‘কৌন বনেগা ক্রোড়পতি’র বিশেষ পর্ব নিয়ে মতামত দিলেন চৈতি ঘোষাল, অরিন্দম শীল, শ্রীলেখা মিত্র। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
মুখোমুখি অমিতাভ বচ্চন এবং ১০ বছরের কিশোর ইশিত ভট্ট। প্রথম জন সঞ্চালক, দ্বিতীয় জন প্রতিযোগী। এর আগেও একাধিক কিশোর প্রতিযোগী ‘কৌন বনেগা ক্রোড়পতি’তে যোগ দিয়েছে। তা হলে সাম্প্রতিক এই পর্ব নিয়ে এত চর্চা কেন? দর্শকের খারাপ লেগেছে ঈশিতের ‘উদ্ধত’ আচরণ।
এই নিয়ে গত দু’দিন ধরে বিস্তর চর্চা সমাজমাধ্যমে। ঈশিতের আচরণ নিয়ে কাটাছেঁড়া চলছে সেখানে। কিশোরের পাশাপাশি অধিকাংশ লোকই দায়ী করছেন মা-বাবাকে। তাঁদের মতে, এখন থেকে ঈশিতকে সংযত না করলে আগামী দিনে কিশোরের মা-বাবাকেই হয়তো পস্তাতে হবে। কিছু মানুষ অবশ্য এ ভাবে কিশোরটিকে সমালোচনায় বিদ্ধ না করার পক্ষে। তাঁদের পাল্টা বক্তব্য, এতে হিতে বিপরীত হতে পারে।
বাকিদের সন্দেহ, পুরোটাই চ্যানেলের কারসাজি নয় তো? রেটিং চার্টে প্রভাব ফেলতেই এই ‘নাটক’ কি না, তা নিয়ে চলছে জল্পনা।
‘কৌন বনেগা ক্রোড়পতি’ শুধুই সাধারণ দর্শকের নয়, সব ক্ষেত্রের খ্যাতনামীদেরও প্রিয়। তাঁরাও সুযোগ পেলেই দেখেন। তাঁদের অনেকেই সন্তানের মা বা বাবা। যেমন, পরিচালক অরিন্দম শীল, চৈতি ঘোষাল বা শ্রীলেখা মিত্র। এঁদের প্রত্যেকেরই সন্তান আছে। এঁরাও সুযোগ পেলেই অমিতাভের অনুষ্ঠানটি দেখেন। যদিও তিনজনের প্রত্যেকে চর্চিত এই পর্বটি দেখেছেন, তা নয়। সমাজমাধ্যম মারফত বিষয়টি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল।
খ্যাতনামী হিসাবে নয়, একজন মা কিংবা বাবার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিষয়টি নিয়ে কী বক্তব্য তাঁদের? আগামী প্রজন্মের নিজেকে প্রমাণ করার হাতিয়ার কি ঔদ্ধত্য? আনন্দবাজার ডট কম প্রশ্ন করেছিল তিনজনকে। কী বলছেন তাঁরা?
অরিন্দম প্রথমেই জানিয়েছেন, তিনি ওই বিশেষ পর্বটি দেখেননি। ফলে, অনুষ্ঠান নিয়ে কোনও বক্তব্য তাঁর নেই। তিনি নিজে না দেখে বা না শুনে মন্তব্য করেন না। তবে নতুন প্রজন্মের আচরণ নিয়ে বক্তব্য জানিয়েছেন তিনি। অরিন্দম বলেছেন, “বর্ষীয়ানদের সঙ্গে আচরণে কোথাও একটা ভুল হচ্ছে। ভুল হচ্ছে পরবর্তী প্রজন্মকে বড় করে তোলার ক্ষেত্রেও। ইদানীং দেখা যায়, কোনও কিছু শুনলে, দেখলে বা আদৌ কিছু করা হলই না— তার পরেও বেশির ভাগ মানুষ ফস করে মন্তব্য করে বসলেন। কিংবা কথা বলতে গিয়ে অপমান করে বসলাম। এটা কিন্তু আমাদের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, ইতিহাস বা রীতি নয়।” সেই জায়গা থেকে পরিচালক-প্রযোজকের দাবি, বেঠিক আচরণের দায় কোনও শিশুর উপরে চাপিয়ে না দিয়ে সকলের আগে সে কোন পরিবেশে বেড়ে উঠছে বা কোন জায়গা থেকে আসছে— সেটা জরুরি। পাশাপাশি তাঁর এও মত, অমিতাভ বচ্চন বলে নয়, যে কোনও প্রবীণের সঙ্গেই এই ধরনের আচরণ নিন্দনীয়। ঈশিত এবং তার মা-বাবার উচিত, বর্ষীয়ান অভিনেতার কাছে ক্ষমা চেয়ে নেওয়া।
বাস্তব যদিও দেখিয়েছে অন্য ছবি। ঈশিতের মা-বাবা দর্শকাসনে বসে পুরো বিষয়টি হাসতে হাসতে উপভোগ করেছেন। তা হলে কি আগামী প্রজন্ম নিজেকে ঝকঝকে দেখাতে ঔদ্ধত্যকেই হাতিয়ার করছে? আর সেটা মেনে নিচ্ছেন তাদের অভিভাবক?
অরিন্দম মানতে নারাজ। তাঁর কথায়, “আমার আবাসনে বহু খ্যাতনামী থাকেন। তাঁদের সন্তানদের বেড়ে উঠতে দেখেছি। তারা কিন্তু এই ধরনের আচরণ করে না। আমি অন্তত দেখিনি। তাই কেউ একজন ভুল করলে গোটা একটি প্রজন্মকে ‘ভুল’ বা ‘উদ্ধত’ বলে দাগিয়ে দেওয়া উচিত নয়।” আর অনুষ্ঠানটাই যদি ‘স্ক্রিপ্টেড’ হয়? অমিতাভ বচ্চন এ রকম একটি নিম্নরুচির পর্ব শুটিং করতে রাজি হবেন, সেটাই মানতে রাজি নন অরিন্দম। এও দাবি তাঁর, কোনও চ্যানেল এই ধরনের বিষয় ভাবলে ভয়ের ব্যাপার। এর থেকেই প্রমাণিত, বিষয়ভাবনা ক্রমশ নিম্নগামী।
শ্রীলেখা মিত্রের উপলব্ধি ‘স্ক্রিপ্টেড’ অনুষ্ঠানের দিকেই আঙুল তুলছে। একই ভাবে তাঁর কথায় প্রচ্ছন্ন অনুযোগের সুর অনুষ্ঠানের সঞ্চালকের বিরুদ্ধে। অভিনেত্রীর দাবি, “যদি পুরোটা সাজানো হয় তা হলে কেন অমিতাভ বচ্চনের মতো একজন তাতে শুটিং করতে রাজি হলেন? সকলের আগে ওঁরই তো বাধা দেওয়া উচিত ছিল!” শ্রীলেখা সন্দেহ প্রকাশ করেছেন ওই কিশোরের মানসিক স্থিতি নিয়ে। আঙুল তুলেছেন ঈশিতের মা-বাবার দিকেও। তাঁর মতে, “অভিভাবক যে ভাবে সন্তান মানুষ করবেন সে ভাবেই শিশু বড় হয়ে উঠবে।” তিনি এ প্রসঙ্গ উদাহরণ দিয়েছেন টলিউডের। জানিয়েছেন, কাজ করতে গিয়ে দেখেছেন, অনেক শিশুশিল্পীর মা-বাবা তাঁদের সন্তানদের ‘পাকা পাকা কথা’কে প্রচারের হাতিয়ার বানিয়ে আরও কাজ পাওয়ার জন্য শিশুশিল্পীদের এগিয়ে দেন। অভিনেত্রীর মতে, এটা একেবারেই কাম্য নয়।
এই প্রসঙ্গে তাঁর দ্বিতীয় উদাহরণ মেয়ে ঐশী। শ্রীলেখা বলেছেন, “আমার মেয়ে প্রথম প্রবেশিকা পরীক্ষায় ভাল ফল করায় সেটা সমাজমাধ্যমে লিখতে চেয়েছিলাম। সঙ্গে সঙ্গে ঐশী তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে লিখতে দেয়নি। খারাপ লেগেছিল খুব।” পরে মেয়ের যুক্তি শুনে মন ভরে গিয়েছিল মায়ের। ঐশী তার অভিনেত্রী মা-কে জানিয়েছিলেন, তাঁর থেকেও হয়তো কেউ ভাল ফল করেছেন। সে কথা প্রকাশ্যে আসবে না, শুধুই সেই পরীক্ষার্থীর মা ‘শ্রীলেখা মিত্র’ নয় বলে!
অভিনেত্রী চৈতি ঘোষাল কিছুতেই পুরো বিষয়টিকে ‘সাজানো’ বলে মানতে রাজি নন। নিজের কথার পক্ষে তাঁর যুক্তি, “একটি ১০ বছরের শিশু অতক্ষণ ধরে ও-ভাবে অভিনয় করতে পারে না। করা যায় না। চ্যানেল কর্তৃপক্ষও এত বোকা নন যে, অমিতাভের সঙ্গে এই ধরনের পর্ব শুটের কথা ভাববেন।” তা হলে অমিতাভ বচ্চন বা চ্যানেল কর্তৃপক্ষ কোনও প্রতিবাদ জানালেন না কেন? পর্বটাও তো না দেখাতেই পারতেন তাঁরা? চৈতিও সহমত এ বিষয়ে। তাঁর মতে, এটি করা যেতেই পারত। কিন্তু কেন করা হল না, সেটা তিনিও বুঝতে পারছেন না। পাশাপাশি, ঈশিতের আচরণ সম্পর্কে তাঁর মত, মা-বাবা যদি ছোট থেকে সন্তানের ঔদ্ধত্যকে প্রশ্রয় দেন তা হলে তার মনে বদ্ধমূল ধারণা জন্মাবে, সে যা করছে ঠিক করছে। হয়তো ঈশিতের সঙ্গেও সেটাই ঘটেছে।