‘দৌড়’ থামল প্রথমবার

এক বছরের জন্য উপন্যাস লেখা থেকে ছুটি নিলেন সমরেশ মজুমদার। কী হল হঠাৎ? খোঁজ নিলেন সংযুক্তা বসু।এক বছরের জন্য উপন্যাস লেখা থেকে ছুটি নিলেন সমরেশ মজুমদার। কী হল হঠাৎ? খোঁজ নিলেন সংযুক্তা বসু।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০০:০০
Share:

পঞ্চাশ বছর ধরে সিগারেট খেয়েছেন। সাত মাস হল সিগারেট ছেড়েছেন।

Advertisement

চল্লিশ বছর ধরে লিখেছেন দেড়শোরও বেশি উপন্যাস। এই বছর ঠিক করেছেন আগামী এক বছর কোনও উপন্যাস লিখবেন না। লিখবেন শুধু ছোট গল্প, নিবন্ধ।

তিনি লেখক সমরেশ মজুমদার। যাঁর উপন্যাস ‘দৌড়’ থেকে ‘উত্তরাধিকার’ ‘কালবেলা’ ‘কালপুরুষ’ কিংবা ‘সাতকাহন’ থেকে ‘গর্ভধারিণী’ জনমানসে তোলপাড় তুলেছে। যাঁর সৃষ্ট চরিত্র অনিমেষ-মাধবীলতা-অর্ক এখনও পাঠকের রোম্যান্টিক মননে মূর্ছনা জাগায়, যাঁর সৃষ্ট চরিত্র দীপাবলী আজও অভিভূত করে পাঠিকাদের, সেই সমরেশ মজুমদার একটা গোটা বছর উপন্যাস লিখবেন না।

Advertisement

ভাবা যায়?

তা কেন এমন সিদ্ধান্ত? সমরেশ বললেন,‘‘কোথাও মানসিক ভাবে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। তাই এই বিরতি। বিরতি না নিলে ভাল বিষয় মাথায় আসবে না যে।’’

চল্লিশ বছর ধরে দেড়শো উপন্যাস লিখেছেন। তার প্রত্যেকটার বিষয় আলাদা। ‘‘সেই আলাদা বিষয় খোঁজার জন্যই এই এক বছরের ছুটি নেওয়া,’’ বলছেন সমরেশ।

রোজ সকালে উঠে চা খেয়ে লিখতে বসার চাপ থেকে মুক্ত হতে চান তিনি। তাঁর মতে সব রকম পেশায় অবসর আছে। কিন্তু লেখকদের কোনও অবসর নেই। যত তাঁরা বৃদ্ধ হন, ততই অভিজ্ঞতার পুঁজি ফুরোতে থাকে। তবু লেখকেরা লিখে যান। ফলে যে লেখা প্রকাশ পায় তা বহু ব্যবহারে জীর্ণ।

সেই জীর্ণতা যাতে তাঁর লেখায় চেপে না বসে সেই জন্য ঠিক করেছেন এই বার একটা বছর শুধুই বেড়াবেন। দেখবেন মানুষজন, নানা জায়গা। ‘‘এত দিন শুধু বিদেশে ঘুরেছি। এই এক বছর ঘুরব দেশের মাটিতে। কখনও যাব পুরুলিয়ার ভালোপাহাড়, কখনও বা যাব আমার প্রিয় ডুয়ার্সের চা বাগানে।’’

এমন ভাবে বিরতি কি নিয়েছেন আর কোনও লেখক? ‘‘রমাপদ চৌধুরীও একটা সময়ের পর লেখা থেকে অবসর নিয়েছিলেন। আনন্দবাজারে আসতেন রবিবাসরীয়ের সম্পাদনার কাজ করতে। কিন্তু নিজে লিখতেন না। আমি সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে ঠিক করেছি শুধু উপন্যাস লিখব না। বাকি সব কিছু লিখব। কলম তো হাতে থাকছেই।’’

গত বছর ফুসফুসের সংক্রমণ জনিত অসুখে পড়ে সমরেশকে হাসপাতালে ভর্তি থাকতে হয় দীর্ঘ দিনের জন্য। হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরার পর তাঁর মনে হয়েছিল গত চল্লিশ বছর দম ফেলার সময় পাননি। যন্ত্রের মতো লিখে গিয়েছেন।
‘‘ভাবলাম জলের ট্যাঙ্ক যেমন পরিষ্কার করতে হলে জল সরবরাহ বন্ধ রাখতে হয়, তেমনি মনের থিঙ্ক ট্যাঙ্ক বন্ধ না রাখলে নতুন লেখার নতুন ভাবনা আসবে না। আমি থিঙ্ক ট্যাঙ্কটাকে পরিষ্কার করতে চাই। তাজা বাতাস ঢোকাতে চাই মনের ভিতর। তার পর এক বছর বাদে দেখা যাবে নতুন উপন্যাস কেমন দাঁড়ায়,’’ বলছেন সমরেশ।

এই বিরতি কালের মধ্যেই তাঁর সারা জীবনের সাহিত্যকর্মের জন্য উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পেতে চলেছেন ডি লিট উপাধি। আগামী ২৬ ফেব্রুয়ারি। কেমন লাগছে এই স্বীকৃতির আহ্বান? ঠিক যে সময়ে উপন্যাস লেখায় বিরতি নেওয়ার কথা ভাবছেন তখন আসছে সারা জীবনের সাহিত্যকীর্তির সম্মান। ‘‘আমার রীতিমতো অস্বস্তি হচ্ছে এই স্বীকৃতি পাওয়ার ব্যাপারে। কখনও কখনও মনে হয় আমি লেখক ঠিকই কিন্তু তারাশঙ্কর–বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখনী যে ধারায় বয়ে চলেছিল আমার লেখনীতে কি তেমন প্রসাদগুণ আছে? এই দ্বিধা আমাকে অস্বস্তিতে ফেলে। মনে হয় আমি কি যোগ্য এই স্বীকৃতির? নিজের লেখা ছাপা হওয়ার পর আমি কখনও আর পড়ে দেখি না। যা হয়ে গেছে তা হয়ে গেছে মনে হয়। কিন্তু পাঠকেরা যখন ফোনে বা চিঠিতে লেখার প্রশংসা করেন, তখন মনে হয়, হয়তো আমার লেখারও কিছু আবেদন আছে,’’ বলছেন সমরেশ।

অবিরত লিখে চলা মানুষের পক্ষে আচম্বিতে কলম থামানো কি অতই সহজ? তাঁর যুক্তি তিনি প্রথমত নাট্যকার। ঔপন্যাসিক বা গল্পকার তিনি পরে হয়ে উঠেছেন। ‘‘সেই জন্যই ইচ্ছেমতো কাহিনির কলম থামাতে আমার অসুবিধে হবে না,’’ বলছেন সমরেশ।

এই বিরতি নেওয়াকে পাঠককুল তো মনে করতে পারে ‘রাইটার্স ব্লক’। সমরেশ বললেন, ‘‘রাইটর্স ব্লক তো হয়নি। ইচ্ছে করলে আমি কাল সকালে উঠেই উপন্যাস লেখা শুরু করতে পারি। কিন্তু সে লেখা কাগজে ছাপা হবে না। ’’

যে সব লেখক বৃদ্ধ বয়সেও ক্রমাগত লিখে চলেন তাঁরা কি তা হলে আবর্জনার জন্ম দেন? ‘‘না, তা কেন হবে! রবীন্দ্রনাথ পরিণত বয়সে একের পর এক মন জয় করা লেখা লিখেছেন। লেখায় পড়েছে তাঁর বয়সোচিত প্রজ্ঞার ছাপ। বেশি বয়সে লিখতে গেলে লেখায় পরিণত মনের ছাপটা পড়া চাই। পুরনো অভিজ্ঞতার চর্বিত চর্বণ যেন না হয়,’’ আত্মবিশ্বাসের সুরে বলেন সমরেশ।

কিন্তু উপন্যাস না লিখলে যে অঢেল সময় হাতে আসবে তখন কি কেবলই দেশ বেড়াবেন তিনি? প্রচণ্ড হাসতে হাসতে বললেন, ‘‘কত কাজ আছে। সকালে উঠে পাড়ার চায়ের দোকানে গিয়ে আড্ডা দেব, নানা ধরনের কাগজ পড়ব, প্রিয়জনের সঙ্গে ফোনে কথা বলব। পাঠিকারা যদি ফোন করেন খুশি হব।’’

তার পর? ‘‘এই বাহাত্তর বছরের জীবনে যাঁদের আমি দুঃখ দিয়েছি, আর যাঁরা আমাকে দুঃখ দিয়েছে তাঁদের নিয়ে একটা রিভিউ করব।’’ হয়তো সেই ফিরে দেখা থেকেই উঠে আসবে আগামী বছরের উপন্যাসের নতুন বিষয়।

কে বলতে পারে?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন