আমেরিকার পর এ বার মেক্সিকো। ভারতীয় পণ্যে ৫০ শতাংশ শুল্ক চাপানোর পরিকল্পনা করছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেশী। তাদের এ-হেন সিদ্ধান্ত নয়াদিল্লির কাছে ‘বিনা মেঘে বজ্রপাতের’ শামিল। এর জেরে লোকসানের অঙ্ক কতটা বাড়বে ইতিমধ্যেই তার চুলচেরা বিশ্লেষণে নেমেছেন বাণিজ্য মন্ত্রকের কর্তাব্যক্তিরা। সব ঠিক থাকলে আগামী বছরের ১ জানুয়ারি থেকে মেক্সিকোর বাজারে এ দেশের সামগ্রী বিক্রি করা বেশ কঠিন হতে চলেছে, মানছে সাউথ ব্লক।
আর্থিক বিশ্লেষকদের দাবি, বর্তমান পরিস্থিতিতে মেক্সিকো সরকার এই সিদ্ধান্ত নিলে যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হবে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য। কারণ, গত কয়েক বছর উত্তর আমেরিকার দেশটির বাজারের একটু একটু করে দখল নিচ্ছিল নয়াদিল্লি। ফলে ঊর্ধ্বমুখী হয় দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের সূচক। তাতে এ বার বড় ধাক্কা লাগল বলে মনে করা হচ্ছে। যদিও এই ইস্যুতে এখনও ‘মুক্ত বাণিজ্যচুক্তি’ বা এফটিএ-র (ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্ট) তাস হাতে আছে কেন্দ্রের।
২০২২ সালে ভারত ও মেক্সিকোর মধ্যে দ্বিমুখী বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ১,১৪০ কোটি ডলার। কিন্তু, পরের বছরই (পড়ুন ২০২৩ সাল) সেটা কমে নেমে আসে ১,০৬০ কোটি ডলারে। ২০২৪ সালে ফের ঊর্ধ্বমুখী হয় সূচক। বেড়ে সেটা ১,১৭০ কোটি ডলারে গিয়ে পৌঁছোয়, যা চলতি আর্থিক বছরে (পড়ুন ২০২৫-’২৬) আরও বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছেন কেন্দ্রীয় বাণিজ্যমন্ত্রী পীযূষ গয়াল।
ভারতীয় গাড়ি নির্মাণকারী সংস্থাগুলির অন্যতম বড় বাজার হল মেক্সিকো। বছরে ৮০ থেকে ১০০ কোটি ডলার মূল্যের যাত্রিবাহী গাড়ি উত্তর আমেরিকার ওই দেশটিতে বিক্রি করে তারা। বর্তমানে এর জন্য শুল্ক দিতে হচ্ছে ২০ শতাংশ। সেটাকেই বাড়িয়ে মেক্সিকো সরকার ৫০ শতাংশ করে দিলে নয়াদিল্লির যাত্রিবাহী গাড়ি কেনা কমাতে পারে সেখানকার যাবতীয় গণপরিবহণ সংস্থা। এ দেশের গাড়ি শিল্পের জন্য সেটা বড় ধাক্কা বলেই মনে করা হচ্ছে।
ভারতীয় যাত্রিবাহী গাড়ির সবচেয়ে বড় বাজার রয়েছে সাউথ আফ্রিকা এবং সৌদি আরবে। এই তালিকায় তৃতীয় স্থানে রয়েছে মেক্সিকোর নাম। আর্থিক বিশ্লেষকদের দাবি, দুই দেশের মধ্যে ‘মুক্ত বাণিজ্যচুক্তি’ হলে অবশ্যই যাত্রিবাহী গাড়িতে শুল্কছাড়ের সুবিধা পেতে চাইবে নয়াদিল্লি। ওই সুবিধা না পেলে মেক্সিকোর বাজারে যাত্রিবাহী গাড়ির ব্যবসা রাতারাতি ধসে পড়তে পারে, বলছেন বিশ্লেষকেরা।
বর্তমানে বছরে ৬০ থেকে ৭০ কোটি ডলারের গাড়ির যন্ত্রাংশ মেক্সিকোয় রফতানি করে এ দেশের বিভিন্ন সংস্থা। এর উপর শুল্ক রয়েছে ২৫ শতাংশ। সেটাকেও বাড়িয়ে দ্বিগুণ করতে পারে উত্তর আমেরিকার ওই দেশ। তখন ওই বাজারে এ দেশের গাড়ির যন্ত্রাংশ বিক্রি যে প্রবল প্রতিযোগিতার মুখে পড়বে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
যাত্রিবাহী গাড়ি ও গাড়ির যন্ত্রাংশ বাদ দিলে ভারতের থেকে বছরে প্রায় ৯০ কোটি ডলারের লোহা-ইস্পাত কেনে মেক্সিকো। এর উপর শুল্ক রয়েছে ৩৫ শতাংশ। সেটা বেড়ে ৪০ শতাংশ হতে পারে বলে সূত্র মারফত মিলেছে খবর। ফলে সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে টাটা স্টিল। উত্তর আমেরিকার দেশটিতে বিপুল পরিমাণে ইস্পাত পাঠায় স্বাধীনতাপূর্ব দেশের এই ঐতিহ্যবাহী শিল্প সংস্থা।
এ ছাড়া ভারতের বস্ত্র ও পোশাক এবং চর্মজাত পণ্যের উপর শুল্কবৃদ্ধির পরিকল্পনা রয়েছে মেক্সিকোর। এই দুই সামগ্রীর উপর ৩০ থেকে বেড়ে করের মাত্রা দাঁড়াতে পারে ৩৫ শতাংশে। উত্তর আমেরিকার দেশটিতে বছরে ৫০ থেকে ৬০ কোটি ডলারের বস্ত্র এবং চর্মজাত দ্রব্য (মূলত জুতো) রফতানি করে নয়াদিল্লি। শুল্কবৃদ্ধির জেরে দাম বাড়লে মেক্সিকোর বাজারে এগুলির বিক্রি হ্রাস পাবে অনেকটাই। আর তাই কেন্দ্রীয় বাণিজ্য মন্ত্রকের বাড়ছে উদ্বেগ।
ভারতের ওষুধ এবং চিকিৎসা সরঞ্জাম নির্মাণকারী সংস্থাগুলির অন্যতম বড় রফতানি বাজার হল মেক্সিকো। উত্তর আমেরিকার দেশটিতে ৪০ কোটি ডলার মূল্যের জৈব রাসায়নিক এবং ওষুধ রফতানি করে নয়াদিল্লি। এর জন্য শুল্ক ধার্য রয়েছে ১৫ শতাংশ। সেটা বেড়ে এ বার ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ করতে পারেন ক্লডিয়া শিনবাউম। এতে ভারতের জেনারিক ওষুধ ওই বাজারে প্রবল প্রতিযোগিতার মুখে পড়ার প্রবল আশঙ্কা রয়েছে।
কেন্দ্রের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত বছর মেক্সিকোয় ৮৯০ কোটি ডলারের পণ্য রফতানি করেছে নয়াদিল্লি। আর্থিক বিশ্লেষকদের দাবি, আগামী ১ জানুয়ারি থেকে শুল্কের মাত্রা ৫০ শতাংশে চলে গেলে এ দেশ থেকে সামগ্রী পাঠানোর পরিমাণ হ্রাস পাবে ২৫ থেকে ৪০ শতাংশ। আর তাই লোকসান ঠেকাতে এফটিএ-র জন্য শিনবাউম সরকারের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে কেন্দ্রীয় বাণিজ্য মন্ত্রক।
চলতি বছরের নভেম্বর-ডিসেম্বরে এই ইস্যুতে লবিং করে মেক্সিকান সেনেট। কিন্তু তাতে লাভ তেমন হয়নি। কারণ, এ ব্যাপারে কূটনৈতিক পর্যায়ে সমাধানে আগ্রহী মোদী সরকার। সূত্রের খবর, অবিলম্বে ‘মুক্ত বাণিজ্যচুক্তি’ সেরে ফেলতে মেক্সিকোর উপর চাপ বজায় রেখেছেন কেন্দ্রীয় বাণিজ্য মন্ত্রকের আধিকারিকেরা। এর মাধ্যমে সবার আগে গাড়ি নির্মাণ এবং ইস্পাত শিল্পের লোকসান আটকাতে চাইছেন তাঁরা।
ভারত ছাড়া চিন, তাইল্যান্ড, রিপাবলিক অফ কোরিয়া বা আরওকে (পড়ুন দক্ষিণ কোরিয়া) এবং ইন্দোনেশিয়ার পণ্যের উপরেও আমদানি শুল্ক বৃদ্ধির পরিকল্পনা করেছে মেক্সিকোর সরকার। বাণিজ্যিক ঘাটতি কমানোর জন্য এই সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে বলে জানিয়েছে তারা। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, সংশ্লিষ্ট দেশগুলির কারও সঙ্গেই কোনও বাণিজ্যচুক্তি নেই শিনবাউম সরকারের।
কিছু দিন আগেই শুল্কবৃদ্ধি সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব পাশ করে মেক্সিকোর পার্লামেন্ট ‘কংগ্রেস’-এর নিম্নকক্ষ ‘চেম্বার অফ ডেপুটিস’। গত ১০ ডিসেম্বর সংশ্লিষ্ট ইস্যুতে সবুজ সঙ্কেত দেয় পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ সেনেট। সেখানে বিলটির পক্ষে পড়ে ৭৬টি ভোট। বিপক্ষে ভোট দেন পাঁচ জন। ভোটদানে বিরত ছিলেন ৩৫ জন সদস্য।
তবে মেক্সিকোর কংগ্রেসের নিম্নকক্ষে যে বিলটি প্রথমে গৃহীত হয়েছিল, তার তুলনায় সেনেটের ছাড়পত্র পাওয়া বিলটি কিছুটা নমনীয়। মূল প্রস্তাবে যতগুলি পণ্যের উপর শুল্ক চাপানোর কথা বলা হয়েছিল, তার প্রায় এক তৃতীয়াংশ পণ্যকে তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে অনুমোদিত বিলে। মোট ১,৪৬০টির বেশি পণ্যে শুল্ক বাড়তে চলেছে বলে ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের একাংশের দাবি, শিনবাউম সরকারের শুল্কবৃদ্ধির পরিকল্পনায় সংরক্ষণ পাবে মেক্সিকোর দেশীয় ইস্পাত শিল্প, বস্ত্র শিল্প এবং গাড়ি ও গাড়ির যন্ত্রাংশ নির্মাণ শিল্প। এর মাধ্যমে ৩৭৫ কোটি ডলার (স্থানীয় মুদ্রায় ৭০ কোটি পেশো) রাজস্ব বাঁচানোর চেষ্টা করছে উত্তর আমেরিকার এই দেশ। তবে চিনা পণ্যের প্রবেশ বন্ধ করাই তাদের মূল লক্ষ্য বলে মনে করা হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ মনে করেন, মেক্সিকো সরকারের এ-হেন পরিকল্পনার নেপথ্যে রয়েছে আমেরিকা। প্রতিবেশী দেশটিকে ‘শিখণ্ডি’ হিসাবে খাড়া করে নয়াদিল্লি ও বেজিঙের উপর চাপ তৈরির ছক কষছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। কারণ, আট মাস পেরিয়ে এখনও ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যচুক্তি করতে পারেনি ওয়াশিংটন। অন্য দিকে ড্রাগনের ‘আগ্রাসী’ মনোভাবও যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থের জন্য যথেষ্ট চ্যালেঞ্জিং।
মেক্সিকোর সেনেট শুল্কবৃদ্ধির বিলে অনুমোদন দিতেই নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে চিনা বাণিজ্য মন্ত্রক। বেজিং জানিয়েছে, তারা মেক্সিকোর নয়া শুল্কব্যবস্থার উপর নজর রাখছে এবং এর প্রভাব মূল্যায়ন করা হবে। তবে শিনবাউন সরকারের এই ধরনের পদক্ষেপ দু’দেশের বাণিজ্যিক স্বার্থকে ‘উল্লেখযোগ্য ভাবে ক্ষুণ্ণ’ করবে বলেও সতর্ক করে দিয়েছে ড্রাগন। আর তাই উত্তর আমেরিকার দেশটি এই একতরফা নীতি দ্রুত সংশোধন করবে বলে আশাবাদী মান্দারিনভাষীরা।
শুল্ক নিয়ে চিনের হুমকি অবশ্য গায়ে মাখছে না মেক্সিকো। আগামী বছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যচুক্তির জন্য আলোচনার টেবলে বসবে শিনবাউনের সরকার। তার আগে উত্তরের প্রতিবেশীর সঙ্গে লেনদেনে সামঞ্জস্য আনতে চাইছেন তিনি। পাশাপাশি কর্মসংস্থানের উপরেও কড়া নজর রয়েছে তাঁর। এই পরিস্থিতি নিজেদের স্বার্থ অক্ষুণ্ণ রেখে কত দ্রুত নয়াদিল্লি মুক্ত বাণিজ্যচুক্তি সেরে ফেলতে পারে, সেটাই এখন দেখার।