International Mother Tongue Day

সব ভাষাই এখন সঙ্কটে! আমাদের সন্তানকে প্রথম দিন থেকে মাতৃভাষা শেখাব

মাতৃভাষা নিয়ে একটা দৃঢ় বিশ্বাস রয়েছে আমার। মাতৃভাষা সঠিক ভাবে বলতে না পারলে অন্য কোনও ভাষাই শেখা সম্ভব নয়।

Advertisement

পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ০৮:৫৭
Share:

পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়। গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।

আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। বার বার প্রশ্ন ওঠে বাংলা ভাষা সঙ্কটে কি না। আমি বলব, প্রতিটি আঞ্চলিক ভাষাই কিন্তু সঙ্কটে। আসলে প্রযুক্তির অগ্রগতি হচ্ছে। হাতের কাছেই রয়েছে নানা মাধ্যম। এর প্রভাবে একাধিক ভাষা মিলিয়েমিশিয়ে কথা বলার প্রবণতা বেড়েছে। এর ফলে প্রায় সব ক’টি ভাষাই এখন সঙ্কটে। এর থেকে একটা প্রশ্ন আমার মাথায় বার বার এসেছে— আমরা কি কোনও ভাষাই আসলে ঠিক করে শিখছি?

Advertisement

মাতৃভাষা নিয়ে একটা দৃঢ় বিশ্বাস রয়েছে আমার। মাতৃভাষা সঠিক ভাবে বলতে না পারলে অন্য কোনও ভাষাই শেখা সম্ভব নয়। তবে বাংলা ভাষার সামনে বিরাট সঙ্কট, এমনটাও আমি মনে করি না। কেউই আর বাংলা ভাষা শিখছে না, এমনও নয়। যদিও এটা সত্যি, আমাদের প্রজন্মের পরে অর্থাৎ ৯০-এর দশকে বা ৯০-এর দশকে শেষের দিক থেকে যারা জন্মেছে, তারা প্রবল ভাবে ‘খিচুড়ি’ ভাষার মধ্যে বড় হয়েছে। তাদের মাতৃভাষা আসলে কোনটা, সেটা তারা নিজেরাও জানে কি না, তা নিয়ে আমার সন্দেহ রয়েছে। এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা হয়তো বাংলা, ইংরেজি, হিন্দি মিলিয়ে মিশিয়ে কথা বলতে স্বচ্ছন্দ। কিন্তু ওদের লেখা পড়লে বোঝা যায়, ভাষার উপর ওদের দখল কতটা রয়েছে।

অন্তর্জালের যুগে নানা ধরনের ভাষার প্রয়োগ দেখতে পাচ্ছি। যার ফলে মনে হয়, সব ভাষাই এখন সঙ্কটে। অন্তর্জালে হয়তো অন্য ধরনের ভাষায় কথা বলায় স্বচ্ছন্দ মানুষ। কিন্তু লেখার ক্ষেত্রে বা সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রে ভাষার সঠিক প্রয়োগ জরুরি। তার মানে এই নয়, সাধু ভাষায় লিখতে হবে। চলিত বাংলা ভাষায় লিখলেও সেটায় যেন যত্ন থাকে। সেটা যেন অন্তর্জালের ভাষা না হয়ে যায়। আসলে বিবর্তন ও অবলুপ্তি এক জিনিস নয়। আজ থেকে ১০০ বছর আগে অন্য ধরনের বাংলায় কথা বলত মানুষ। আজ সেটা হয় না খুব স্বাভাবিক ভাবেই। আবার বাংলাদেশে বা পশ্চিমবঙ্গের অন্য জেলাগুলির বাংলা ভিন্ন ধরনের। কিন্তু সেগুলিও তো বাংলা ভাষা। কলকাতার বাংলাকে মান্য বলে মনে করা হয় অনেক ক্ষেত্রেই, প্রমিত বাংলা ভাষা বলা হয়।

Advertisement

ভাষার বিবর্তন তো হবেই। কিন্তু বাংলা শব্দের জায়গায় হিন্দি বা ইংরেজি শব্দ বসে গেলে তো সেটাকে বিবর্তন বলা যায় না। কমলকুমার মজুমদার বাংলা লেখার ধরনে পরিবর্তন এনেছিলেন। উদ্দেশ্য ও বিধেয়র ব্যবহারও পরিবর্তন করে দেন। আজকের ছেলেমেয়েরা উদ্দেশ্য, বিধেয় বা অন্য ব্যাকরণ জানে তো?

আসলে ভাষা কেবল ভাষা নয়। ভাষা কিন্তু একটা জাতির ইতিহাস। এখন কোনও জাতিকে চিহ্নিত করার নির্ধারক হয়ে উঠছে গায়ের রং, ধর্ম, আচার-আচরণ। কিন্তু জাতিকে চিহ্নিত করার সবচেয়ে বড় নির্ধারক হল ভাষা। নিজের মাতৃভাষাটা তাই জানা জরুরি। পশ্চিমবঙ্গের বাইরে থাকলে আমি স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে হিন্দি ও ইংরেজিতে কথা বলি। কিন্তু নিজের ভাষাটাও আমি জানি।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস নিয়ে বলতে গেলে বাংলাদেশের কথা উঠে আসে ঠিকই। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে একটা কথাই বলার— বাংলাদেশ একটা স্বাধীন দেশ। বাংলাদেশের স্বাধীন হওয়ার নেপথ্যে ভারতের সুনির্দিষ্ট অবদান ছিল ঠিকই, কিন্তু তারা কোন দিকে যাবে, কী ভাববে সেটা তাদেরই সিদ্ধান্ত। শুধু বাংলাদেশ নয়। চাইব, যে কোনও প্রতিবেশী দেশেই যেন কোনও ধরনের ধর্মীয় মৌলবাদ মাথাচাড়া দিয়ে না ওঠে। আমাদের দেশ বা আমেরিকা, ইংল্যান্ডেও এই ধরনের সম্ভাবনা দেখলে ব্যক্তিগত ভাবে আমি বিচলিত হব একই ভাবেই। এর আগেও বিভিন্ন চড়াই-উতরাইয়ের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশ গিয়েছে। তাই বিশ্বাস করি, ফের বাংলাদেশ তার স্থিতি খুঁজে পাবে।

তাই ভাষার ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ কোন দিকে যাবে, তা একান্তই তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়। আর ভাষায় দক্ষতা বৃদ্ধির প্রসঙ্গে বলব, প্রত্যেক বাবা-মায়েরই নতুন প্রজন্মকে মাতৃভাষা শেখানো উচিত। বাঙালি বাবা-মা হিসেবে আমি ও পিয়া অবশ্যই চেষ্টা করব, প্রথম দিন থেকে যাতে বাংলা ভাষার সঙ্গে আমাদের সন্তানের যোগ তৈরি হয়। অবশ্যই সারা বিশ্বের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করার ভাষাও সে শিখবে। যেমন আমি বা পিয়া শিখেছি। কিছুটা গর্ব করেই বলি, বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে গিয়েই স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে সংযোগ স্থাপন করতে পারি। কিন্তু তার মানে কি বাংলা ভাষাটা কম জানি? তা তো নয়। চেষ্টা করব, আমাদের সন্তানও যেন ভাষাজ্ঞানে এই ভারসাম্যটা বজায় রাখতে পারে।

(সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে অনুলিখিত)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement