বয়স সাড়ে বিরানব্বই।
কিন্তু সেটা তো শুধুই ক্যালেন্ডারের হিসেব।
বার্ধক্য যতই ছোবল বসাবার চেষ্টা করুক, এখন এই সাড়ে বিরানব্বইতেও তিনি যেন আড্ডার মাঝে ফুটন্ত তরুণ। তবে সবার সঙ্গে আড্ডা দেন না। পছন্দসই মানুষ পেলে বিছানায় শুয়েও জমে যান গল্পে।
এক সময় বলতেন ‘আমার বয়স নীললোহিতের মতো ২৭’। সেই সাতাশেই বোধ হয় মনে-মনে পড়ে আছেন তিনি।
আড্ডা দিতে গিয়ে মাঝে মাঝে ঝিমিয়ে পড়লেও পরমুহূর্তে সজাগ হয়ে ওঠেন। বিস্মৃতি তো থাকবেই, কিন্তু স্মৃতিও কম প্রখর নয়। তবে সাধারণ বৃদ্ধদের মতো কেবলই পুরনো দিনের কথায় পড়ে থাকেন না। বারে বারে খোঁজ নেন আজকের দিনের।
চওড়া ফ্রেমে আঁটা মোটা লেন্সের আড়ালে চকচকে দুটো চোখ, ঠোঁটের কোণে সেই মুচকি হাসি ঠিক একই রকম, যেমন ছিল আজ থেকে তিরিশ কি পঁয়ত্রিশ বছর আগে।
প্রতিটা কথা শোনার চেষ্টা, প্রতিটা কথার উত্তর দেওয়ার চেষ্টা অদম্য। অদম্য কৌতূহল। তিনি মৃণাল সেন। নব্বই উত্তীর্ণ শরীরে বার্ধক্যের ক্লান্তি তো স্বাভাবিক। তাই দিনের অনেকটা সময় কাটে শোওয়ার ঘরে।
কিন্তু ওই যে বললাম কৌতূহল অদম্য। এখনও খবরের কাগজ পড়েন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। রাজনীতি থেকে খেলা সব কিছু গভীর ভাবে পড়া চাই। ‘‘ক্রিকেট ম্যাচ থাকলে টিভির সামনে বসতে পারি টানা ঘণ্টা চারেক, বেশ লাগছে বিরাট কোহলিকে,’’ বললেন মৃণাল।
তবে হ্যাঁ, আগের থেকে কথা বলেন কম। শোনেন বেশি। মৃণাল অসম্ভব লোকজন ভালবাসেন। কিন্তু এখন আর তেমন করে আড্ডা হয় না। বয়সের ভার সামাল দিতেই তাঁর পদ্মপুকুরের বাড়িতে অতিথির সংখ্যাও গোনা গাঁথা। ‘‘সেটার কারণ একটাই। আমি এখন ছবি করছি না তাই ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক থাকে না। তাও একেক জনকে আমি বলি ‘তুমি আমাকে রোজ একটা করে ফোন করবে। এখন ফোনেই বেশি কথা হয়,’’ বলেন মৃণাল।
কারা আসেন আজ মৃণালের বাড়িতে?
‘‘কাজের সূত্রে যাঁরা আমার সঙ্গে জড়িয়েছিল তাঁরা অনেকেই আসে নিয়মিত। আসে চিকিৎসক বন্ধুরা। আসে শ্যাম বেনেগাল-গোবিন্দ নিহালনির মতো মানুষজনও,’’ বলেন মৃণাল।
দিনের অনেকটা সময় ঘুমিয়ে কাটে বলে ভোর পাঁচটা-তে এখনও ঘুম ভাঙে মৃণালের। কোনও কোনও দিন রাত তিনটেতেও উঠে পড়েন। তার পর শুরু করেন কথা বলা।
কী নিয়ে কথা হয়? ওঁর স্ত্রী গীতা সেন বললেন, বেশির ভাগ সময়ই ছেলে কুণালকে নিয়ে কথা হয়। কথার ফাঁকেই মৃণাল একবার স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘আচ্ছা বাবুর সঙ্গে তোমার আজ কথা হয়েছে?’’ গীতা বলেন, ‘‘কালই তো কথা হল। তোমাকে বললাম না।’’
বারবার ছেলের কথা মনে করেন মৃণাল। এই অভ্যেসটা তাঁর স্বভাবে সাম্প্রতিকতম সংযোজন।
নতুন সংযোজন আরও অনেক কিছুই। মিষ্টি ভালবাসেন এখনও। প্রতিবেদকের সামনেই খেলেন পছন্দ মতো মিষ্টি দু’বার চেয়ে নিয়ে।
আসল কথা, এই বয়সেও প্রেশার, সুগার সব নর্ম্যাল। সেই জন্যই খাওয়ার ক্ষেত্রে খুব বেশি কড়াকড়ি মানেন না। মৃণাল নিজেই বললেন হাসতে হাসতে সে কথা।
তবে সিনেমা হলে গিয়ে ছবি দেখা তাঁর হয় না। আর বাড়িতেও টিভিতে সিনেমা দেখার অভ্যেস নেই। এখন বাজারে কী ছবি চলছে জানতে চাইলেন তিনি। জানতে চাইলেন ‘হর হর ব্যেমকেশ’ কেমন হয়েছে। জিজ্ঞেস করলেন কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় এখন কী ছবি করছেন? কৌশিক তাঁর প্রিয় পরিচালক। ‘শব্দ’ ছবিটা দু’বার দেখেছিলেন হলে গিয়ে। কথায় কথায় প্রশ্ন করেন, ‘‘সৃজিত এখন কী ছবি করছে? ওর সঙ্গে আমার আলাপ নেই। কোনও ছবিও দেখিনি।’’
বিদেশি পরিচালক যেমন পোল্যান্ডের আন্দ্রেই ওয়াজদা, ফ্রান্সের পরিচালক ডি অলিভিয়েরা — ওঁরা তো নব্বই পেরিয়েও ছবি করেছেন, কিন্তু মৃণাল কি ইচ্ছে করলে আজ ছবি করতে পারেন না? উদাস হাসি খেলে যায় ঠোঁটের কোণে। শোনা যায় গৌতম ঘোষ ও অঞ্জন দত্ত মৃণালকে ছবি পরিচালনা করায় সাহাহ্য করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মৃণাল সে পথে পা দেননি। বললেন, ‘‘ আমি এখনও পুরনো ছবিগুলো নিয়ে ভাবি। ভাবি ওই ছবিগুলো আজ করলে কী ভাবে করতাম।’’ কথা বলতে বলতে উচ্ছ্বাস ঝরে পড়ে তাঁর কণ্ঠে।
ব্যক্তিগত কিছু আলাপের পর এ বার বেরিয়ে যাওয়ার পালা। আবেগমথিত গলায় বললেন, ‘‘আবার এসো। আসার আগে ফোন কোরো। এলে আড্ডা হবে।’’
লিফ্টে নামতে নামতে মনে হয়, আবার আসতে হবে তাঁর কাছে। এখনও মৃণালের কাছে অনেক কিছুই শোনা বাকি রয়ে গেল।
ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল।