সরকারি প্রচারে কোনও খামতি নেই। টেলিভিশন, রেডিও, খবরের কাগজ বা রাস্তার ধারের বিশাল সাইনবোর্ডে সরকারি তরফে লেখা হচ্ছে, অসুরক্ষিত যৌন সংসর্গ থেকে বাঁচতে কন্ডোম ব্যবহারের কথা। কিন্তু বাস্তবে এ রাজ্যে সরকারি স্তরে সেই কন্ডোমের সরবরাহ কতটা?
যৌনকর্মী, ট্রাকচালক, সমকামী, হিজরাদের মতো যে সব মানুষের মধ্যে এইচআইভি-র প্রাবল্য সবচেয়ে বেশি, অর্থাৎ যাঁরা এ ক্ষেত্রে ‘হাই রিস্ক গ্রুপ’ তাঁদের নিখরচায় কন্ডোম দেওয়ার কথা সরকারের। কিন্তু জাতীয় এডস নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বা ন্যাকো-র শেষ পরিসংখ্যান বলছে, পশ্চিমবঙ্গে সরকারি স্তরে নিখরচায় কন্ডোম বিলি-র কোনও কেন্দ্রই চলছে না। বিলি হচ্ছে না কোনও কন্ডোম। অথচ দিল্লি, ঝাড়খণ্ড, অন্ধ্রপ্রদেশ, কর্নাটক, গুজরাতের মতো অনেক রাজ্যে কাজ যথাযথ হচ্ছে। সেখানে অজস্র সরকারি কন্ডোম বিলি কেন্দ্র কাজ করছে।
ন্যাকোর রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতে প্রতি ১০০ জন ট্রাক ড্রাইভারের মধ্যে প্রায় ২.৫৯ মানুষ এইচআইভি আক্রান্ত। মহিলা যৌনকর্মীদের ক্ষেত্রে এই অনুপাত প্রতি ১০০ জনে ২.৬৭ জন। এই অনুপাত কমানোর ক্ষেত্রে কন্ডোমের বড় ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ সেই জায়গাটিতেই ঘোরতর গোলমাল। ন্যাকো-র ২০১৪ সালের মার্চে প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী, নরেন্দ্র মোদি-র গুজরাতে ফ্রি কন্ডোম বিলি কেন্দ্রের সংখ্যা ১৩৭৪৮। সেখানে ২০১২-১৩ সালে বিলি হয়েছে ৩৩ লাখ কন্ডোম। মহারাষ্ট্রের ৭১ হাজার কেন্দ্র থেকে বিলি হয়েছে ৩ কোটির বেশি কন্ডোম। দিল্লির ২৪ হাজার কেন্দ্র থেকে বিলি হয়েছে ২ কোটির বেশি কন্ডোম। অন্ধ্রপ্রদেশে ৫০ হাজার কেন্দ্র থেকে বিলি হয়েছে আড়াই কোটির বেশি কন্ডোম। কর্নাটকের প্রায় ৮ হাজার কেন্দ্র থেকে বিলি হয়েছে ৬০ লাখের বেশি কন্ডোম। সেখানে পশ্চিমবঙ্গে বিলি কেন্দ্র এবং বিলি হওয়া কন্ডোমের সংখ্যা—দু’টিই শূন্য!
শুধু তাই নয়, দেখা যাচ্ছে, ন্যাকো থেকে বছরে যত কন্ডোম রাজ্যগুলিকে পাঠানো হয় সেখানেও পশ্চিমবঙ্গ অনেক রাজ্য থেকে পিছিয়ে। অর্থাৎ এ রাজ্যে কম কন্ডোম এসেছে। যেমন, ২০১২-১৩ তেই গুজরাতে ন্যাকো পাঠিয়েছে প্রায় দেড় কোটি কন্ডোম। মহারাষ্ট্রে প্রায় ৫ কোটি, তামিলনাড়ুতে ৩ কোটির বেশি, দিল্লিতে দেড় কোটি, অন্ধ্রে প্রায় সাড়ে ছয় কোটি, কর্নাটকে প্রায় সাড়ে তিন কোটি কন্ডোম। সেখানে ওই বছর ন্যাকো থেকে পশ্চিমবঙ্গে এসেছে মাত্র ৩৩ লক্ষ কন্ডোম।
সোনাগাছি অঞ্চলে দুর্বার মহিলা কমিটির তরফে স্মরজিৎ জানা বলেন, ‘‘বছর আটেক আগে এই অঞ্চলে সরকারের তরফে দু’তিনটি কন্ডোম বিলি কেন্দ্র খোলা হয়েছিল। কিন্তু আজ চার বছরেরও বেশি কেন্দ্রগুলি বন্ধ। কারণ, সরকার আর কন্ডোম সরবরাহ করে না।’’ তাঁর কথায়, ‘‘এখানকার মেয়েদের এমনিতেই কন্ডোম ব্যবহারে অসুবিধা রয়েছে। কারণ, বেশির ভাগ গ্রাহকই কন্ডোম ব্যবহার করতে চান না। এই অঞ্চলে নিখরচায় কন্ডোম বিলি কেন্দ্র থাকলে তবুও গ্রাহকদের কিছুটা জোর করতে পারত মেয়েরা। সেটাও এখন সম্ভব হচ্ছে না।’’ তিনি জানান, দুর্বার পরিচালিত উষা কোঅপারেটিভ থেকে কিছু কন্ডোম টাকার বিনিময়ে বিক্রয় করা হয়। কিন্তু তা যথেষ্ট নয়। কেন সরকার কন্ডোম বিলি কেন্দ্রগুলি চালাছেন না?
রাজ্য এডস্ নিয়ন্ত্রণ প্রতিরোধ সংস্থা (স্যাক্স)-র অতিরিক্ত প্রকল্প অধিকর্তা বিপ্লব দাস বলেন, ‘‘ন্যাকো পূর্বাঞ্চলের বেশির ভাগ রাজ্যকে খুব কম কন্ডোম সরবরাহ করে। আমাদের দিয়েছে এক বছর আগে। আমরা তার পর কিছু কিনেছি। জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশনের টাকা থেকে। আর কিছুটা বিভিন্ন সোশ্যাল মার্কেটিং গ্রুপ আমাদের দেয়। সমস্যা হল, ন্যাকোর নিয়ম অনুযায়ী আমরা নিজে থেকে কন্ডোম কিনতে পারি না।’’
ন্যাকো অন্য রাজ্যকে দিচ্ছে, এ রাজ্যকে দিচ্ছে না কেন? তাঁর উত্তর, “ন্যাকোই বলতে পারবে সেটা।” নিখরচার কেন্দ্রগুলি কেন চালানো হচ্ছে না? তিনি বলেন, ‘‘দেখা গিয়েছে অতীতে এই কেন্দ্রগুলি থেকে কন্ডোম বিলির ক্ষেত্রে অনেক নয়ছয় হয়েছে। তাই এখন জেলা স্বাস্থ্য অধিকর্তা চাইলেই তা আমরা দিয়ে থাকি।’’ যৌন পল্লিতে কেন নিখরচার কন্ডোম বিলি কেন্দ্র থাকবে না? তিনি জানান, বিলি করার জন্য দুর্বারের মতো সংগঠনগুলিকে স্যাক্স টাকা দিয়েছে। অথচ দেখা যাচ্ছে, তারা তা করছে না। যদিও দুর্বারের পাল্টা দাবি, মাসের পর মাস টাকা বাকি রাখছে স্যাক্স। ফলে এইচআইভি কর্মসূচি চালাতে গিয়ে নাভিশ্বাস উঠছে।