লক্ষ করেন হোটেলের সামনে সস্তার একটা টেকঅ্যাওয়েতে ঢুকছেন বলিউডের এক প্রথম সারির নায়িকা।

একমনে জিনিস কিনে প্যাকেট নিয়ে বেরোনোর সময়ই দেখলাম ঠিকই দেখেছেন পার্নো। বাড়িতে পরার পিঙ্ক পাজামা, নীল টিশার্ট আর স্লিপার্স পরে খাবার কিনে রাস্তা ক্রস করে একা একা হোটেলে ফিরে যাচ্ছেন তিনি।

না, কোনও মেক আপ নেই, সঙ্গে নেই রণবীর কপূরও।
নায়িকার নাম কি আর বলতে হবে? ক্যাটরিনা কইফ।

• কমার্শিয়াল বাংলা ছবির অবস্থা ভাল নয়

পুরো শ্যুটিংয়ে কারও কোনও অসুবিধা যাতে না হয়, সেই দিকে তীক্ষ্ণ নজর প্রযোজক হিমাংশু ধানুকার।

টেকনিশিয়ানদের থাকার জন্য ভাল সার্ভিস অ্যাপার্টমেন্টের ব্যবস্থা করা থেকে শ্যুটিংয়ের সব খুঁটিনাটি নিজেই দেখছেন। সঙ্গে ক্রমাগত হোয়াটসঅ্যাপ কলে ছেলেকে কলকাতা থেকে নির্দেশ দিচ্ছেন অশোক ধানুকা।

‘‘দেখুন, এত দিন ধরে আমরা শুধু কমার্শিয়াল বাংলা ছবির প্রযোজনা করেছি। এই প্রথম আমরা অন্য ধারার ছবি করতে এলাম,’’ কার রেন্টাল থেকে ভাড়া নেওয়া গাড়ি চালাতে চালাতে বলছিলেন হিমাংশু।

কিন্তু একসময় তো আপনারা এ রকম ছবি বানাতেই চাননি! হঠাৎ কী হল আপনাদের?

‘‘দেখুন, সময় পাল্টায়। কমার্শিয়াল বাংলা ছবির অবস্থা সত্যি খুব ভাল নয়। আমরাও এখন অঞ্জনদা, সৃজিত (মুখোপাধ্যায়), কৌশিকদার (গঙ্গোপাধ্যায়) সঙ্গে কাজ করতে চাইছি। আমরা এতটাই সিরিয়াস এই ধরনের ছবি করতে যে, ‘বং কানেকশন’‌য়ের প্রোডিউসর জয় গঙ্গোপাধ্যায়কে এই ছবিতে ক্রিয়েটিভ প্রোডিউসর হিসেবে থাকতেও অনুরোধ করেছি। এসকে মুভিজ এখন অন্য ধারার ছবি করতে রেডি। এই মেসেজটাই দিতে চাই ইন্ডাস্ট্রিকে,’’ বলেন হিমাংশু।

লন্ডনেই কিন্তু এ ছবির শ্যুটিং শেষ নয়। কলকাতাতে যিশু সেনগুপ্ত আর নেহা পান্ডের শিডিউল শুরু হবে জুন মাস থেকে। লন্ডন থেকে ফেরার পথে মনে হচ্ছিল, ২০০৭-এ এক বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যায় অনিরুদ্ধ রায়চৌধুরীর ‘অনুরণন’ আর অঞ্জন দত্তর ‘বং কানেকশন’‌য়ের হাত ধরে আর্বান বাংলা ছবির ভাষাটাই বদলে গিয়েছিল।

ইন্ডাস্ট্রির অনেকেই মনে করছেন, দশ বছর পর আবার সময় এসেছে ইন্ডাস্ট্রিকে একটা ধাক্কা দেওয়ার।

পারবে কি ‘দ্য বংস এগেন’ আবার বাংলা ছবির মোড় ঘোরাতে?

অপেক্ষা করতে হবে এ বছরের ২৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত।

ছবি: ইন্দ্রনীল রায়

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন